আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোটাই গোলমেলে। একদল মানুষ প্রচুর পয়সা খরচ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখান- প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, অথচ তাঁদের তেমন রোগ নেই। আরেকদল মানুষের রোগ আছে, অথচ পয়সা নেই বলে ডাক্তার দেখাতে পারেন না। তাঁরা এক বেলার কাজ কামাই করে সরকারি হাসপাতালে ভিড়ে ঠেসাঠেসি আউটডোরে লাইন দেন, প্যারাসিটামল, ফ্যামোটিডিন আর বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
সহজে ডাক্তার না দেখাতে পারা রোগীর সংখ্যাই বেশি। তাঁরা ফেসবুকে নিজেদের দুঃখ দুর্দশার কথা লিখতে পারেন না। স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে রাস্তায় মিছিল করতে পারেন না। দুবেলা পেটের ভাত জোগাড় করতেই দিনের দশ থেকে বারো ঘণ্টা কেটে যায়।
তবে তাঁদেরও রোগ হয় এবং একটু বেশিই হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম প্রথম তাঁরা রোগকে পাত্তা দেন না। রোগ যখন জাঁকিয়ে বসে পাত্তা দিতে বাধ্য করায়, তখনও তাঁরা ডাক্তারের চেম্বারের ধারে কাছে ঘেঁষেন না। বিভিন্ন বিকল্প চিকিৎসার দিকে ঝোঁকেন। রোগ অথবা সেই বিকল্প চিকিৎসা যখন প্রায় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে তখন তাঁরা আমাদের মতো খুপরি-জীবীদের কাছে আসেন।
কতো অদ্ভুত বিকল্প চিকিৎসা যে আমাদের রোজ দেখতে হয় বলে শেষ করা যাবেনা। তাঁর মধ্যে অন্যতম মারাত্মক হলো বাতের চিকিৎসা। রোজই খুপরিতে একাধিক রোগী আসেন, যারা একেবারে ফুলে ঢোল হয়ে গেছেন। তাঁরা হাঁটু ব্যথা বা কোমরের ব্যথার জন্য তথাকথিত আয়ুর্বেদিক ওষুধ খাচ্ছেন। এই ওষুধের বৈশিষ্ট্য হলো প্রথম দিকে ব্যথা ম্যাজিকের মতো কমে যায়। কিন্তু কয়েকমাস পর থেকেই ব্যথা আবার বাড়তে থাকে আর রোগীর পা, মুখ ফুলতে আরম্ভ করে। মুখ ফুলতে ফুলতে পুরো চাঁদের মতো গোল হয়ে যায়। রোগী এই পর্যায়ে বুঝতে পারেন ওই ওষুধ খেয়েই তাঁর এমন হচ্ছে। কিন্তু তিনি চাওয়া সত্ত্বেও ওষুধ বন্ধ করতে পারেন না। ওষুধ বন্ধ করলে ব্যথা ভয়ানক বেড়ে যায়,খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং রোগী একেবারে আক্ষরিক অর্থেই বিছানায় পরে যান।
এই ওষুধগুলোয় স্টেরয়েড থাকে, দীর্ঘদিন খেলে যার খপ্পর থেকে বাঁচা মুশকিল। আরও মুশকিল হলো এই সব রোগীর কাছে নুন্যতম পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মতো অর্থ থাকে না- সিরাম কর্টিসল লেভেল টেভেল করানো তো অনেক বড় ব্যাপার। বিভিন্ন রেল স্টেশনে দেখেছি বাতের আয়ুর্বেদিক ওষুধ বলে একটা কালো গুঁড়ো বিক্রি হচ্ছে। এই কালো গুঁড়ো খেয়েও বহু মানুষকে ফুলে যেতে দেখেছি। রেল স্টেশনে এইসব ওষুধের বিক্রেতাকে বারণ করতে গিয়ে শুনেছি, ‘আমরা তো আর জোর করে কাউকে খাওয়াচ্ছি না। যারা উপকার পাচ্ছেন, তাঁরাই ফিরে আসছেন। তাঁরা অন্য মানুষদের বলছেন। ডাক্তারের কাছে গেলেই তো একগাদা রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে, এক্সরে করাতে হবে, এমনকি এমআরআই করাতে হবে। এতো টাকা গরীব মানুষেরা পাবে কোথায়?’
‘তা বলে আপনারা মানুষকে বিষাক্ত জিনিস খাওয়াবেন?’ এই প্রশ্ন তোলায় বিক্রেতা প্রায় মারমুখী হয়ে বলেছেন, ‘এই সব ওষুধ গাছ গাছড়া থেকে তৈরি, তাই বিষাক্ত হতেই পারেনা। বরঞ্চ অ্যালোপ্যাথি সব ওষুধেই কেমিক্যাল থাকে। আর কেমিক্যাল মানেই বিষ।‘
এই নিয়ে জমিয়ে তর্ক করা যেত। বিষাক্ত উদ্ভিদের দীর্ঘ তালিকা পেশ করা যেত। আমাদের আশেপাশেই অসংখ্য গাছ পালা আছে যারা নেহাত সহজ সরল নয়। কুঁচ, আকন্দ, রক্তকরবী, ধুতুরা, কলকে – যাদের বীজ বা ফল মৃত্যুও ঘটাতে পারে। বিশ্বাস না করলে ভদ্রলোকের গায়ে সামান্য বিচুটি পাতা ঘষে দিলেও হতো। কিন্তু তাঁর মারমুখী মেজাজ দেখে সাহস পেলাম না। আমি নেহাতই ভীতু একজন খুপরি-জীবী ডাক্তার। যাবতীয় ঝামেলা থেকে শত হাত দূরে থাকতে পছন্দ করি।
সুগার- প্রেশারের রোগীদের হামেশাই বিকল্প চিকিৎসার খপ্পরে পরে সর্বনাশ ঘটতে দেখেছি। সুগারের রোগী সব ওষুধ বন্ধ করে এক বছর ধরে শুধু আমলা জুস খেয়ে অন্ধ হয়ে গেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই আমলা জুসেরও কিন্তু দাম নেহাত কম নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের জন-ঔষধির দোকান থেকে ওষুধ কিনলে আমলা জুসের থেকে কম খরচেই হয়ে যেত। অর্থাৎ সমস্যাটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সমস্যা অজ্ঞানতারও। নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণার খুব অভাব, তাঁদের সার্বিক শিক্ষার অবস্থাও খুব ভালো নয়।
তবে শুধু গরীবদের দায়ী করেও লাভ নেই। উচ্চ শিক্ষিতরাও মাঝে মাঝে এমন সব চিকিৎসা বিভ্রাট ঘটান যা বিশ্বাস করা মুশকিল। বাতের আঙটি, পাইলসের আঙটি হামেশাই শিক্ষিত লোকদের আঙুলে দেখা যায়। এক স্কুল শিক্ষক দেখাতে এসেছেন। তিনি সবে বিয়ে করেছেন, লজ্জাবনত মুখে জানালেন পেনিসের মুখে ঘা হয়েছে।
পরীক্ষা করে চমকে গেলাম। বিচ্ছিরি ঘা। বললাম, ‘কতো দিনের ঘা? এতো বাড়াবাড়ি হলো কী করে?’
তিনি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে জানালেন, দু-সপ্তাহ ধরে হচ্ছে। প্রথমে অল্প ছিল। তিনি গত চারদিন ধরে বোরোলীন গরম করে লাগাচ্ছেন। তাতেই এই অবস্থা হয়েছে।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় তিনি হাই স্কুলের কেমিস্ট্রির শিক্ষক। শুধু বোরোলীন লাগালে তাও মেনে নিতাম, কিন্তু কেমিস্ট্রির শিক্ষক হয়ে বোরোলীন গরম করে ঠিক কী রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে গেছিলেন, আজও আমার বোধগম্য হয়নি। ভদ্রলোকের র্যান্ডম সুগার পাওয়া গেল সাড়ে তিনশোর বেশি।
আসলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া আর বিজ্ঞান মনস্কতা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। না হলে আমাদের দেশে জ্যোতিষীরা চারপাশে ঝকঝকে চেম্বার খুলে পাঁচশো টাকা ভিজিট নিয়ে লোক ঠকাতে পারতেন না। তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত মানুষেরা যান না।
ইদানীং তন্ত্র মন্ত্রও রোগ সারাতে নতুন করে ভূমিকা নিচ্ছে। পায়ের বা অন্য জায়গার ঘা সারাতে মন্ত্রপূত সত্যিকারের চুলের গোছা লোকজন পায়ে বেঁধে ডাক্তার দেখাতে আসছেন। টেবিলে কাঁচি রেখে দিয়েছি। আগে রোগী নিজ হাতে ওই চুলের গোছা বা কালো কার যা আছে কাটুন, তারপর ওষুধপত্র লেখা হবে। খুপরির বাইরে গিয়ে আবার বেঁধে নিচ্ছে কিনা জানিনা।
আসলে সমস্যা হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসার মধ্যেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। খরচের ব্যাপারটা বাদ দিলেও অনেক সাধারণ অসুখেও সহজে রোগীকে স্বস্তি দেওয়া যায় না। যেমন হাঁটু বা কোমরের ব্যথার রোগীরা একগাদা ওষুধ খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন- ব্যথাও দ্রুত কমেনা। তাঁরা বিকল্পের দিকে ঝোঁকেন। কারণ সেখানে একদল মানুষ ম্যাজিশিয়ানের মতো কম খরচে রোগ মুক্তির গ্যারান্টি দেন। আর মানুষ ম্যাজিক বড়ো ভালোবাসে।