“নিভন্ত এই চুল্লীতে মা
একটু আগুন দে,
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে”….
বাঁচতে চেয়েছিল অবন্তিকা…মনের ঘূর্ণাবর্তে খুঁজে ফিরেছিল শান্তির পথ….৭০ শতাংশ ঝলসে যাওয়া শরীরে, অসংখ্য তার, নলের জঙ্গল আর ক্রিটিক্যাল কেয়ারের নানা রকম শব্দের মধ্যে, অস্ফুটে শোনা যেত অবন্তিকার আর একটু বেঁচে থাকার আকুতি। ১৫ দিনের দীর্ঘ লড়াইয়ের, প্রতিটি মুহূর্তে, পিজির চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা, আচ্ছন্ন অবন্তিকার কানে অবিরত শুনিয়ে গেছে জীবনের গান….. তোকে বাঁচতে হবে অবন্তিকা, তোকে ফিরতে হবে জীবনের উৎসবে…পরম স্নেহে হাত ধরে তুলে বসিয়েছে,খাইয়েছে। ঝলসে যাওয়া শরীরটায়, পালকের আলতো ছোঁয়ায় লাগিয়ে দিয়েছে উপশমের মলম। জানতো চিকিৎসকরা। জানতো স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ এক অসম্ভব অসম লড়াই। তাও তারা ছিল ক্লান্তিহীন। দিনরাত এক করে অবন্তিকাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল নতুন সকাল।
সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে অবন্তিকার চলে যাওয়া গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়ে গেল সমাজ, সভ্যতার বুকে। আমরা ফিরিয়ে দিতে পারিনি ৮ বছরের অটিস্টিক অবোধ শিশুর মাকে। আমরা ফেরাতে পারিনি অবন্তিকাকে জীবনের উৎসবে। অবন্তিকা অনন্ত শান্তির দেশে। তবে এই দুঃসহ মৃত্যু “নিভন্ত চুল্লিতে আগুন ফেলে গেল”। যে আগুন দাবানল হয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারে শাসকের রক্তচক্ষু।
শাসকেরা বলছে অবন্তিকার মন ভালো ছিল না। যারা বলছে তারা মিথ্যে বলছে এমন নয়। ওর মন সত্যিই ভালো ছিল না। দু তিন বছরে হারিয়েছে মাকে। হারিয়েছে বাবাকে। ঘরে ৮ বছরের অটিস্টিক অবোধ অন্তজা। মন তো ভালো থাকার কথা নয়। মনের কি দোষ? সূর্য্য ওঠা আর অস্ত যাওয়ার মত, মন কি কোনো নিয়ম নীতি মানে? মনোবিদের আশ্রয়ে ছিল। শাসকের অভিযোগ জীবনের লড়াই ছেড়ে আগেও চলে যেতে চেয়েছিল অবন্তিকা। তাই এই মৃত্যুর আলাদা মর্যাদা প্রাপ্য নয়। যারা আলাদা মর্যাদা দিতে চান না, তাদের কাছে অনুরোধ রইলো একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। ৮ বছর মেদিনিপুরের চাকরি জীবনে অবন্তিকাকে কিভাবে আগলে রেখেছিল ওর বিভাগীয় প্রধান, সহকর্মী, বন্ধু, সাথীরা।
সহযোগিতা, সহমর্মিতায় অবন্তিকার উথাল পাতাল মনকে শান্ত সরল রেখায় রাখতে কিভাবে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছে ওরা। তাইতো সে ছিল ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ম্যাডাম, যুক্ত ছিল অসংখ্য গবেষণায়। শাসক, প্রশাসক কিন্তু জানতো অবন্তিকার মন ভালো নেই। জানতো চূড়ান্ত পারিবারিক ঘূর্ণাবর্তে আটকে আছে ওর জীবন। জানার পরেও এই দুঃসহ, হৃদয় বিদারক মৃত্যুর দায় কি এড়াতে পারবে প্রশাসন? মনের রুগী বলে কি ঝেড়ে ফেলা যায় এই মৃত্যু দায়। পারবো আমরা আমাদের পরিবার পরিজন, সন্তানের মন ভালো না থাকলে অবহেলা করতে? বরঞ্চ ওদেরই তো প্রয়োজন একটু বেশি খেয়াল রাখার। যে আগেও কয়েক বার লড়াই ছাড়তে চেয়েছে, আমরা কি পারি তার ছেড়ে যাওয়ার পথটা মসৃন করতে? লড়াইয়ে ফিরতে অবন্তিকা চেয়েছিল তার অটিজমে আক্রান্ত সন্তানের কাছে ফিরে আসতে। তাও ৮ বছর পর। যে শাসকেরা সন্তান সন্ততিকে ছেড়ে কয়েক ঘন্টার জন্যে দিল্লি যেতে অপারগ, তারাই ১০০ কিলোমিটারের পরিবর্তে ৪০ কিলোমিটারের দূরত্বের যুক্তির জাল তৈরি করে বোঝাতে চাইছেন তারা দারুন মানবিক। বোঝাতে চাইছেন যা হয়েছে সরকারি চাকরির নিয়মে হয়েছে। প্রয়োজনে সরকার যেখানে খুশি পাঠাতে পারে। নিশ্চই পারেন। যারা সরকারি চাকরি করেন, তারাও জানেন, সরকারের সেই অধিকার আছে। কিন্তু নিয়মটা সকলের জন্যে এক নয় কেন? যারা শাসকের কাছাকাছি থাকবে তাদের জন্যে এক নিয়ম আর যারা থাকবে না তাদের জন্যে অন্য নিয়ম হবে কেন? সরকার কি শুধু অনুগতের? কেউ কেউ শাসকের আনুগত্যে বছরের পর পর বছর, বদলি না হয়ে বাড়ির কাছে থাকার সুবিধা পাবে আর অন্যদের জন্যে বরাদ্দ হবে মানচিত্রের প্রান্তিক জায়গা? শাসকের আনুগত্য না থাকলে, একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৮/১০বছর কাজ করার পর আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি এখন ব্যতিক্রম নয়…নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর শাসক বদলির ভয় দেখানোকেই আনুগত্য আদায়ের একমাত্র পথ করে নিয়েছে। সরকারি চাকরির নিয়মের সঙ্গে বদলি নীতি গুলিয়ে দিতে চাইছে প্ৰশাসন। প্রশাসন যদি সংবেদনশীল হয় তাহলে এতো প্রতিহিংসা, দুর্নীতি, স্বজন পোষণের অভিযোগ কেন?
জীবনের লড়াইয়ে ফিরতে চেয়ে অবন্তিকা চেয়েছিল শাসকের মানবিক মুখ, সহমর্মিতা। মেনে নিতে পারেনি অন্যায়। মেনে নিতে পারেনি একটা প্রান্তিক জেলা থেকে, একই পোস্টে, আবার একটা প্রান্তিক জেলায় বদলি। আর নিতে না পেরে, অনন্ত শান্তির পথে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছে ” Why me-কেন আমি”
অবন্তিকার প্ৰশ্ন জন্ম দিয়ে গেল হাজারো প্রশ্নের। উস্কে দিয়ে গেল অন্যায়ের ধারাবাহিক ইতিহাস। যে ইতিহাসের পথে চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত সাসপেন্ড ছিলেন প্রখ্যাত নিউরোসার্জেন ডাঃ শ্যামাপদ গড়াই। প্রায় ৮ বছর। তার দোষ ছিল সর্বোচ্চ প্রশাসককে বলেছিলেন এত ভিড়ে কথা বলা যাচ্ছে না। চলুন ভেতরে গিয়ে কথা বলি। অনেকগুলো অপারেশন রাখা ছিল, তাই পরের দিন দেখা করার অনুমতি চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন। মানবিক!! প্রশাসন মানতে পারেনি সেই অনুরোধ এবং অনুরোধ করার সাহস দেখানোর অপরাধে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। শোনা গেছে কোনো চার্জশিট জমা পড়েনি। দেশের আইনে খুন করেও অভিযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়। কিন্তু যেখানে বেনিয়মটাই নিয়ম সেখানে ডাঃ গড়াই এই সুযোগ পাবেন সেটা আশা করা বৃথা।
ডেঙ্গুর ভয়ঙ্কর ছোবলে কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যখন কাঁপছে। অজানা জ্বরের!! সরকারি তকমা নিয়ে,উপচে পড়া রুগীর চাপে, ঠিক মত পরিষেবা দিতে না পারার গভীর মানসিক যন্ত্রণার কথা, সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে সাসপেন্ড হয়েছিলেন ডাঃ অরুণাচল। অবশ্য তাকে চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত সাসপেন্ড হয়ে থাকতে হয়নি। কিছুটা হলেও ভাগ্যবান!!! ডাঃ গড়াইয়ের থেকে। অবসরের ৬ মাস আগে, শেষ হয়েছিল তার শাস্তির মেয়াদ এবং মানবিক!!! প্রশাসনের আদেশনামায়, বৃদ্ধ, অসুস্থ বাবা মাকে রেখে, তাঁকে যেতে হয়েছিল সুদূর পাহাড়ে। বাকি থাকা চাকরি করতে। সরকার ইচ্ছে করলেই পারতো যেখানে ছিলেন সেখানে ফিরিয়ে দিতে। নিদেন পক্ষে কাছাকাছি। কিন্তু সরকারের নিজস্ব বদলির অভিধানে পরিবার, সন্তান সন্ততি, ব্যক্তিগত সমস্যা, অসুস্থতার কথা, লেখা নেই। সেখানে একটাই বিচার্য, আপনি অনুগত কিনা।
ডাঃ কাঞ্চন মন্ডল যখন পিজি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ারে গভীর কোমায়, তখন স্বাস্থ্য ভবনের সময় হয়েছিল মেডিক্যাল টিম পাঠানোর, তার স্বেচ্ছা অবসরের আবেদন, কতটা যুক্তিযুক্ত বিচারের জন্যে। অবশ্য ডাঃ মণ্ডল পরের দিনই মরে প্রমাণ করেছিলেন তার আবেদনের যথার্থতা।
অধিকারের প্রশ্নে পথে নেবে, সুদূর উত্তরে বদলি হয়েছিলেন সরকারি কর্মচারী সংগঠনের একঝাঁক নেতৃত্ব। সরকার বলছিল রুটিন বদলি। কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও ফিরে আসার কোনো আদেশনামাতেই দেখা যায় না ওনাদের নাম। অবসরের আগে, পারিবারিক জীবনে তাদের ফেরার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না। কারণ শাসকের অনুগতর তালিকায় ওনাদের নাম নেই।
মাত্র ১০ হাজার টাকা মাইনের কিছু অস্থায়ী শিক্ষক স্থায়ীকরণের দাবি করেছিল। সরকারের দরজায় দরজায় ঘুরেছে, দিনের পর দিন, ঝড় জল উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে, শাসকের মানবিক মুখ দেখতে চেয়েছিল। শিক্ষকের মর্যাদা চেয়েছিল। অস্থায়ী চাকরিতে বদলি না থাকলেও, সরকারি কর্মীর মর্যাদা!! দিয়ে কাউকে কাউকে পাঠানো হলো দক্ষিণের নন্দীগ্রাম, শালবনি থেকে উত্তরের পাহাড়ের চূড়ায়। প্রশ্ন তাই উঠবেই ওদের নিয়োগপত্রেও কি লেখা ছিল, প্রয়োজনে সরকার যেখানে খুশি বদলি করতে পারবে?
১০ হাজার টাকা মাইনেতে, সুদূর পাহাড়ে চাকরি করে,পরিবারের পেটের আগুন দূর অস্ত, নিজের পেটের আগুনই নিভবে না বুঝে, পাঁচজন শিক্ষিকা বিষ খেয়ে, পেটের আগুন চিরতরে নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল। শান্তির দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সরকার অবশ্য বলে দিয়েছে এসব নাটক বাজি। সাম্প্রতিক ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই পাওয়া যাবে এরকম অন্যায় অবিচারের অসংখ্য কাহিনী।
অবন্তিকার দুঃসহ মৃত্যু, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নিয়োগ, বদলি, প্রমোশনে শাসকের, বিশেষত স্বাস্থ্য প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বজনপোষণ। তরতাজা একজন চিকিৎসককে এভাবে চলে যেতে হবে ভাবাই যায় না। স্বাস্থ্য প্ৰশাসন দায় এড়াতে পারবে ওর মন ভালো ছিল না বলে? স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি রসাতলে যেত ওকে কলকাতায় ফেরালে? স্বাস্থ্য প্রশাসন কি খোঁজ রাখে অবন্তিকার মতো,কত অসংখ্য চিকিৎসক,স্বাস্থ্যকর্মীর মনে একই রকম ঘূর্ণাবর্ত চলছে? ৮ বছর একটা প্রান্তিক জায়গায় কাজ করার পর কেন তাকে যেতে হবে আর একটি প্ৰান্তিক জায়গায়? কেন শোনা হলোনা তার চূড়ান্ত পারিবারিক সমস্যার কথা? কেন শোনা হয়নি তার মনের অস্থিরতার কথা? কেন শোনা হয়নি তার সন্তানের কথা? সরকারি চাকরি করলে কি মানুষ পরিচয় শেষ হয়ে যায়?
অতীতে চিকিৎসকদের বদলি একটা নিয়ম মেনেই হতো। জোন ভাগ ছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করে নির্দিষ্ট সময়ে একজন চিকিৎসক তার নিজের জেলায় ফিরতে পারতেন। ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ছিলনা এমন নয়, তবে এখন ব্যতিক্রমই নিয়ম। নীতিহীন নিয়ম। কোনো কোনো চিকিৎসককে বছরের পর বছর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফেলে রাখা হয়েছে, আবার বহু বছর ফেলে রাখার পর, এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাঠানো হচ্ছে আর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যা খবরে আসছে তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। অন্যায়ের পাথর জমতে জমতে পাহাড় হয়ে আছে। প্রশাসনকে অনুরোধ চোখের ঠুলি সরিয়ে দেখুন….. স্বেচ্ছাচার, স্বজনপোষণে কতজন চিকিৎসক চাকরি ছেড়ে গেছেন, কতজন বসে গেছেন আর কতজন স্বেচ্ছা অবসরের আবেদন করেছেন। তবে ভাববেন না এই মৌরসি পাট্টা চলতেই থাকবে। আপনাদের মত সবাই কিন্তু খাটের তলায় শিরদাঁড়া খুঁজে বেড়ায় না।
ভালো লেখা।