ভগবান অনেক ওপরে থাকেন। তা’ ছাড়া বলতে নেই তাঁর বয়েসও হল অনেক। আর স্বর্গ-মর্তের মাঝের বাতাসটায় ঘোর দূষণ। তা সত্ত্বেও অসীমরঞ্জনের সীমাহীন সাহস তাঁর দৃষ্টি এড়াল না।
পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ সিদ্ধান্তের যে তিনটে পিলারের ওপর সৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে, তার যে কোনও একটা নড়বড়ে হলেই মুশকিল। এ তো দেখা যাচ্ছে দুটো পিলারই নড়ছে।
পরীক্ষা একরকমের ধার্য থাকছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ আলাদা রকম বলে সিদ্ধান্ত পালটে যাচ্ছে।
যেমন আজকেই হল। আজ অসীমরঞ্জনের দুপুরে খাবার পর পকেট ফাঁকা থাকার কথা। আর সেই ফাঁকা পকেট কেরানি সদর থেকে ফিরে আসবে ফাঁকা হাতে। অথচ তার ক্লাস টুতে পড়া মাতৃহীন সন্তান বিজু আজ সকালে অসীমের বেরোনোর সময় পইপই করে বলেছিল বিরিয়ানি আনতে।
বিজুর ক্লাসমেট সন্দীপনের জন্মদিন ছিল গত মাসে। ক্লাসের অনেকের নেমন্তন্ন ছিল। সবার না। যারা গিফট দিতে পারবে শুধু তাদেরই নেমন্তন্ন। বিজুর নাম লিস্টে থাকবে না বিজু নিজেও জানত।
পরের দিন যারা গেছিল তাদের জিজ্ঞেস না করতেও বিজুকে শোনাল তাদের কেউ কেউ। তাদের মুখে শুনল বিজু এলাহি ব্যাপার। বেলুন আলো গেমস হইচই আর একদম শেষে আইসক্রিম। আর সব চেয়ে বলার কথা যে’টি, তা’ হল বিরিয়ানি।
অপরূপ এই খাদ্যবস্তুটি সম্বন্ধে সেই শুনে থেকে তার বড় কৌতূহল। রঞ্জন ঋক সবাই বলেছে তাকে, সে নাকি গোলাপফুলের গন্ধ আর মাংসমশলার সুবাস মেশানো, এক অপূর্ব রসায়ন। বাবাকে বলতে হবে। বললে কী আর এনে দেবে না?
তাকে কিছুতেই কনিষ্ঠ কেরানি বাবার পকেটের অবস্থা বুঝিয়ে বলতে পারেনি অসীম।
সেই অনুযায়ী আজ সে বাড়ি ফেরার পর বাবার কাছে ওই বিশেষ খাদ্যবস্তুটি না পেয়ে অভিমানে সামনের রাস্তায় দৌড়ে যাবে আর তখনই একটা দ্রুত ধাবমান ট্রাক ওকে পিষে দেবে, এই রকমের ঘটনাবলী সাজিয়ে রাখার কথা ছিল।
এতসব কিছুই ঘটল না। ভগবান অবাক হয়ে দেখলেন, হাসিমুখ অবোধ মা হারা ছেলে বাবার গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে।
কী জিজ্ঞেস করছে, অত ওপর থেকে শোনা না গেলেও আমরা মর্তবাসীরা শুনতে পেলাম, – বাবা, দুপুরে কী খেয়েছ আজ?
– ওরে বাপ রে! সে বিশাল খাওয়া দাওয়া। সায়েবের যে জন্মদিন ছিল আজ। খেলাম তো বটেই, মেম সাহেব তোর জন্যেও পাঠিয়ে দিল এক প্যাকেট।
নিজে দুপুরে কিছু খায়নি অসীম। সেই বাঁচানো পয়সা আর সাহেবের পিওন নিখিলের কাছ থেকে টাকা ধার করে সব মিলিয়ে বিরিয়ানির ব্যবস্থা হয়েছে।
এই সব ছল চাতুরির ব্যাপার প্রতিদিনই ঘটে বাবা আর ছেলের সংসারে।
অসীমের বাড়ি থেকে তিন স্টেশন দূরে তার অফিস। বিজু ক্লাস টুতে পড়ে। এক বয়স্কা মহিলা মর্নিং স্কুলে নিয়ে যাওয়া থেকে বিকেলে অসীমের ফেরা অবধি বিজুর দেখাশোনা করে। রান্নাবান্নাও সেই করে। অসীম আর বিজু দু’জনেই তাকে ডাকে বুড়িমা। খুবই ভঙ্গুর এক ব্যবস্থা। কিন্তু কী করা!
পাশের বাড়ি বীরেশ বাবুর। তাঁর স্ত্রীকে বিজু বলে জেম্মা। মহিলাকে বলা আছে অসীমের। “বৌদি, খুব সমস্যার কিছু খবর পেলে বাচ্চাটাকে একটু দেখবেন”।
প্রতিবেশী বীরেশদা’ বোঝায়, “অসীম, বয়েস তো তেমন কিছু না, খোকাকে একটা মা এনে দাও দিকি!”
“না, বীরেশদা’, ওই কাজ করতে বলবেন না। আমি তো জানি, সৎ মা কী জিনিস!”
ঘটনা সত্যি। অসীম সত্যিই জানে। তার নিজের বাবাই এই অজুহাতে অসীমের মা মরে যাবার পরে আবার বিয়ে করেছিলেন। সেই থেকে অসীম বাবার নতুন সংসারে একদম পরিত্যক্ত হয়ে গেছিল।
বাবাকে দোষ দেয় না অসীম। কিন্তু নতুন সংসার শুরু করে একদম জেরবার হয়ে গেছিল বাবা। আর পরপর কটা ভাইবোন হয়ে যেতে অবস্থা চিত্তির।
অবশ্য উলটো চিত্রও যে দেখেনি অসীম তা না। ওদের সঙ্গেই পড়ত মিলন বলে একজন। তারও সৎ মা ছিল। সেই মায়ের গর্ভে এক ছেলে, মিলনের সৎ ভাই।
মা যে ওর গর্ভধারিণী মা ছিল না মিলন সেটা জানতই না। জেনেছিল অনেক বড় হয়ে। মিলনদের বাড়িতে যেত অসীম। কিচ্ছুটি বুঝতে পারত না মিলনের বন্ধুরা কেউই। অনেক পরে কলেজ পাশ করার পর সবাই জেনেছিল মিলনের এই কথা।
অনেকই পরে যখন আবার দেখা হল, মিলন তখন ছোট একটা চাকরি করে। ওর ভাই বড় ইঞ্জিনিয়ার। শ্বশুরের কিনে দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকে। বউয়ের উৎপাতে নিজের মাকে কাছে রাখতে পারেনি ভাই।
মিলনের কাছেই ছিলেন সেই সৎ মা, মৃত্যু অবধি।
মিলন বলেছিল, “দ্যাখ অসীম, এই মাটা আমাকে কোনওদিন বুঝতে দেয়নি ও আমার নিজের মা না। সেই কোন একবছর বয়েস থেকে আমাকে আঁকড়ে রেখেছে। নিজের বুকে দুধ না থাকুক, সেই শুকনো বোঁটাই আমাকে মুখে তুলে দিত, চেঁচামেচি করতাম যখন। আমি কেন ওই ভাইয়ের শ্বশুরকে বুঝতে দেব এর পেটে জন্মাইনি আমি?”
কিন্তু অসীম সাহস পায়নি। ওর বিজুর কোনও অযত্নের ঝুঁকি ও নিতে পারবে না। সেই বিপদে পা দিতে ওর ঘোর অনীহা।
★
অসীমের অসুখ করেছে। করতেই পারে। মা মরা বাচ্চা রয়েছে ঘরে এমন মানুষদের অসুখ করবে না এ’রকম কোনও নিয়ম নেই। বরং নিয়ম মতে একটু যত্নের অভাব আর দেখাশোনারও অভাব আছে বলে বেশি অসুখ করবে। খাওয়া দাওয়ারও অনিয়ম। অসীম সেই কারণে অন্যদের চেয়ে ইদানিং ভোগে বেশি।
এ’বারে হয়েছে জ্বর। থার্মোমিটারের পারা চড়চড় করে উঠে যায়। কখনও মাপতে গেলেই। অসীম অল্প হেসে বিজুকে বলে,”আর এট্টু জ্বর বাড়লেই ভেতরের পারাটা থার্মোমিটার ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে, বুঝলি? তখন আমার জ্বরটাকে বলব থার্মোমিটার ভাঙা জ্বর”।
হি হি করে হাসে বিজু।
তো সেই জ্বর গায়েই অফিস করছিল সে সে’দিন। অফিসেই প্রবল জ্বরে অজ্ঞান মতন হয়ে গেল।
শেষ অবধি তাকে হাসপাতালেই ভর্তি করতে হল। না, থার্মোমিটার ভাঙা জ্বরের জন্য না। ডাক্তারবাবু বললেন সন্দেহ হচ্ছে খারাপ কিছু। সেই জন্যে।
এই অজ্ঞান রোগীর সঙ্গে কেউ থাকার কথা। ভর্তির পর ওয়ার্ডে নিয়ে যেতেই সেই কথা বলল সিস্টার। পরিমল আর অন্যরা মানে অফিসের বন্ধুরা যারা নিয়ে গেছিল একে অন্যের মুখ দেখল। অপ্রস্তুত। কেউই তো রেডি হয়ে যায়নি।
এমনিতে, বিজুর সংসারের খবর ওরা জানে। তারা এখন অবধি জানে না ও’দিকের খবর কী। অসীমের বাচ্চাটা কার কাছে কী ভাবে থাকবে কে জানে।
ভাগ্যিস বীরেশ বাবুর নামটা জানত পরিমল। আর ফোন নাম্বারটাও পরিমল নিজের ফোনে কললিস্ট ঘেঁটে পেয়ে গেল। অসীমের নিজের ফোন নেই। কখনও খুব দরকারে পরিমলের ফোন থেকে ফোন করত ও বীরেশ বাবুকে। তাও সেই ছেলের ব্যাপারেই।
ওরা তড়িঘড়ি অজ্ঞান অসীমকে আনার সময় পকেট হাতড়ে চাবিটাবি যা পেয়েছে আর ওই ফোন নাম্বার বড়বাবু বিনায়ক সামন্তর হাতে দিয়ে বলে এসেছে, “বাবাটাতো চলল হাসপাতালে! এর বাচ্চাটার ব্যাপারে পাশের বাড়িতে একটা খবর দিয়ে দেবেন দাদা। দেখাশোনা করে যেন। আহা, বাচ্চা মানুষ!”
★
এই বড়বাবুটি অধস্তনদের বেশ এক দায়িত্বশীল অভিভাবক টাইপের। বহু সময়েই সে’টা টের পাওয়া গেছে। অফিসের সবাই জানে।
বড়বাবু তিন রকমের হয়।
এক রকম বড়বাবু হয় সন্ন্যাসী টাইপ। অনেক ঝঞ্ঝাট ঝামেলা সয়ে অফিসের বস হয়ে তারা মানসিক সন্ন্যাস গ্রহণ করে। সবাইকে কাজ ভাগ করে দেয়, যেমন দেওয়া হত প্রাচীন তপোবনে। কেউ গরু চড়াবে কেউ সমিধ আনবে, কেউ বা যজ্ঞ সাজাবে। কারও কাজ ঠিক মত না হলে পরম ঔদাস্যে সায়েবকে বলে তাকে সমঝে দেবে। আর নিজে অপেক্ষা করবে একমনে। কবে রিটায়ার্ড হয়ে মোক্ষলাভ করবে।
দু নম্বর টাইপএর বড়বাবু কুচুটে, সন্দেহ পরায়ন। সব সময়েই ভাবে অধস্তনরা তাকে ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টায় আছে। তাই সে সাবঅর্ডিনেটদের মধ্যে নিজের উদ্যোগে লবি তৈরি করে দেয়, যাতে তারা নিজেদের মধ্যেই চুলোচুলি করে। বড়বাবুর কথা খেয়াল না করে। এই কুচুটে বড়বাবুদের আবার ঘুষটুসের মত কুঅভ্যাস আর চরিত্র দোষের মত চুলকুনিও থাকে।
অসীমদের অফিসের বড়বাবু কিন্তু তিন নম্বর টাইপের। যেন একান্নবর্তী সংসারের বড়দা’। নিজে যখন নীচু পোস্টে ছিল সাত তাড়াতাড়ি অফিস আসত, দেরি করে ফিরত। বাড়িতে বউকে বলত, “আহা, বোঝো না কেন, কাজ শিখতে হবে না?”
বড়বাবু হবার পরও একই রুটিন। বাড়িতে বউকে বলে, “সব অকাজের ঢেঁকি। কাজ শেখাতে হচ্ছে তো সব কটাকে। তাইই দেরি!”
আর সেই ‘সব কটাকে’ পারলে প্রায় বুক দিয়ে আগলে রাখে বিনায়ক।
পরিমলের বাবার ক্যান্সার। বিনায়ক পিএফ থেকে টাকার ব্যবস্থা তো করলই, হেড অফিসের বেনেভোল্যান্ট ফান্ড থেকেও টাকা আদায় করে দিল সাহেবকে ধরে।
কী এক টিউমারে না কীসে, পেট ব্যথায় অবিনাশের মেয়েটা মরোমরো। একে তাকে ধরে অপারেশনের ব্যবস্থা করে দিল বিনায়ক। প্রাণে বাঁচল সেই মেয়েটা, যদিও ইউটেরাস না কী একটা যেন বাদ দিতে হল। বিয়ে না হওয়া মেয়েটার আর নাকি বাচ্চা কাচ্চা হবে না। সে না হোক। প্রাণে তো বাঁচল!
মেয়ের এই সব দুঃখ আর চাপ নিতে গিয়ে যখন অবিনাশ স্বয়ং নিজের নামের অমর্যাদা করে পট করে মরে গেল, পিতৃহারা অন্বেষা নামের যুবতী মেয়েটার কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরির ব্যবস্থা করল এই বিনায়কই।
করল শুধু না। চাকরি শুরু হবার আগেই সেই মেয়েকে শলা দিল। বড়বাবু বিনায়ক নেমন্তন্ন খাওয়ানোর অছিলায় বাড়িতে ডেকে নিজে তো বললই, বউকে দিয়েও বলাল, “শোন্ মা, অফিসে কাউকে আড্ডা ইয়ার্কি দিতে অ্যালাউ করবি না। নিজের মনে নিজের কাজ নিয়ে থাকবি।”
অক্ষরে অক্ষরে সে কথা মেনে সেই মেয়ে অফিসে পুরো বাঘিনী। অথচ অফিসের কাজে ওস্তাদ। সবার খবর রাখে। কিন্তু অফিস ফাঁকি দেওয়া আড্ডায় থাকে না মোটেই। গায়ে পড়া ছুঁকছুঁক কি বাজে ইয়ার্কিকে একদম পাত্তা দেয় না।
বিনায়ক এই রকমেরই।
অফিসের গর্ব, ব্যায়ামবীর বিশ্বনাথ, ম্যানিলা না কোথায় যেন কমপিটিশনে যাবে। তার ছুটি পাসপোর্ট ভিসা সব যেন একা বিনায়কের গর্ভ যন্ত্রণা। বিশ্বনাথ যাবে।
এই বিনায়ককে তাই অফিসের লোকজনেরাও ভালোবাসে খুব।
কিন্তু আমাদের এই গল্প তো অসীমের। বিনায়কের নয়। বড়বাবু বিনায়কের কথা থাক এখন।
★
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অসীমের জ্ঞান ফিরল অনেক পরে, গভীর রাত্রে। প্রথমে বুঝতেই পারল না সে কোথায়, কখন আর কেন। হাতে স্যালাইন নিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করতেই স্যালাইন স্ট্যান্ড উলটে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। সেই নাইট শিফটের রাত জাগা সিস্টার দৌড়ে এল গজগজ করতে করতে “ইস্, এই রকমের রুগীকে একা ফেলে যায় কেউ? আমাদের হাসপাতালে না আছে লোকজন, না এর বাড়ির কেউ রয়েছে।”
জ্বরের ঘোরে থাকা অসীম অবুঝ নয়। চারপাশে দেখে বুঝল সে অফিস থেকে কোথায় এসেছে। মন খুব ভারি। কেন? অনেক ভেবেও মনে পড়ল না, এই খুব দুশ্চিন্তাটা কাকে নিয়ে। আসলেই মাথা কাজ করছে না তার। করার কথাও না। এমনকি বিজুর কথাও মনে পড়ছে না তার।
জ্ঞান ফিরেছে মানেই জ্বর কমেছে তা তো নয়। শেষ রাতে আবার চেপে জ্বর এলো।
অসীম জ্বরের ঘোরে যেন বিজুকে দেখতে পায়। একগাল হেসে বলে,
“বুঝলি বাবা, থার্মোমিটার ভাঙা জ্বর হয়েছে আজ আমার!”
বিজু উত্তরে কী বলল শোনার আগেই আবার তলিয়ে গেল বেচারা।
ঠিক যেন নদীতে ভেসে যাওয়া কাঠের টুকরো। চেতনা কখনও ভাসে আবার কখনও ঢেউএর নীচে। গা পোড়ানো জ্বর চলতে থাকে।
অসীম টের পায়। মাঝে মধ্যে ডাক্তারবাবু আসে। যত্ন করে যন্ত্র দিয়ে বুক দেখে। পায়ের তলায় তীক্ষ্ণ শলা দিয়ে আঁচড় কাটে। পেট টেপে। আবার যমরাজাও আসে কখনও। ডাক্তার আর যমরাজ, দু’জনের ভাব খুব। তলিয়ে যেতে যেতে শোনে অসীম।
এই রকমের কথাবার্তা হয় তাদের,
যম- এই বারে তো একে ছাড়তে হয় হে ডাক্তার। এত জেদ কেন তোমার?
ডাক্তার- কী যে বলেন স্যার। আমি তো রাজি। এ ব্যাটাই যেতে চাচ্ছে না। আঁকড়ে ধরে আছে শরীরটাকে।
যম- যদ্দুর শুনেছি নাকি কারণও আছে, মানে ওর এই গোঁয়ার্তুমির।
ডাক্তার- সে কী, আপনার কথার ওপর গোঁ? এত সাহস?
যম- না হে, লোকটার বউটাকে আগেই তুলেছি বলে যত ফ্যাসাদ। নিজের ছোট্ট ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসে। ওকে একলা ফেলে রেখে কিছুতেই যেতে চাইছে না বোধ হয়।
ডাক্তার- তবে স্যার ছেড়েই দিন এ যাত্রায়। আমিও বাঁচি। ওর কিছু হলে, ওর অফিস কলিগদের দেখেছেন?
যম- কী বলো তো?
ডাক্তার- আজ্ঞে ওই পরিমল আর বিশ্বনাথ বলে দুই ছোকরা, রীতিমতো জিম করা চেহারা। ওর তেমন কিছু ঘটে গেলে এক ঘা ও মাটিতে পড়বে না!
সেই যে সিস্টার, প্রথমদিন বাড়ির লোক ছিল না বলে চেঁচামেচি করছিল, এসে যমকে দেখিয়ে ডাক্তারকে চোখ পাকিয়ে বলে, – কতবার বলেছি আজেবাজে লোকের সঙ্গে মিশবে না। তোমাকে মানায় না।
বিজু এর মধ্যেই এসে হাসিমুখে বলে, “বাবা দেখো আমি বড় হয়ে গেছি।”
এই সব যেন দেখতে শুনতে পায় অসীম।
এমনি ধারা যমের সঙ্গে ডাক্তারের কথোপকথন চলল দিন পনেরো। তারও পরে মাসখানেকের মাথায় ছুটি পেল অসীম। পরিমলরা খবর দিয়েছে, বিজু ভালো আছে। চিন্তার কিছু নেই।
মাথায় ওই সব আর কিছু ঢোকে না অসীমের। হাল্কা লাগে মাথাটা।
★
আগেকার দিন হলে হাসপাতালের গেটে ফুলমালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কলিগরা। যেন নেতা বেরোচ্ছে জেলখানা থেকে। দিনকাল পালটে গেছে। অসীম বেরোলো ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে।
তার চেহারা আঙুরের মত কোনও দিনই ছিল না। কিন্তু রোগে ভুগে চেহারাটি হয়েছে শুকনো কিসমিসের মত। অফিসের থেকে শুধু পরিমল এসেছে। খুব নাকি কাজের চাপ তাই অন্যেরা আসেনি।
বিজুকে নিয়ে এসেছে পরিমল। সে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে বাবার হাত ধরে বসেছে। ফিসফিস করে তাকে জিজ্ঞেস করল অসীম, ” হ্যাঁ বাবা, তুমি পাশের বাড়ির জেম্মাকে বেশি জ্বালাতন করোনি তো?”
মাথা নাড়ে বিজু। “একটুও বিরক্ত করিনি জেম্মাকে। তুমি মাকে জিজ্ঞেস কোরো!”
মায়ায় ভরে যায় অসীমের মন। আহা, মা হারা বাচ্চাটা কল্পনায় ভুলভাল কথা বলা শিখেছে কত।
গাড়ি গিয়ে থামে তাদের বাড়ির দরজায়। বিজু গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে, ওর রিনরিনে গলায় “মা, দ্যাখো বাবা এসেছে” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ভেতরে ঢুকে যায়।
অন্বেষা বলে সেই অফিসের সেই বাঘিনী মেয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে। একটু সরে দাঁড়িয়ে সে, অসীম আর তাকে ধরে থাকা পরিমলকে ভেতরে যাবার পথ করে দেয়।
ডুবন্ত অসীমের চোখের দিকে তাকিয়ে বাঘিনী বলে, “শুনুন, অসীমবাবু, দিব্যি তো ছেলেটাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। আমি কিন্তু সেইদিন থেকেই ওর মা। আপনি চাইলেও, না চাইলেও। বিনায়ক কাকুর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে।”
উদভ্রান্তের মত পরিমলের দিকে তাকাতে পরিমল হড়বড় করে বলে, “ওই জন্যেই তো বলছিলাম, অফিসে এখন কাজের চাপ প্রচুর। ওইটুকু অফিসে একসাথে দু’জন অ্যাবসেন্ট। তুমি আর অন্বেষা। বাড়বে না চাপ?”
অসীমকে হাসপাতালে ভর্তির দিনই অন্বেষার হাতে বাড়ির চাবি আর ঠিকানা ধরিয়ে বাচ্চাটার কথা বলে ইতিকর্তব্য বলে দিয়েছিল বড়বাবু বিনায়ক সামন্ত।
সেই অন্বেষা, যে কিনা নিজের পেটে বাচ্চা হবে না বলে সৎ-অসৎ কোনও মা-ই হতে পারবে না কোনওদিন।
আর অসীম?
সে এই রকম চেনা বাঘিনীর চোখে হরিণীর দৃষ্টি দেখে…
নাঃ সে কথা থাক। ও সুস্থ হয়ে উঠুক।