গত ত্রিশ বছরে চিকিৎসার মান যেমন একদিকে ভালো হয়েছে, সাধারণ মানুষের গড় আয়ু যেমন বেড়েছে, তেমন সাথে সাথে আরো বেশী মানুষের কাছে বিভিন্ন ওষুধের প্রয়োজন বেড়েছে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হচ্ছে মানুষের রক্ত বা তার উপাদান, কারণ ভারত সরকারের Drug Act অনুযায়ী রক্তকে Drug হিসেবেই গণ্য করা হয়। আর এই আইন অনুযায়ী বর্তমানে Blood Bank কে Blood Centre নামে অভিহিত করা হলেও “ব্লাড ব্যাঙ্ক”কথাটি বহুল প্রচলিত হওয়ায় এই লেখাতে সেটিই ব্যবহৃত হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে – আপনার কোনো আত্মীয়ের জন্য রক্ত লাগলে কী করবেন।
? প্রথমেই জানিয়ে রাখা যায় যে, রক্তের প্রয়োজন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন –
১) দুর্ঘটনার জন্য শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে গেলে;
২) অস্ত্রোপচারের ফলে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হলে;
৩) পুড়ে গেলে;
৪) ডেঙ্গু হলে; ইত্যাদি।
এছাড়া বিভিন্ন রোগ যেখানে দেহে রক্ত তৈরী হয় না বা তার নির্দিষ্ট আয়ুকালের আগেই নষ্ট হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে বারবার রক্ত লাগতে পারে। যেমন –
১) থ্যালাসেমিয়া;
২) লিউকিমিয়া (ব্লাড ক্যান্সার);
৩) অ্যানিমিয়া;
৪) অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া;
৫) হিমোফিলিয়া;
৬) ক্যান্সার; ইত্যাদি।
এইসব ক্ষেত্রেই মাথায় রাখা উচিৎ যে, উপরের কারণগুলি ছাড়াও রক্তের প্রয়োজন হতে পারে এবং উপরের অবস্থায় যে সবসময়ে রক্ত লাগবেই এমনটা নয়, রোগীর অবস্থা দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সেইমতো রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
? চিকিৎসক রক্তের প্রয়োজনের ব্যাপারে রোগীর আত্মীয়দের কীভাবে জানাবেন?
সাধারণ ওষুধ লাগলে যেমন তাঁরা প্রেসক্রিপশনে ঔষধের নাম, তার মাত্রা, কখন খেতে হবে প্রভৃতি বিষয়ে লিখিতভাবে জানান, তেমনই এই ক্ষেত্রে Blood Requisition নামক একটি নথির মাধ্যমে তাঁরা রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত বা রক্তের উপাদানের কথা জানান।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই Blood Request Form বা ব্লাড রিকুইজিশনে এই তথ্যগুলি থাকা প্রয়োজন।
১) রক্তগ্রহীতার নাম,
২) রক্তগ্রহীতার বয়স,
৩) রক্তগ্রহীতার লিঙ্গ পরিচয়,
৪) রক্তগ্রহীতার রক্তের গ্রুপ,
৫) রক্তের কোন উপাদান কতটা প্রয়োজন?
৬) রক্ত কবে কখন প্রয়োজন?
৭) সাধারণ কোনো কারণে প্রয়োজন অথবা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন?
৮) নির্ণীত রোগ (মহিলা রক্তগ্রহীতার ক্ষেত্রে কোনও প্রসব সম্পর্কিত রোগ বা সমস্যা থাকলে সেটি আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়),
৯) রক্ত সঞ্চালনের কারণ,
১০) গ্রহীতার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ,
১১) গ্রহীতার রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা,
১২) আগে রক্ত সঞ্চালন হয়েছে কি না এবং হলে কতবার,
১৩) রক্তগ্রহীতা যেখানে ভর্তি আছেন সেই চিকিৎসা কেন্দ্রের নাম,
১৪) চিকিৎসা কেন্দ্রের যে বিভাগ (ward) -এ রক্তগ্রহীতা ভর্তি আছেন তার নাম,
১৫) রক্তগ্রহীতা যেখানে ভর্তি আছেন তার Bed Number,
১৬) সেই চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি থাকার ক্তগ্রহীতার Identification নাম্বার,
১৭) যে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যঅধিকর্তা রক্ত চাইছেন তাঁর নাম ও সই,
১৮) রক্তগ্রহীতার রক্তের নমুনা যিনি সংগ্রহ করছেন (Phlebotomist) তাঁর নাম ও সই,
১৯) রিকুইজিশন দেওয়ার সময়,
২০) রিকুইজিশন দেওয়ার তারিখ।
এই রিকুইজিশন ছাড়াও রক্তগ্রহীতার (রোগীর) রক্তের নমুনার হয় যেটি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকেই রক্তগ্রহীতার প্রয়োজন শরীর থেকে সংগ্রহ করে রোগীর আত্মীয়দের দেওয়া হয়। রক্তগ্রহীতার রক্তের রক্তরস (Plasma) এবং রক্তকণিকা অংশ আলাদাভাবে দুটি টেস্টটিউবে রাখা হয়। নির্দেশ অনুযায়ী, এই নমুনায় নিম্নলিখিত তথ্যগুলো থাকার প্রয়োজন –
১) রক্তগ্রহীতার নাম,
২) রক্তগ্রহীতা যেখানে ভর্তি আছেন সেই চিকিৎসাকেন্দ্রের নাম,
৩) সেই চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি থাকা রক্তগ্রহীতার Identification নাম্বার,
৪) চিকিৎসাকেন্দ্রের যে বিভাগ (ward) – এ রক্তগ্রহীতা ভর্তি আছেন তার নাম,
৫) রক্তগ্রহীতার যেখানে ভর্তি আছেন তার Bed Number,
৬) নমুনা সংগ্রহের সময় ও তারিখ,
৭) রক্তগ্রহীতার রক্তের নমুনা যিনি সংগ্রহ করছেন (Phlebotomist) তাঁর নাম ও সই।
National Blood Transfusion Council (NBTC) এর Guidelines অনুযায়ী, ব্লাড ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীরা এই রিকুইজিশন ও গ্রহীতার রক্তের নমুনার উপর ভিত্তি করেই ব্লাড ব্যাঙ্কের সংগ্রহ থেকে রক্ত দিতে পারেন, এর একটিও না থাকলে রোগীর আত্মীয়দের রক্ত দেওয়াটা তাদের পক্ষে বেনিয়ম হয়ে যাবে।
খুবই সহজ করে বললে, ধরে নিন আপনার ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড হলো রিকুইজিশন ফর্ম, আপনার এটিএম-এর পিন কোড হলো রক্তের নমুনা আর ব্লাড ব্যাঙ্ক হলো এটিএম মেশিন। এবার যেমন আপনার কার্ড আর পিন ছাড়া এটিএম আপনাকে টাকা দিতে অক্ষম, তেমনই রিকুইজিশন আর রক্তের নমুনা ছাড়া ব্লাড ব্যাঙ্ক আপনাকে রক্ত দিতে অক্ষম।
এছাড়া, National Accreditation Board for Hospitals (NABH) – এর Patient’s Charter অনুযায়ী, যে কোনো রোগী অধিকারবলে তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত নথি পাবেন। এছাড়া রোগীর আত্মীয়দের মনে রাখা উচিত যে অন্যান্য নথি (যেমন এক্স-রে রিপোর্ট বা আল্ট্রাসোনোগ্রাফি রিপোর্ট বা ই সি জি রিপোর্ট ইত্যাদি) -র মতো রিকুইজিশনও একটি নথি যেটি থেকে চিকিৎসাকেন্দ্র বা কোনো চিকিৎসক যে রক্ত সঞ্চালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা প্রমাণিত হয়। কাজেই রোগীর আত্মীয়দের কাছে এই নথি না থাকলে যদি রক্ত সঞ্চালনের পরে রোগীর কোনো সমস্যা হয় তবে তার পুরো দায়টাই কিন্তু তাদের উপরেই আসবে।
? তাহলে, কোনো রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে চিকিৎসাকেন্দ্রের তরফে এই কাজগুলো করা হবে –
১) রিকুইজিশন ফর্মটি সমস্ত তথ্য সহ ভর্তি করে রোগীর আত্মীয়দের একটি কপি দিতে হবে।
২) রোগীর রক্তের নমুনাগুলি (Labeling সহ) রোগীর আত্মীয়দের দিতে হবে।
? এরপর রোগীর আত্মীয়দের এই কাজগুলো করতে হবে –
১) চিকিৎসাকেন্দ্রের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক থাকলে প্রথমেই সেখানে রিকুইজিশন ও নমুনা নিয়ে গিয়ে সেখানে প্রয়োজনীয় রক্ত আছে কিনা খোঁজ করতে হবে।
২) সেখানে পাওয়া না গেলে “Not in Stock” বলে লিখিয়ে সই করিয়ে নিতে হবে এবং যেখানে তাদের কাছে সেই রক্ত বা তার উপাদান সত্যিই নেই সেখানে তাদের পক্ষে এটা লিখে দেওয়া স্বাভাবিক। (বেশ কিছু রোগীর আত্মীয়দের কাছে মৌখিকভাবে জানা গেছে যে, এইভাবে লিখিয়ে না এসে রক্তের প্রয়োজন জানালে বেশ কিছু ব্লাড ব্যাঙ্ক রক্ত দিতে গড়িমসি করে।)
৩) এরপরে সেই রিকুইজিশন ও নমুনা নিয়ে নিকটস্থ অন্য ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে খোঁজ করতে হবে, এবং প্রয়োজনীয় রক্ত পাওয়া না অবধি এইভাবে চেষ্টা করতে হবে।
৪) আবার ধরা যাক, একটি ব্লাডব্যাঙ্কে আপনি প্রয়োজনীয় রক্ত পুরোটা না পেয়ে সেখানে আংশিক রক্ত পেলেন (যেমন – দুই/তিন Unit রক্তের জায়গায় এক ইউনিট রক্ত পেলেন)। সেই ক্ষেত্রে সেখানে ঐ রিকুইজিশন ও নমুনাগুলি ওখানে ব্যবহৃত হয়ে গেলো।
ফলে, বাকি ইউনিটগুলোর জন্য অন্য ব্লাড ব্যাঙ্কে যাওয়ার আগে আবার নতুন রিকুইজিশন ও নতুন নমুনা চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে নিতে হবে।
৫) রক্তের নমুনাগুলি সংগ্রহ করার পরে তাদের আয়ু বাহাত্তর ঘন্টা।। ফলে তিন দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় রক্ত না পেলে আবার নতুন নমুনা চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করিয়ে রক্তের জন্য খোঁজ করতে হবে।
? এবার অনেক ক্ষেত্রে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত থাকে না, বা থাকলেও সেই রক্ত হয়ত খুব কম পরিমাণে থাকে, ফলে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত পাওয়া যায় না। এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, যেখানে হয়ত এক বা দুই ইউনিট রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে আছে সেখানে আপনাকে সেই এক ইউনিট রক্ত দিতে ব্লাডব্যাঙ্কের সমস্যাটা কোথায়।
আসলে সবার রক্ত প্রয়োজনের গুরুত্ব সমান হয় না, ধরুন আপনার রোগীর অস্ত্রোপচার তিন-চার দিন পরে হবে, তার জন্য আপনি এক বা দুই ইউনিট রক্ত নিয়ে চলে গেলেন এবং সেটা চিকিৎসা কেন্দ্রে জমা হয়ে গেলো। আর, আপনার রক্ত সংগ্রহের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পথদুর্ঘটনায় পড়ে প্রবল রক্তক্ষরণ হওয়া কোনো মানুষের জন্য সেই একই গ্রুপের দুই বা তিন ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হলো। তখন রক্তের অভাবে সেই রোগীর মৃত্যু ঘটতেই পারে। যেখানে, পরের বা তার পরের দিন হয়ত কোনো রক্তদান শিবির থেকে রক্ত এলো এবং আপনি তারপরে রক্ত নিয়ে রাখলেন; সেখানে সেই মানুষটির সাথে আপনার রোগী – দুই জনের রক্তের প্রয়োজন মিটে গেলো।
কাজেই, ব্লাড ব্যাঙ্ক অনেক সময়ে নিজস্ব বাধ্যবাধকতা থেকেই রক্ত থাকলেও “রক্ত নেই” বা “এখান থেকে রক্ত দেওয়া যাবে না” – বলে জানাতে বাধ্য হয়।
ইমিউনোহেমাটোলজিস্ট ডা ঋতম চক্রবর্তীর সহায়তায় লিখিত।
(চলবে)