গর্ভাবস্থায় হাইপারটেনশন (Pregnancy Induce Hypertension)
গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পরে হবু মায়ের রক্তচাপ যদি >১৪০/৯০ মিলি মিটার পারদের বেশি হয় তাকে গর্ভাবস্থায় হাইপারটেনশন (Pregnancy Induce Hypertension) বলে। মনে রাখতে হবে রক্তচাপ অন্তত দুবার মাপতে হবে এবং ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে মাপতে হবে। দুবারই রক্তচাপ >১৪০/৯০ মিলি মিটার পারদের বেশি হতে হবে।
কারণঃ
গর্ভাকালীন হাইপারটেনশন একাধিক কারণে হতে পারে
১) প্রেগনেন্সি ইনডিউস হাইপারটেনশন (Pregnancy Induce Hypertension)- আগেই বলা হয়েছে গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর গর্ভাবস্থার বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে হবু মায়ের রক্তচাপ বাড়তে পারে। এই রক্তচাপ বাড়ার কারণে হবু মায়ের দুরকম সমস্যা হতে পারে। প্রি- এক্লাম্পশিয়া এবং এক্লাম্পশিয়া। এই সমস্যা গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালীন বা প্রসবের পরে মায়েদের ও গর্ভস্থ শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
২) এসেনশিয়াল বা সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন যা গর্ভাবস্থার আগে থেকেই ছিল।
৩) আগে থেকে থাকা হাইপারটেনশন গর্ভাবস্থার ফলে আরও বেড়ে যেতে পারে। যার ফলেও প্রি- এক্লাম্পশিয়া এবং এক্লাম্পশিয়া হতে পারে।
প্রি- এক্লাম্পশিয়াঃ
এক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং গর্ভাবস্থার শরীরবৃত্তীয় কারণে বিভিন্ন অঙ্গ প্র্যত্যঙ্গের সমস্যা দেখা যায়। প্রি- এক্লাম্পশিয়া বলার জন্য তিনটি জিনিস থাকতে হবে।
- হাইপারটেনশনঃ গর্ভাবস্থার আগে রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিল কিন্তু গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর রক্তচাপ >১৪০/৯০ মিলি মিটার পারদ।
- প্রোটিনিউরিয়াঃ প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন বেরবে।২৪ ঘণ্টার মূত্রে ৫০০ মিগ্রার বেশি প্রোটিন অথবা ১ লিটার মূত্রে ৩০০ মিগ্রার বেশি প্রোটিন।
- ইডিমাঃ হবু মায়ের সর্ব প্রথম পা ফুলবে। ১২ ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার পরও গোড়ালির ঠিক উপরে আঙুল দিয়ে চাপলে তা দেবে যাবে।
এক্লাম্পশিয়াঃ
প্রি- এক্লাম্পশিয়া মায়েদের যদি হঠাৎ করে খিঁচুনি বা কোমা হয় তাকে এক্লাম্পশিয়া বলে। এলাম্পশিয়া গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালীন এমনকি প্রসবের পরেও হতে পারে। এক্লাম্পশিয়া একটি এমারজেন্সি এবং সঠিক চিকিৎসা না পেলে মায়েদের মৃত্যু ঘটে। এমনকি সব রকম প্রচেষ্টা স্বত্বেও মায়ের মৃত্যু ঘটতে পারে।
এক্লাম্পশিয়া দেখা যায়
- গর্ভাবস্থায় ৫০%
- প্রসব কালীন ৩০%
- প্রসবের পরে ২০%
কখন মায়েদের প্রি- এক্লাম্পশিয়া/ এক্লামশিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি?
- কম বয়সে মা হলে। <২১ বছর।
- ধূমপান করলে।
- আগের গর্ভাবস্থায় প্রি- এক্লাম্পশিয়া/ এক্লাম্পশিয়া হয়ে থাকলে।
- গর্ভে যমজ বাচ্চা থাকলে।
- আগে থেকে হাইপারটেনশন থাকলে।
- ডায়াবেটিস থাকলে।
- কিডনির কোনো সমস্যা থাকলে।
- বংশে আর কারও প্রি- এক্লাম্পশিয়া/ এক্লাম্পশিয়ার ইতিহাস থাকলে।
- স্বাভাবিক গর্ভের বদলে হাইডাটিফর্ম মোল হলে।
উচ্চ রক্তচাপের জন্য হবু মায়েদের কি ক্ষতি হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের জন্য মায়েদের যে ক্ষতিগুলি হতে পারে সেগুলি হলো
- খিঁচুনি।
- কোমা।
- জরায়ুর মধ্যে রক্তপাত।
- প্রসবকালীন বা প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তপাত।
- দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া/ অন্ধত্ব।
- সময়ের অনেক আগেই প্রসব হয়ে যাওয়া।
- HELLP Syndrome: হিমোলাইসিস(রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়া), লিভার এনজাইম বেড়ে যাওয়া এবং অনুচক্রিকা কমে যাওয়া।
- হাইপারটেনশন প্রসবের পরেও থেকে যাওয়া।
- দীর্ঘমেয়াদি কিডনির সমস্যা।
গর্ভস্থ বাচ্চার যে ক্ষতি গুলি হতে পারেঃ
- গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি কমে যাওয়া।
- গর্ভাবস্থায় শিশুর মৃত্যু।
- সময়ের আগে শিশুর জন্ম এবং প্রি ম্যাচিওর হওয়ার জন্য শিশুর বিভিন্ন রকম সমস্যা।
- গর্ভাবস্থায় অক্সিজেনের অভাব এবং তাঁর জন্য শিশুর দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতি। ইত্যাদি।
কিভাবে এড়ানো যেতে পারেঃ
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপকে এড়িয়ে চলার জন্য হবু মায়েদের গর্ভবতী হওয়ার আগে থেকেই ও গর্ভাবস্থায় কিছু সাবধানতা নেওয়া প্রয়োজন। যেমন-
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা।
- সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।
- খাদ্যে লবণের পরিমাণ কমানো।
- নিয়মিত রক্তচাপ মাপা।
- ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- কফি জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলা।
- মানসিক চাপ কমানো।
চিকিৎসাঃ
চিকিৎসা তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
১) প্রি- এক্লাম্পশিয়ার মাত্রা।
২) গর্ভাবস্থার সময়কাল।
৩) চিকিৎসায় কতটা সাড়া দিচ্ছেন।
চিকিৎসার মূল লক্ষ হলো মায়ের রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা এবং মূত্রে প্রোটিনের পরিমাণ কমানো, এবং গর্ভাবস্থাকে ৩৭ সপ্তাহ অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া। ৩৭ সপ্তাহে গর্ভস্থ সন্তান মোটামুটি সুগঠিত হয়ে যায়। তখন প্রসব হলে বাচ্চার বিশেষ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রেগনেন্সি ইনডিউস হাইপারটেনশন ও প্রি- এক্লাম্পশিয়া প্রসবের পর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সেরে যায়। তবে চিকিৎসার পুরোটা সময়েই মায়ের জীবনকে গর্ভস্থ সন্তানের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ কখনোই গর্ভস্থ সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মায়ের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া হয়না।
যে যে চিকিৎসা দেওয়া হয় সেগুলি হলোঃ
১. রক্তচাপ কমানোর অধিকাংশ ওষুধই গর্ভাবস্থায় দেওয়া যায় না। যেগুলি দেওয়া যায় সেগুলি হলো মিথাইল ডোপা, ল্যাবেটলঅল, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার ইত্যাদি। তবে কোন ওষুধ দেওয়া হবে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করবে রোগিণীর অবস্থা ও চিকিৎসকের সিদ্ধান্তের উপর।
২. ইডিমা বা ফোলা কমানোর জন্য ডাইউরেটিক জাতীয় ওষুধ কখনোই দেওয়া যায় না।
৩. বাঁ দিক কাত হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ।
৪. খাদ্যঃ
- খাদ্যে প্রচুর প্রোটিন থাকতে হবে। অন্তত ১০০ গ্রাম প্রতি দিন।
- লবণ কম বা বেশি কোনোটাই করার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক লবণ খাওয়া উচিৎ। অতিরিক্ত লবণ বা লবণাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিৎ।
- ফোলা বা ইডিমা কমানোর জন্য কখনই জল কম খাওয়া উচিৎ নয়।
৫. মানসিক চাপ কমানোর জন্য হালকা সিডেটিভঁ, যেমন- ডায়াজিপাম দেওয়া যেতে পারে।
৬. রোজ মাপা উচিৎঃ
- রক্তচাপ।
- ওজন।
- জলপানের পরিমাণ ও প্রস্রাবের পরিমাণ।
- প্রস্রাবে প্রোটিন আছে কিনা। এর জন্য কিট পাওয়া যায় যা প্রস্রাবে ডুবিয়েই বোঝা সম্ভব পোটিন বেরচ্ছে কিনা।
- গর্ভস্থ শিশুর হৃদপিণ্ডের শব্দ ও হৃদগতি।
প্রি- এক্লাম্পশিয়ার সব রোগিণীকেই নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি রাখা উচিৎ। কিন্তু আমাদের মত দেশে যেখানে রোগী ও হাসপাতালের বেডের অনুপাত অত্যন্ত হতাশা জনক সেখানে অনেককেই বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা হয়। তবে প্রতি সপ্তাহে একবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ।
৭. যদি সব রকম চিকিৎসা সত্ত্বেও মায়ের রক্তচাপ বেশি থাকে, তাঁর মাথা যন্ত্রণা, উপর পেটে ব্যথা, প্রস্রাব কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হয় অথবা খিঁচুনি হয় সাথে সাথে তাঁর প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়। সেক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর ম্যাচুরিটির জন্য এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা হয়না। সব সময়ই মায়ের জীবনকে গর্ভস্থ শিশুর জীবনের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
৮. খিঁচুনি হলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র (ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও অন্যান্য) ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
৯. প্রসব হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেও খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই সময় মাকে কড়া পর্যবেক্ষনে রাখা উচিৎ।