গত দু দিন আগে ঐন্দ্রিল আবার আমাকে প্ররোচিত করল। আমার জীবনকাহিনী তো পুরোটাই প্ররোচিত হয়ে নিজের অবনমনের গল্প। যাক, গল্পে ঢুকি এবার।
ডাক্তারদের মধ্যে যারা সরকারি চাকর মানে রাজ্য সরকারি চাকর, তাদের চাকরিজীবনে একটা অসহনীয় ব্যাপার সামলাতে হয়। সেটা হচ্ছে ইনজুরি রিপোর্ট। এমারজেন্সিতে আহত রোগী এলে তা সে যে কারণেই আহত হয়ে থাক, ইনজুরি রিপোর্ট করতেই হবে। খালি আহত নয়, বিষ খাওয়া, সাপে কাটা, বাজ পড়া সব রোগী বেঁচে থাকলে তার ইনজুরি রিপোর্ট করতেই হবে।
একমাত্র চাকরিরত রাজ্য সরকারি ডাক্তারই এই ইনজুরি রিপোর্টটি লিখতে বাধ্য। উঃ, ঝামেলা বলে ঝামেলা! পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে তারই কিছু ঝলক আসবে।
সরকারি চাকরি পাবার পর প্রথম ইনজুরি রিপোর্ট লিখি বগুলায়। এই মেডিকো-লিগ্যাল ব্যাপারটা পড়ানো হয় ফরেনসিক মেডিসিন বলে একটা সাবজেক্টে। বলাই বাহুল্য অন্য সব বিষয়ের মতন এই বিষয়টিও যথেষ্ট তথ্যবহুল। আমার মতন পল্লবগ্রাহীরা পরীক্ষা বৈতরণী পার হতে ভরসা করত স্ট্যান্ডার্ড ফোর্টিফায়েড জ্ঞান সমৃদ্ধ বইয়ের চাইতে সহজতর কিছু তৈরি উত্তরের নোটবইয়ে। আপাত ভাবে অবহেলিত এই বিষয়টা কোনওক্রমে পেরিয়ে যাওয়া নবীন ডাক্তার যে হাতে কলমে প্রয়োগ করতে গিয়ে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী?
সেই প্রথম কয়েকটা এপিসোড পাশে বসিয়ে আমার প্রথম এমওআইসি জীবিতেন্দ্র দত্ত পরম স্নেহে শিখিয়েছিলেন।
চাকরি জীবনে প্রচুর ইনজুরি রিপোর্ট লিখেছি। কোর্টের সমনও পেয়েছি অনেক। প্রচুর কেসে সাক্ষী দিয়েছি। তার কিছু ছেঁড়া ছবি দিয়ে একটা কোলাজ পেশ করা যাক।
তার আগে সমন নামের এই শমনের কথা একটু বলে নিই। এই সমন কোর্টের ডেসপ্যাচ থেকে কখনও সরাসরি বা ইতিমধ্যে বদলি হয়ে থাকলে বহুহাত ঘুরে প্রায়ই এমন সময়ে পৌঁছোবে যে তাল মেলানো মুশকিল। হয় তো বারাসতে বসে আজ জানলাম কালকেই হাজিরা দিতে হবে রায়গঞ্জ কোর্টে। কিম্বা যে দিনের সমন সেই দিনেই আর এক আদালতের সমন রয়েছে। অথবা অ্যাডমিশন ডেট, যা পাল্টাবার উপায় নেই। সাধারণ ভাবে ডাক্তারেরা সমন অগ্রাহ্য করে না। সাহসী কেউ কেউ করে। নিয়ম নাকি তিনবার অগ্রাহ্য করলে, ওয়ারেন্ট বেরোবে। তখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে আদালতে হাজির করবে।
ভেবে দেখলে, এ এক রকম মন্দ ব্যবস্থা না। যদি সরকারি গাড়ি চেপে কলকাতা থেকে কালিম্পং যাওয়া যায়, মন্দ কী! শেষ বেলায় কালিম্পংয়ে থাকাকালীন ইনজুরি রিপোর্ট করেছি খানকতক সাপে কাটা কেসের। পর পর কয়েকদিন সশঙ্কচিত্তে খোঁজ নিয়েছি। তাদের কেউই মারা যায় নি তো?
দূরে সাক্ষী দিতে গেলে টিএ বিল পাবার কথা। সরকারি অফিসে সেটি করা এক কথায় প্রায় অসম্ভব। আমি কোনও দিন তা চেষ্টাও করিনি। কেউ কেউ করেন শুনেছি।
টিএ বিলের প্রসঙ্গে মনে পড়ল আর এক ঘটনা। কখনও কখনও পুলিশকে দিয়ে কেস করাতে ব্যর্থ কেউ নিজেই মামলা করেন। সেই সময় তাঁর উকিল কোর্টকে দিয়ে সমন বার করায়। নিয়ম হচ্ছে এই কেসে বাদীপক্ষ আমার যা খরচ সেটি দেবে। এই রকমের এক কেসে সাক্ষী দিতে গেছি, বছর তিরিশেক আগে। সাক্ষী দেবার পর সেই উকিল আমার হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট ধরিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু, আসুন তা হলে।
আমি সবিনয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে বললাম,
– আমি বরং অ্যাটেনডেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে নিচ্ছি জজ সাহেবের কাছ থেকে। টিএ বিল করে নেব।
তড়পানি শুনে জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। খপ করে হাতে এক তাড়া নোট দিয়ে বলল,- আর বেশি চাইবেন না প্লিজ।
গুণে দেখি তিনশ টাকা। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। নেহাত মন্দ নয় কিন্তু।
এবারে সেই কোলাজ।
প্রথম সাক্ষী দিতে গেলাম কৃষ্ণনগর কোর্টে। কী কেস ছিল খেয়াল নেই। সাক্ষী দেওয়া হয়ে গেছে। জজ সাহেব আমার কেসটার পর এজলাস ছেড়ে ভেতরের ঘরে চলে গেছেন। অ্যাটেনডেন্স সার্টিফিকেট দেবে পেশকার বাবু। বসে আছি। জজ সাহেবের খাস বেয়ারা কাছে এসে ফিসফিস করে জানাল,- সাহেব এত্তালা দিয়েছেন।
শুনেই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কী করলাম আবার? দু একবার জেরার সময় তুতলিয়েছি বটে, কিন্তু জ্ঞানত অন্যায় কিছু করিনি। মিছে কিছু বলিনি, বিপক্ষ উকিলের জেরায় ফিক করে হাসিনি, নবীনা এক কালো কোটের দীর্ঘ কটাক্ষে উদাসীন থেকেছি। আদালত অপমানিত হতে পারে এমন কিছুই করিনি? তবে?
সশঙ্ক চিত্তে ভারি পর্দা সরিয়ে হুজুরের চেম্বারে ঢুকলাম। পেছন থেকে বেয়ারা সাহস যোগালো,
– যান না, যান ক্যানে। স্যারের একটা মাত্র মেইয়ে। বিয়ে হইয়ে গেছে। ভয় নাই কুনো।
নাঃ, সে ভয় আমারও নেই। ইনটার্নশিপেই টিকে নিয়ে ফেলেছি, মানে বিয়ে করে ফেলেছি। স্যার সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, – আরে, বসুন বসুন।
একে একে নরম প্রশ্নে জেনে নিলেন নতুন চাকরের হালহকিকত। জজ না হলে সেই দিনই কাকু বলে ডেকে ফেলতে ইচ্ছে করছিল স্নেহপ্রবণ মানুষটাকে।
এ কথা সে কথার পর বললেন আসল কথাটি,- শুনুন ডাক্তার সাহেব, কোর্টে এসে অমন ঘাবড়ে যাবেন না। উকিলরা উল্টো পাল্টা বলে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। আমিও জজ হবার আগে উকিল ছিলাম যখন, তাইই করতাম। তবে আজকে কিন্তু আপনি খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন।
ঘটনা হল, আজকের যে কেসের সাক্ষী দিলাম, সেই রোগীকে সদর হাসপাতালে রেফার করেছিলাম। সেখানের হিস্ট্রিশিটের সঙ্গে আমার ইনজুরি রিপোর্টের বিস্তর অমিল।
– একটু মনোযোগী হয়ে লিখবেন এবার থেকে, কেমন? ডিফেন্সের লইয়ারটা নতুন ছেলে। শক্ত নয় তেমন। তায় ওই অযথা ভিড় বাড়ানো বাচ্চা উকিল মেয়েটার প্রেজেন্সে নিজেও একটু ঘাবড়ে গেছিল। নতুন প্রেম তো! ওর জায়গায় আমি থাকলে ঘেঁটে লাট করে দিতাম আপনাকে।
পরে সারা জীবন এই রসিক জজ সাহেবের উপদেশ মানতে চেষ্টা করেছি। যদিও ছোটোখাটো ভুল ঘটিয়েছিও প্রচুর।
ডাক্তারের উইটনেস নেবার সময়ে উকিলদের তুলনায় ডাক্তারেরা একটু বেকায়দায় থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। বুঝিয়ে বলি। মারপিটের কেসে ডাক্তার ইনজুরি রিপোর্টে লিখেছে কোলিস ফ্র্যাকচার। হাত ভাঙার এই ভ্যারাইটি সব ডাক্তারই চেনে। এক কথায় লিখতেও পারে। কিন্তু এই ফ্র্যাকচারে হাড়ের ডিসপ্লেসমেন্ট কী হয়, কোনদিকে কতখানি, পরীক্ষার সময় ডাক্তার মুখস্থ করেছিল। অ্যাদ্দিন বাদে অনেকেরই সেই বিবরণ মনে থাকে না।
সাক্ষী দেবার আগে দুদিন সময় যদি পেত, তাহলে নয় বইপত্তরের ধুলো ঝেড়ে পড়ে আসা যেত খানিক, মুখ রক্ষার খাতিরে। কিন্তু এ তো তা নয়। কী কেস কোর্টের সমনে তার কিছুই লেখা থাকে না।
সাড়ে পাঁচ বছর আগে অত্যন্ত কাজের ভিড়ে দেখে তাড়াহুড়ো করে লেখা এক ইনজুরি রিপোর্ট যা কিনা সাক্ষী দেবার আধঘন্টা পনেরো মিনিট আগে পিপির ঝুলি থেকে বার করে দেখানো হবে ডাক্তারকে। ডাক্তারকে এজলাসে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে বলতে হবে, সে নিজেই লিখেছে কোলিস ফ্র্যাকচার অফ রাইট হ্যান্ড।
এই বার শুরু হবে বোমা বর্ষণ। উকিলবাবুটির তো কেস আগের থেকেই জানে। ডাক্তারির টেক্সট বুকে যে পাতায় তার তথ্য লেখা আছে, সেটি বুকমার্ক করা। সেই বই নিয়ে এসেছে সে। এক সময় হয় তো অবধারিতভাবে আসবে সেই ডিসপ্লেসমেন্ট প্রসঙ্গ।
বেচারা ডাক্তার তার এমবিবিএস-এর সময় বলতে পেরেছিল। এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এবার লজ্জাজনক ভাবে ফেল করল।
আর তখন শুরু হবে গালি বর্ষণ। – আপনি টুকে পাশ করা ডাক্তার। যা লিখেছেন পুরোটাই হয় মিথ্যে নয় ভুল।
জজসাহেব আমি কিছু বলার আগেই স্টেনোকে ডিকটেশন দিতে শুরু করেন, আমার জবানিতে,
– ইট ইজ নট এ ফ্যাক্ট দ্যাট আই হ্যাভ কপিড ইন মাই এক্সাম…
ইনজুরি রিপোর্টের ভীতিজনক একটা চ্যাপ্টার হচ্ছে রেপ কেস। চাকরির প্রথম দিকেও ঝামেলা ছিল। কিন্তু তখন তা কম ছিল। এখন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রায় পনেরো কুড়ি পাতার ফর্ম ফিলাপ। এমারজেন্সি ভর্তি রোগী সামলে ওই ফর্ম ভরা যে কী কঠিন, যে ডাক্তারদের করতে হয় তারাই জানে।
এই নিয়ে হাস্যকর ভুল বোঝাবুঝিও ঘটে বিস্তর।
পানিহাটিতে এমারজেন্সি ডিউটি দিচ্ছি। অ্যকিউজড যুবককে এনেছে পুলিশ। অর্ধশিক্ষিত সেই আসামি পারস্পরিক সম্মতিতে করা কর্মটির বিস্তারিত বর্ণনা শুরু করেছে। সে জানে কর্মটির ইংরেজি রেপ। আর কে না জানে বাঙালি লজ্জার কথা ইংরেজিতে বলে। – মানে বুঝলেন তো ডাক্তারবাবু, ফাঁকা বাড়িতে তখন রেপ করছি…
এই অবধি বলতে না বলতেই আমার কো মেডিক্যাল অফিসার দেবু, সেই নির্বোধের মুখ চেপে ধরে গর্জন করে উঠল, – স্তব্ধ করো মুখর ভাষণ…
মুচমুচে অ্যাডাল্ট গল্পের আড়ালে দেবুকে চোখ রাঙাচ্ছিল সেই বিশ পাতার ইনজুরি রিপোর্ট।
অন্য আরেকদিনের কথা বলি।
এই সংক্রান্ত রিপোর্টে গাইনোকোলজিস্টের মেজর ভূমিকা থাকে। মহিলা গাইনি থাকলে তিনিই। নইলে পুরুষ যারা, তারাই রিপোর্ট দেবে। অক্ষয় ঘোষ গাইনিকোলজিস্ট। তার ডিউটি চলাকালীন এক কেস এসেছে। সঙ্গে অ-গাইনি আমি। তো অক্ষয় আগে এই নতুন ফর্মে কেস ট্যাকল করেনি একটাও।
আমিই বুদ্ধি দিলাম,- নিমাই দা নাকি করেছে। জিজ্ঞেস করে জেনে নে।
জানলা দিয়ে দেখা গেল নিমাইদা রাউন্ড শেষে আউটডোরে যাচ্ছে।
অক্ষয় চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,- ও নিমাই দা, দাদা আপনি নাকি রেপ করেছেন?
নিমাইদা একটু থমকালো। তারপর অকুতোভয়ে উত্তর দিল, – হ্যাঁ, করেছি তো। পরপর দুটো রেপ করেছি সেদিন।
সমবেত বর্তুল চক্ষু জনতা কী বুঝল, কে জানে!
মাতাল ধরে এনে হাসপাতাল এমারজেন্সিতে ইনজুরি রিপোর্ট করিয়ে কেস দেওয়ার একটা প্রথা কোনও কোনও পুলিশ রাত্তির বেলা পালন করেন। ব্যাপারটা বিরক্তির পর্যায়ে চলে যায়, যখন তাঁরা মাতালটিকে এমারজেন্সিতেই ছেড়ে দিয়ে নতুনতর অপরাধীর সন্ধানে গাড়িসহ উধাও হয়ে যান।
অভিভাবকহীন মাতালটি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে সে যে কী তাণ্ডব করে!
পুলিশদের কাছে পরে অনুযোগ করলে তাঁরা কপালে চোখ তুলে বলতেন, – সে কী, আপনারা ভর্তি করে নেননি ব্যাটাকে?
যেন ভর্তি করে নিলেই মাতাল মাতলামি ছেড়ে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে যাবে!
আমাদের এক জিডিএ ছিলেন, নাম শ্যামাদা’। তিনি খুব ভালো ডিউটি করতেন। ড্রেসিং আর অন্যান্য কাজে তন্দুরস্ত। কিন্তু একটাই ব্যাপার, সদা সর্বদা যাকে বলে ফুল টাঙ্কি। টাঙ্কি ফুল, কিন্তু কদাপি মাতাল নয়। আমরা শ্যামাদাকে বারণ করি। নানান অসুখের ভয় দেখাই।
তো সেই দিন মাঝরাতে পুলিশের উপহার দেওয়া এক মাতাল হাসপাতালে দাপাচ্ছে। আমরা যার পর নাই বিরক্ত। এমন সময়ে শ্যামাদা ফিরছে তার নিশীথ অভিযান শেষে। গোলমাল শুনে শ্যামাদা এমারজেন্সিতে ঢুকল। ওকে দেখেই, সেই মাতাল অবাক কান্ড, – আরে গুরু, তুম ইঁহা…
বলে সটান শুয়ে পড়ল শ্যামাদার পায়ের ওপর।
শ্যামাদা অতঃপর – চল্ বেটা, বাহার চল্
বলে তাকে বার করে নিয়ে গেল।
ফের কিছু বাদে ফিরে এসে, অকম্পিত গলায় টানটান মেরুদণ্ড, আমাদের বলল, – দেখলেন তো স্যার। আপনারা বারণ করেন। মাল কিন্তু আপনাদের কথা ভেবেই খাই। না খেলে এই এদের সামলাব কী করে?
ইনজুরি রিপোর্ট তথা সমন প্রসঙ্গে জজদের কথা বলতেই হয়। অধিকাংশ জজই আর যাই হোক খুব খারাপ নন। এক রকম সহানুভূতিশীলই থাকেন ডাক্তারের প্রতি।
অসাধারণ এক জজ পেয়েছিলাম কৃষ্ণনগরে। নাম? না থাক। পুরো নাম না বলে বরং দত্ত সাহেব বলি তাঁকে। তিনি মানুষ ভাল, কিন্তু সাক্ষীদানকারী ডাক্তারদের কাছে ছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা।
দত্ত সাহেব জেরার সময় উকিলকে থামিয়ে দিয়ে নিজে জেরা করতে ভালোবাসতেন। বক্তব্য সরল। উকিল তো আদালতের সাহায্যকারী। আমি নিজেই যথেষ্ট। সাহায্য টাহায্য লাগবে না। সেই জেরা শোনার জন্য তাঁর এজলাসে উকিল আর অন্যদেরও ভিড় হত খুব।
একদিন তাঁর এজলাসে সাক্ষী দিতে গেছি। ভয়ে কাঁপছি বলাই বাহুল্য।
আমার ঠিক আগে আর একজন ডাক্তারের সাক্ষীপর্ব চলছে। ডাঃ মিশ্র। একটা গুলিবন্দুকের কেস। এখন প্রান্তিক হাসপাতালে কী হয় জানি না, তখনকার দিনে ইনজুরি কেস এলে কাজের চাপে ফাইনাল রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গে না লিখে অনেক সময়ই এমারজেন্সির খাতায় মোটামুটি লিখে রাখা হত। পরে পুলিশ রিকুইজিশন দিলে ফাইনাল খাতায় নির্ধারিত ফর্মে রিপোর্ট লিখে তাদের দেওয়া হত।
এই ঘটনাটি, ডাঃ মিশ্র যার রিপোর্ট লিখেছেন আর সাক্ষী দিতে এসেছেন, ঘটেছে মার্চ মাসে আর পুলিশ এসে রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে অক্টোবর মাসে। রিপোর্ট অক্টোবরে লেখা হলেও যেহেতু মার্চের ঘটনা ডাক্তারের সইয়ের নীচে মার্চের তারিখই থাকতে হবে। এখন রোগীর চাপ, অন্যমনস্কতা, কী কারণে কে জানে, সইয়ের তারিখ অক্টোবর। আর ঘটনার তারিখ ওপরের দিকে যা লেখা, মার্চ।
দত্ত সাহেব সরকারি আর ডিফেন্সের উকিল দুজনকেই থামিয়ে নিজে জেরা করা শুরু করলেন। ঠোঁটের ওপর খেলা করছে ইঁদুরকে কব্জায় পাওয়া মার্জারের হাসি।
– ডাক্তারবাবু, আপনি জয়েন্ট দিয়ে ঢুকেছেন মেডিকেল পড়তে?
অবাক ডাঃ মিশ্র এই বেমক্কা প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, – আজ্ঞে না স্যার, হায়ার সেকেন্ডারির নম্বরে
– ওঃ, সেই আগের জমানা। হাতে গোণা কয়েকজন ফার্স্ট ডিভিশন মোটে। আপনি তাহলে তাদেরই একজন। বাঃ বাঃ…
প্রশস্তি শুনেও ডাঃ মিশ্র ম্রিয়মান। পরের বল ধেয়ে এল, – তার মানে খুব মেরিটোরিয়াস। তা তো হতেই হবে। নইলে কি অক্টোবরে বসে মার্চের ইনজুরি এত ভিভিড ডেসক্রিপশনে লেখা যায়?
ডাঃ মিশ্র ঘামতে শুরু করেছেন।
– আচ্ছা ডাঃ মিশ্র, টাইম মেশিনটা কোথাকার। এখানের না ফরেন মেইড?
উকিলরা খেয়ালই করেননি আর একটা কেলো রয়েছে রিপোর্টে। তারকাচিহ্ন দিয়ে একটা ফুটনোটে বুলেট ইনজুরির বর্ণনা লেখা আছে। তা থাকুক। কিন্তু ফুটনোটের নীচে যে ইনিশিয়াল তাতে আবার তারিখ মার্চের।
– মার্চ থেকে অক্টোবর তো অনেকটা সময়। কবে নাগাদ বুলেটটা ঢুকল?
ডাঃ মিশ্র নিরুত্তর। স্পষ্টতই এই প্রশ্নের উত্তর হয় না।
পরের প্রশ্ন, – ডাক্তারবাবু, বুলেট কী ভাবে ঢোকে?
ডাঃ মিশ্র হাঁফ ছাড়লেন। যাক্ বাবা, এতক্ষণে টেকনিক্যাল কোশ্চেন এল। উত্তর দিলেন, – মানে স্যার, ওই বারুদ ফেটে স্যার, মানে বুলেটটা স্যার, সাডেন গ্যাসের চাপে স্যার…
থামিয়ে দিয়ে দত্ত সাহেব বললেন, – আপনি কি সিয়োর,যে গ্যাসের প্রেশারেই ঢুকেছিল বুলেটটা? পলিটিকাল প্রেশারে ঢোকেনি?
প্রায় ঘণ্টা খানেক নাস্তা নাবুদ হবার পর মিশ্রদার সাক্ষ্য শেষ।
এবার আমার পালা। দ্বিতীয় ইঁদুর এবারে যাবে অ্যাম্ফিথিয়েটারে, ক্রীড়াউৎসুক বেড়ালের থাবার মধ্যে। কিন্তু দর্শকদের হতাশ করে, আমাকে প্রায় কিছুই বললেন না জজসাহেব।
কোর্টে ইনজুরি রিপোর্ট ছাড়াও পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের সাক্ষ্য দিতে যেতে হয়। চাকরি জীবনের শুরু থেকে অধিকাংশ ডাক্তারই এই পোস্ট মর্টেম করা ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলতে চায়। মহকুমা বা জেলা হাসপাতালের এক বিড়ম্বনা এটি। যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার না থাকলে সুপার সবাইকে ধরে বেঁধে একটা রোস্টার বানিয়ে এই পাঁচনটি গেলায়। এবং আজ অবসরের পর সাহস করে নিজের অভিজ্ঞতার আলোয় বলতে পারি রিপোর্ট যা দিয়েছিলাম, সবই মর্গের ডোমের বলে দেওয়া কথা। অন্তত আমার বেলায়।
তখন আমি হাওড়া হাসপাতালে। ওই রোস্টারের প্যাঁচে পড়ে গেছি মর্গে। আলো আঁধার এক দুর্গন্ধ কক্ষে, একপ্রান্তে পাটাতনের ওপর মৃতদেহ। অটোপসি সার্জেনের ভূমিকায় ডোম। আমি প্রায় আটদশ ফুট দূরত্বে খাতা পেন নিয়ে দাঁড়িয়ে।
ডোম, মানে মর্গে ততকালে আমার বসই বলা যায় তাকে, তার হিন্দি মেশানো বাংলায় আশ্বস্ত করেছে,
– কুনো চিন্তা নাই সাহেব। কিছু থাকলে আপনাকে ডেকে দেখিয়ে শিখলাব। আমি এখুন যা বুলব, লিখে লেন।
আমি পয়েন্ট ধরে ধরে জিজ্ঞেস করে লিখছি,
লাংস – কনজেস্টেড
হার্ট- এমপ্টি
স্টমাক?
ডোম বলল, স্যাম্পুল রাখলাম স্যার। আর ভিসেরাও স্যাম্পুল রাখলাম।
এই একটা কুয়াশাচ্ছন্ন ব্যাপার। এই স্যাম্পল আর ভিসেরা পরীক্ষা হওয়া আর তার রিপোর্ট আসার ব্যাপারটির কথা বলছিলাম।
সেদিনের সেই পোস্ট মর্টেম ডিউটিতে আমার মতন দুর্বলহৃদয় মানুষের হাড় হিম করা অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। অজস্র বার কোপানো মৃত একজনের সমস্ত ক্ষতগুলোর ক্লান্তিকর বিবরণ লেখার পর ডোম আবিষ্কার করল, মাথার ভেতরে একটা বুলেট। মানে গুলিটির এন্ট্রি আছে, এক্সিট নেই। এই বুলেট সযত্নে রক্ষিত হবে। আদালতে পেশ হবে। এবং সেখানে কোনও একজন উকিল প্রমাণ করার চেষ্টা করতেই পারেন, বুলেট আমি আদৌ পাইনি। পরে অসততার গুঢ় উদ্দেশ্যে সেটি ডট ডট ডট। তা অপ্রমাণের দায় আমার।
আর যদি তা নাও হয়, তবে সাজানো ব্যালিস্টিক স্পেশালিস্ট এই আমাকে বলতে হবে, সেটি কত দূর থেকে কোন অ্যাংগেলে কোন অস্ত্র দিয়ে নিক্ষিপ্ত। এবং আমি যা যা বলব তা যে ভুল, নানান প্রশ্নের প্যাঁচে আমাকে দিয়েই স্বীকার করানো হবে।
সরকারি চাকরির গ্যাস চেম্বারের এই অভিজ্ঞতা যে ডাক্তারদের হয়নি তারা ভাগ্যবান।
আর একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে হয় এমারজেন্সির ডাক্তারকে। সে ওই রেপ কেসেই। তা হচ্ছে মেল অ্যাকিউজড মানে যে পুরুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তার ওই কাজ করার ক্ষমতা আছে কিনা সেটি বলা। তার ডিফেন্সের লইয়ার যদি প্রমাণ করে দিতে পারে সে শারীরিক ভাবে কর্মটি করতে অক্ষম তবে সে অনায়াস নিষ্কৃতি পাবে। এই ক্ষমতা নিরূপণের ব্যাপারটি এবং পরবর্তী স্যাম্পল কালেকশনটি… থাক সেই ন্যক্কারজনক পদ্ধতি প্রকাশ্যে আলোচনা থাক। তার চেয়ে একটা অন্যরকম গল্প বলি।
আইন আদালত ও একটি ডাক্তার, এই নামে একটা সিনেমা হতেই পারত ডাঃ পত্রনবিশকে নিয়ে। তিনি এই ইনজুরি রিপোর্টের চক্করে পরে দীর্ঘদিন গারদের ওপারে ছিলেন।
একদা একটি রেপ কেস তিনি ছোট হাসপাতালের এমারজেন্সিতে দেখেন। যেহেতু সেই হাসপাতালে গাইনিকোলজিস্ট কেউ নেই তেরো চোদ্দো বছরের সেই বালিকাকে তিনি সন্নিহিত জেলা হাসপাতালে রেফার করেন। মেয়েটি সেখানে ভর্তি হয়। এই অবধি ঠিকই ছিল।
এই কেসের আসামি ধরা পড়ে। এবং পুলিশ কাস্টডিতে মারা যায়। মৃত্যুর কারণ অনুমেয়। কিন্তু যেহেতু কাস্টডি ডেথ, পুলিশের তথা তৎকালীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধে। বলা হয় কোনও রেপই আদতে হয়নি। পুলিশ এই মানুষটিকে গারদে ঢুকিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। এবং মৃত্যুর পর বেকায়দায় পড়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগসাজশে ইনজুরি রিপোর্ট বানিয়ে এক মিথ্যে রেপ কেসের অবতারণা করেছে।
কেস ঘোরালো হতে শুরু করে। রাজ্যের আন্দোলনকারী দলটির বন্ধু অটল সরকার তখন কেন্দ্রে। তাদের দাবী মত এক সিবিআই তদন্ত শুরু করান হয়। কেন্দ্রীয় সহায়তায় ইতিমধ্যে গরীব মেয়েটির পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া, আর্থিক সাহায্য দেওয়া ইত্যাদি করে বশ করা হয়। বিনিময়ে মেয়ের মা সিবিআইয়ের কাছে আর আদালতেও বলে যে এরকম ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। ইনজুরি রিপোর্টও লেখায়নি।
ডাঃ পত্রনবিশ ইনজুরি রিপোর্টে সব লিখেও যে মারাত্মক ভুলটি করেছিলেন তা হল ওই কাগজে তিনি মেয়ের আর তার অভিভাবকের সই বা টিপসই করিয়ে রাখেননি। কাজেই প্রমাণ হয়ে গেল সেটি ভুয়ো।
সিবিআই ডাক্তারকে হেফাজতে নিল অ্যারেস্ট করে। শুনেছিলাম আর্থিক বিনিময়ে কেস হাশ আপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
আমি তাঁকে পাই সেই বন্দী অবস্থায়। সরকারি নিয়মে চাকরি থেকে বরখাস্ত। অসুস্থ ছিলেন। ভর্তি হলেন। ডাক্তার বন্ধুদের উদ্যোগে তাঁকে রাখা হল আইসিইউয়ে।
আমাদের দেশে আইন চলে আইনের পথে। আইনি নির্দেশ এল সুপারের কাছে, কেন এই রোগীকে ভর্তি রাখা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হোক নইলে ডিসচার্জ করে জেলে ফেরত দেওয়া হোক।
উপায়হীন হাসপাতাল তাঁকে ছুটি দিয়ে দিল।
দিশাহারা ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশনের বন্ধুরা চেষ্টা শুরু করল প্রমাণ খোঁজা। বেশ ক বছর আগের কেস। ভর্তির প্রমাণ আছে হিস্ট্রি শিটে। হিস্ট্রি শিট রাখা রয়েছে গাদা করে, জেলা হাসপাতালের বেসমেন্টে। সেখানে বর্ষার জল ঢুকে এক গলা জল।
পাম্প ভাড়া করে সেই বেসমেন্ট সেঁচা হল। পাওয়া গেল কিছু পচা ধ্বংসপ্রাপ্ত নথি, যা থেকে কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব না। ডাঃ পত্রনবিস জেলে। জামিনের ব্যবস্থা হচ্ছে না। পারিবারিক অবস্থা সঙ্গীন।
এই অবস্থায় বেশ কিছু মাস পর অতি সহৃদয় এক হাসপাতাল প্রশাসক আর এক সহযোদ্ধা ডাক্তার দুজনে মিলে বার করলেন সাত রাজার ধন এক মাণিক। কোনও মতে নষ্ট না হওয়া এক অ্যাডমিশন রেজিস্টারে খুঁজে পাওয়া গেল সেই মেয়ের নাম যে কিনা সত্যিই ভর্তি হয়েছিল জেলা হাসপাতালে রেপ ইনজুরি নিয়ে।
আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর গারদ থেকে বাইরে বেরোলেন ডাঃ পত্রনবিস। সব পাওনাগণ্ডা পেয়ে তিনি এখন সসম্মানে অবসৃত। কিন্তু কেউ কি ফেরাতে পারবে তাঁর আর তার পরিবারের ও স্বজনদের অপচয়িত বছরগুলি।
অনেক ছবিই ধরা হল না ইনজুরি রিপোর্টের এই কোলাজে।
তবু… একসময় তো থামতেই হয়।
★
লেখাটা আমার সম্পাদক বেজায় কাটছাঁট করে এডিট করেছেন। প্রচুর স্বজনদ্রোহিতা ও সামান্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছিল মূল লেখায়।