বাঙালি রোগীদের শরীরের সর্বত্র বিরাজমান অঙ্গ বা অংশ হল শিরা। কোমরে,ঘাড়ে, মাথায বা হাঁটুতে কোনো সমস্যায় ভুগছেন আর শিরা নিয়ে নিজেকে এবং চিকিৎসককে ব্যতিব্যস্ত করেন নি, এমন রোগী লাখে একটাও মিলবে কি না সন্দেহ।
কোমরে ব্যথার সাথে সাথে পায়ে যদি ব্যথা করে, তবে বেশীরভাগ মানুষের ধারণা সেটা ‘শিরার দোষ’।
মাথার উপর হাত ওঠেনা এমন এক মধ্যবয়স্ক রোগী আমাকে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমার ডান কাঁধের শিরা-টা আটকে গেছে।’ আসলে তাঁর হয়েছিল ‘পেরিআর্থ্রাইটিস’ অর্থ্যাৎ ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’।
‘ডাক্তারবাবু, আমার হাঁটুর শিরায় এত ব্যথা!’
‘ডাক্তারবাবু, আমার শিরার উপর শিরা উঠে গেছে’
এইসব কথা যদি কোনো অস্থি বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞ জীবনে না শুনে থাকেন- তাহলে তিনি যে বাংলায় ডাক্তারি করেন না, একথা হলফ করে বলে দেওয়া যায়।
‘শিরায় টান ধরেছে।’
‘শিরার ব্যথা।’
‘শিরা ফুলে উঠেছে।’
‘শিরায় জ্বালা করে।’
‘শিরা শক্ত হয়ে গেছে।’
বাঙালির শরীরে ‘শিরা’ যে এমন সর্বব্যাপী একটি বস্তু এবং তা অ্যানাটমির সমস্ত জ্ঞানভান্ডারের বাইরে- তা কি আর প্র্যাকটিস শুরু করার আগে জানতাম!
কোমরে ব্যথা নিয়ে বহু বছর ধরে ভুগে চলা এবং রাণাঘাট থেকে ভেলোর, অন্ততঃ আঠেরোজন ডাক্তার দেখিয়ে ফেলা এক রোগী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ডাক্তার বাবু, আমার কি সত্যিই শিরার দোষ? না হলে এম আর আই তে কিছু পাওয়া যাবে না কেন?’
আমি বললাম, ‘আপনার স্বপ্নদোষ হতে পারে, কিন্তু শিরার দোষ মোটেও নয়।’
ঘাড়ে স্পন্ডিলাইটিস হয়ে মেরুদন্ডের হাড় ক্ষয়ে বেঁকে যাওয়া রোগী অনেক সময়েই তার ডাক্তারকে আশ্বস্ত করেন,
‘কিছু না, শোয়ার দোষে ঘাড়ের শিরায় টান ধরেছে।’
মেরুদন্ডের স্লিপ ডিস্ক অপারেশন করে পরদিন সকালে রোগীকে দেখতে গেছি।
‘কেমন আছেন?’
‘ডাক্তারবাবু, ব্যথা তো চলে গেছে। কিন্তু শিরায় মাঝে মাঝে কেমন ঝিলিক দিচ্ছে।’
সুদূর মফঃস্বলে প্রথম চেম্বার করতে গিয়ে কলকাতা নিবাসী একজন তরুণ স্নায়ুবিশেষজ্ঞ আবিষ্কার করলেন যে, তাঁর চেম্বারের বাইরে নতুন বোর্ড লাগানো হয়েছে ‘কলকাতার বিখ্যাত ব্রেন ও শিরা বিশেষজ্ঞ ডাঃ অমুক চন্দ্র তমুক’। বাইরে অসংখ্য শিরা-র রোগীর ভীড়। সেসব দেখে সেই অমুক ডাক্তারবাবুর তখন রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে ব্রেনের শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়!
ফুটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া একটি ছেলের বাবা আমাকে একবার বলেছিলেন,
‘ডাক্তারবাবু, আমার ছেলের হাঁটুর শিরা ছিঁড়ে গেছে। মাইক্রোস্কোপ ঢুকিয়ে অপারেশন করতে হবে। আপনার কাছে হবে?’
অবলীলাক্রমে বললাম, ‘হ্যাঁ, হবে।’
কারণ ততদিনে ‘শিরা ছিঁড়ে যাওয়া’ র আসল মানে আমি বুঝে গেছি।