আবার নয়, বারবার – বা বলা ভালো, রাস্তায়ই আছি।
মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনের আগে জালিয়াতি রুখতে আমরা কয়েকজন রাত্তিরবেলা কাউন্সিল অফিসের সামনে বসে থাকতাম। আপনাদের হয়ত মনে নেই সেসব কথা, চিকিৎসক-অচিকিৎসক নির্বিশেষে অনেকেই সেসব খবর শুনে বিচলিত বোধ করতেন, কিন্তু খুব বেশি মানুষ সেখানে উপস্থিত হতেন এমন বলতে পারি না।
জালিয়াতি আমরা রুখতে পারিনি। জাল ব্যালট সহ অজস্র জালিয়াতির সুবাদে নির্বাচনে জিতে যাঁরা কাউন্সিলে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, গত কয়েকমাসে থ্রেট সিন্ডিকেটের সুবাদে তাঁদের নামগুলো আপনারা সবাই অনেকবার শুনেছেন। যেমন সুদীপ্ত রায়, সুশান্ত রায় কিংবা অভীক দে। এঁরা নির্বাচনে জিতে চটপট বেশ কিছু সমমনা গুণীজনকেও কাউন্সিলে ডেকে নেন – যেমন সন্দীপ ঘোষ, সৌরভ পাল কিংবা বিরূপাক্ষ বিশ্বাস – তো এমন রত্নরাজির সমাহারে মেডিকেল কাউন্সিল যে রমরম করে নিজের কাজ করবে, করে চলবে, সে তো বলাই বাহুল্য। নিজের কাজ বলতে চিকিৎসার নিয়ামক সংস্থা হিসেবে দায়পালন নয় – তোলাবাজি, দাদাগিরি, টাকা নয়ছয় ইত্যাদি। যেমন ধরুন, কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার গত বছরকয়েক ধরে পদে বহাল আছেন কোনও সরকারি অর্ডার ছাড়া। স্বাস্থ্যভবন থেকে রেজিস্ট্রারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাঁকে পদ থেকে সরানো হয়নি। যেমন ধরুন, কাউন্সিলের অন্তত তিনজন সদস্য মাসে মাসে অবৈধভাবে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে ভাতা নিয়েছেন। যেমন ধরুন… কিন্তু ফর্দ লম্বা করে লাভ কী?!
অভয়া-র ধর্ষণ-খুনের দিন সাতসকালে কাউন্সিলের সদস্যরা চটজলদি অকুস্থলে হাজির হয়ে গেছিলেন – নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ‘সিচ্যুয়েশন ম্যানেজ’ করছিলেন, এ-ও এখন ওপেন সিক্রেট। উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কাউন্সিল-সদস্যদের সবাইকে একেবারে সদলবলে যেতে হয়েছিল কেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। (কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা তদন্তের যে পরাকাষ্ঠা পেশ করছে, তাতে সত্য উদঘাটন আদৌ কোনও দিন ঘটবে বলে বিশ্বাস হয় না।)
তো অভয়ার মৃত্যুতে জনসাধারণের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং প্রতিবাদে যেমন নজিরবিহীনভাবে অজস্র মানুষ রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়া পথে নেমেছিলেন, তাতে উত্তরবঙ্গ লবি তথা থ্রেট সিন্ডিকেটের পাণ্ডারা কিঞ্চিৎ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। আন্দোলনের গতি অক্ষুণ্ণ থাকলে এঁদের হয়ত নির্মূল করে ফেলাও সম্ভব হতো। দুর্ভাগ্য আমাদের, তা সম্ভব হয়নি। একদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন খানিক স্তিমিত হয়ে পড়া, আরেকদিকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তরফে প্রকাশ্য প্রশ্রয়দান – দুইয়ে মিলে বিষধর সাপের দল পুনরায় ফনা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
মেডিকেল কাউন্সিলে অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাস পুনরধিষ্ঠিত হতে চলেছে। (সন্দীপ ঘোষের সাসপেনশনও উঠে যাবার মুখে।)
সীমাহীন ঔদ্ধত্য, অনাচার ও দুর্নীতির পর – এবং সেই সব অনাচার প্রকাশ্যে আসার পরও – যদি উত্তরবঙ্গ লবি-র অপরাধী-চিকিৎসকের দল আবারও চিকিৎসার নিয়ামক সংস্থা মেডিকেল কাউন্সিল চালিয়ে যাবার সুযোগ পায়, যদি তারা আবারও ছড়ি ঘোরানোর অধিকার পায়, তার পরিণতি ঠিক কী হতে পারে?
প্রশ্নটা সহজ। আর উত্তরও তো জানা।
আপনারা কে কী করবেন, জানি না – কেউ হয়ত আগের মতো এবারেও চুপ থাকবেন – কেউ হয়ত বলবেন, প্রতিবাদ করে কিস্যু হয় না – কেউ হয়ত অন্য কোনও স্বার্থচিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সবই মেনে নেবেন – কিন্তু আমরা চুপ থাকব না। রাস্তায় ছিলাম, রাস্তায়ই আছি।
মেডিকেল কাউন্সিল অফিসের সামনে আজ বিকেল থেকে লাগাতার অবস্থান শুরু হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে, রাত্তিরেও, সেখানে বসে আছেন একদল চিকিৎসক। এবং সঙ্গে আরও অনেক মানুষ, যাঁদের অনেকেই পেশাপরিচয়ে চিকিৎসক না হলেও সমাজের অসুখ সারাতে উদ্যোগী।
আপনারা যাঁরা এবারেও শুধু দর্শক হয়েই থাকছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দিই – কাউন্সিল নির্বাচনের জালিয়াতির সময় আপনাদের নীরবতা যাদের ক্ষমতায় এনেছিল, থ্রেট সিন্ডিকেটের দাপাদাপি তাদের হাত ধরেই। নর্থবেঙ্গল লবি-র পাণ্ডারা যদি অপরাধী হয়ে থাকে – অ্যাক্ট অফ কমিশন, অর্থাৎ অপরাধ করা সুবাদে অপরাধী – তাহলে প্রতিবাদের দায়িত্ব পালন না করার কারণে, অ্যাক্ট অফ অমিশন বাবদে, আপনার দায়ও কিছু কম নয়। এটুকুই বলার।
আর হ্যাঁ, আবারও জানাই – পুলিশের তরফে যাবতীয় অসহযোগিতা সত্ত্বেও মেডিকেল কাউন্সিলের সামনে লাগাতার অবস্থানে চিকিৎসকরা আছেন, আরও অনেকে আছেন। রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই। আপনিও স্বাগত।