ডা অমিতাভ নন্দীর একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হচ্ছে, যাতে তিনি বলছেন, কোভিড আসলে সাধারণ ফ্লু ছাড়া আর তেমন কিছুই নয়, এবং তা আটকাবার জন্য যে ভ্যাকসিনটা দেওয়া হচ্ছে সেটাও অকেজো, কাজেই কোভিড এবং তার ভ্যাকসিন — কোনওটিকেই নাকি বিশেষ পাত্তা দেবার দরকার নেই। তাঁর মতে, ভ্যাকসিন বানিয়ে ভাইরাস-জাত ব্যাধিকে আটকাবার দাবি করা নাকি আসলে এক রকমের প্রকৃতি-বিরোধী দম্ভ (আবার একেবারে শেষে যদিও বলেছেন, তিনি নাকি ‘সত্যি ভ্যাকসিন’ এর জন্য অপেক্ষা করছেন)। তিনি আরও বলেন, রোগ হয়ে শরীরে ‘স্বাভাবিক’ প্রতিরোধ তৈরি হতে দেওয়াটাই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল পন্থা, এবং টিকাকরণের চেয়ে তা অনেক ভাল। সেইহেতু তাঁর সুদৃঢ় পরামর্শ, রোগটিকে অবাধে ছড়াতে দেওয়া দরকার, যাতে করে প্রতিটি ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হবার মাধ্যমে ‘স্বাভাবিক’ প্রতিরোধ-ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। আবার, যদিও ভ্যাকসিন জিনিসটাকেই তিনি ভালবাসেন না, তবুও একেবারে শেষে গিয়ে বলেছেন, যে ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলো নাকি সত্যিকারের নয়, এত তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন হয়না — বছর দশেক অপেক্ষা করলে সত্যিকারের ভ্যাকসিন পাওয়া যেত। বছর দশেক পরে ভ্যাকসিন বানালে কেন যে সেটা আর প্রকৃতি-বিরোধী দম্ভ বলে গণ্য হতে পারত না, সেটা তিনি এ ভিডিও-তে ব্যাখ্যা করে বলেন নি।
ভিডিও-টি আগে দেখেছি, আজ আরও কয়েকবার মন দিয়ে দেখলাম। এবং, একজন বর্ষীয়ান দায়িত্বশীল চিকিৎসক কীভাবে এমন বলতে পারেন, তা দেখে স্তম্ভিত হলাম।
হ্যাঁ, তিনি এখানে যা যা বলেছেন, তার সবই ভুল। নিচে ভুলগুলোর একটা তালিকা বানাই বরং।
(১) কোভিড রোগের ভাইরাসটি ‘ফ্লু ভাইরাস’-এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ই বটে, কিন্তু দুটো কোনও মতেই এক না — কোভিড অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ঠিক যেমনটি, বিগত দুই দশকে যে সমস্ত ছোট ছোট রোগ-সংক্রমণের ঢেউ এসেছে এবং গেছে যেমন ‘সার্স’ ও ‘মার্স’, যাদের মারণ-ক্ষমতা কোভিড-এর চেয়ে বেশি কিন্তু সংক্রমণ-ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম, তারাও সাধারণ ফ্লু-র আত্মীয় কিন্তু অনেক বেশি মারাত্মক। সম্ভাব্য সমস্ত মাপকাঠিতেই, অর্থাৎ রোগ-লক্ষণ, সংক্রমণ-ক্ষমতা, মারণ-ক্ষমতা, জিন-এর গঠন — এই সব কিছুতেই সাধারণ ফ্লু-র থেকে কোভিড-এর তফাত পরিষ্কার, এবং বিষয়টি গবেষণায় সুপ্রতিষ্ঠিত। [১]
(২) কোভিড-এর ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ রোগটিকে আটকাতে যথেষ্ট সফল, এবং ভ্যাকসিনের সুফল নিয়ে বিস্তর প্রামাণ্য গবেষণা আছে। আন্তর্জালে সে নিয়ে তথ্য অতিশয় সুলভ। [২]
(৩) রোগ-সংক্রমণজাত ‘স্বাভাবিক’ প্রতিরোধের চেয়ে এই ভ্যাকসিন-গুলো যে অন্তত পাঁচগুণ বেশি কার্যকর, সেটাও উচ্চমানের গবেষণায় আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। [৩]
একজন বর্ষীয়ান চিকিৎসক ও গবেষক হিসেবে শ্রীনন্দীর নিশ্চয়ই এ সব জানা থাকার কথা। তিনি যদি তা জেনে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, জেনেশুনে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার কারণ কী হতে পারে? যদি না তা জেনে থাকেন, তাহলে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এমন একটি জরুরি বিষয়ে না জেনে কথা বলাটা বোধহয় তাঁর পক্ষে ঠিক হচ্ছে না। আর, যদি এমনটাই হয়ে থাকে যে, তিনি সবই জানেন, কিন্তু সে সব গবেষণার দাবিকে ভুল বলে মনে করেন, তাহলে সোচ্চারে তা বলতেই পারেন — সেক্ষেত্রে সেটা বলাটা তো তাঁর কর্তব্যই। কিন্তু, সেক্ষেত্রে তিনি তাদের তথ্য-যুক্তিকে বিস্তারিতভাবে খণ্ডন করে রিসার্চ পেপার লিখুন, সারা পৃথিবীর পণ্ডিতদের সামনে নিজের যুক্তিতর্ককে হাজির করুন, এবং সাধারণ মানুষের কাছেও তাঁর বক্তব্যকে সহজবোধ্যভাবে হাজির করে প্রবন্ধ লিখুন। কিন্তু, এভাবে লোকের আস্থার সুযোগ নিয়ে ভিডিও-তে দুটো উড়ো কথা বলে লোককে বিভ্রান্ত করাটা কী ধরনের দায়িত্বপালননের দৃষ্টান্ত?
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শ্রীনন্দী যেভাবে ওই ভিডিও-সাক্ষাৎকারে ভ্যাকসিন বাদ দিয়ে স্রেফ স্বাভাবিক প্রতিরোধ-ক্ষমতার ওপর ভরসা রাখতে বলছেন, সেটা শুধু ভুল না, রীতিমত বর্বরোচিত। প্রথমত, স্বাভাবিক প্রতিরোধ ভ্যাকসিনের চেয়ে ভাল — এই কথাটাই পুরো মিথ্যে, তা যদি হত তাহলে তো আর কোনও ভ্যাকসিনই লাগত না কোনও দিনই। দ্বিতীয়ত, রোগকে প্রতিরোধ না করে চুপচাপ বসে বসে রোগীদের সংক্রমিত হতে দেওয়ার ওই ধরনের প্রস্তাব অতিশয় উন্মত্ত ও অনৈতিক। তৃতীয়ত, ওইভাবে স্বাভাবিক প্রতিরোধের আশায় বিনা চিকিৎসায় মানুষকে ফেলে রাখলে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ কবে অর্জন করা যাবে সেটা কেউ জানে না, কিন্তু তার আগে বেশ কয়েক কোটি লোক যে লোপাট হয়ে যাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। [৪] সেটা যদি ঘটে, তো তার দায়িত্ব কি তিনি নেবেন?
যেভাবে তিনি বললেন, মরা জীবাণু ঢুকিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি হয়, এবং বছর দশেক না হলে কিছুতেই ‘সত্যিকারের ভ্যাকসিন’ তৈরি হয়না, তাতে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি তবে ভ্যাকসিন তৈরির আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ‘mRNA’ প্রযুক্তি, এ সবের কথা কিছুই শোনেন নি? [৫]
আর, তিনি ‘সত্যি ভ্যাকসিন’-এর জন্য অপেক্ষা করছেন — এইটা জেনেও খুব অবাক হলাম। উনি তো ভ্যাকসিন ব্যাপারটারই বিরুদ্ধে, তার সত্যি-মিথ্যে নিয়ে মাথাই বা ঘামাচ্ছেন কেন খামোখা? কিছুই বুঝিনি। সাথীরা কেউ বুঝে থাকলে, বোঝাবেন।
কিন্তু, ভিডিও-টিতে যে বিষয়টি সবচেয়ে লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে এই যে, সারাক্ষণই তিনি সাক্ষাৎকারটি দিলেন মুখে একটি জবরদস্ত মুখোশ ভাল করে এঁটে রেখে। মুখোশ কেন? আইনের ভয়ে, নাকি ‘সাধারণ ফ্লু’-এর ভয়ে? আরও প্রশ্ন জাগে, আইন এবং/অথবা ‘সাধারণ ফ্লু’-এর ভয়ে যদি তিনি মুখোশ পরে থাকেন, তবে কি তিনি ওই একই ভয়ে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজও নিয়ে নিয়েছেন ইতিমধ্যে? যদি নিয়ে থাকেন, তাতে আমাদের অত্যন্ত খুশি হওয়া উচিত — তাঁর মত স্বনামধন্য বর্ষীয়ান চিকিৎসক কোভিডের কবলমুক্ত থাকুন, এটা তো সকলেই চাইবেন।
কিন্তু, নাঃ! ভিডিও দেখে অন্তত সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার কোনও উপায় নেই!
[ আমি জানি, ভ্যাকসিন-বিরোধীরা ফেসবুকে আমার থ্রেডে তর্ক করতে আসবেন। আসুন, ক্ষতি নেই। কিন্তু তর্ক যদি করেন, তো অবশ্যই সত্যিকারের চিকিৎসা-বিজ্ঞান সংক্রান্ত পদ্ধতি মেনে তথ্য-যুক্তি দিয়ে তর্ক করবেন। যদি কোভিড ও তার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত উচ্চমানের গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে তর্ক করেন, স্বাগত। কিন্তু খবরের লিঙ্ক দিয়ে অবান্তর তর্ক জুড়লে, কিম্বা অকারণে ওষুধ কোম্পানির বা বিল গেটসের দালাল বলে গালি দিলে বিনা বাক্যব্যয়ে মন্তব্য মুছে দিয়ে বন্ধুতালিকা থেকে বার করে দেব। ]
সাহায্যকারী তথ্যসূত্র
[১] https://www.cdc.gov/flu/symptoms/flu-vs-covid19.htm#:~:text=Influenza%20(flu)%20and%20COVID%2D19%20are%20both%20contagious%20respiratory,spreads%20more%20easily%20than%20flu.
[২] https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1201971221008572
[৩] https://www.cdc.gov/mmwr/volumes/70/wr/mm7044e1.htm?fbclid=IwAR0YBWs-79yLJS3kAfNagTEE0i1mPmfTkYlXGP9OyZ7TkCpkeDW9WglLCwY
[৪] https://www.nature.com/articles/d41586-020-02948-4
[৫] https://www.cdc.gov/coronavirus/2019-ncov/vaccines/different-vaccines/mrna.html
তাহলে তো জলাতঙ্ক পোলিও, টিটেনাস ইত্যাদি ইত্যাদি সব ভ্যাক্সিন বাতিল।ভদ্রলোককে যদি পাগলা শেয়ালে কামড়ায়, তাহলে উনি জলাতঙ্কে মরলে খুশি হবো।