আজও একজনকে আবার গোবিন্দবাবুর গল্পটা বলতে হল। গত দশ বছরে অসংখ্যবার বলেছি; তবুও মনে হচ্ছে এবার একটু লিখেই ফেলি। আমাকে সাপ পাগল বলে যারা চিনেছেন, অনেকেই জানেন না, আমার “মনের মত পাগল” এই লোকটিকে। মনরোগ বিশেষজ্ঞরা বলবেন, তোমারও পাগলামি তোমার জিনের মধ্যে। কিন্তু ঐ বাউল গানটা আমার বড়প্রিয়। আমি তাইতো পাগল হলাম না, মনের মত পাগল পেলাম না। একথা হাটের মাঝে বলার বিপদও আছে। আমার এক অতি সজ্জন বন্ধুর পত্নী, আমার ঐ বদ উদ্দেশ্য টেরপেয়ে, বন্ধুকে আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য করেছে। ভালোই করেছে। বনের মোষ তাড়ানোর বদ নেশা থেকে নিজের লোকটিকে আটকে রাখতে তো সবাই চায়।
কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি দেখুন। এই আমার পাগলামীর গোড়াটা অনেকেই জানতে চায়। আসলে আমি নিজেও কি আর জানি যে বলব আপনাদের। যে মাটিতে দশ বছর ধরে একটা গাছ বাড়তে বাড়তে আজ এত বড় হল, সেই মাটি তৈরীর ইতিহাস আপনাদের তিন সপ্তাহ হল শোনাচ্ছি। এবার একেবারে বীজ ফেলা না হলেও, চারা লাগানোর গল্পটা বলি।
আমার হাবড়া হাসপাতাল থেকে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে বদলীর সরকারি আদেশ হাতে পেয়েছি। একেবারে হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। দৌড়ে এসেছি বারাসতের বড় অফিসে। এসে শুনলাম, সাহেব কোন মিটিংয়ে গেছেন, আসতে দেরী হবে। এই দেরীই একটা মানুষের জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে, এমন গল্প বহুু আছে। আমার জীবনে ঐ সাহেবের দেরী কি করে দিল বলি তাহলে। বসে আছি আপিসের বারান্দার বেঞ্চে। তখন তো আর হাতে এরকম একটা যন্ত্র ছিল না যে বসে বসে পড়বো বা লিখব। ব্যাগে ছিল একটা জার্নাল। জিমা, জুন ২০০৭। ওটার পাতা উল্টাতে গিয়ে এক সাহেবের লেখা একটা বড় নিবন্ধ পড়তে শুরু করলাম। গোটাটাই পড়ে শেষ করলাম, তারও পরে সাহেব এলেন। এই যে সাহেব এলেন, আর আমার ভালো খবরে খুব খুশী হয়েছেন জানালেন, এটার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই। কিন্তু পরের সাত আটমাসে ঐ সাহেবের পিছন পিছন ঘুরতে ঘুরতে একেবারে চুড়ান্ত হতাশ হয়ে যেতে হল। অথচ সাহেব যদি আমাকে মাস খানেকের ভেতরে ছেড়ে দিতেন, তাহলে আজ আমাকে সাপের কামড়ের পাগলা লোক বলে আর চিনত না।
ঐ যে বৃটিশ সাহেবের লেখা সাপের কামড়ের ওপর লেখাটা পড়লাম, তার আগের কুড়ি পঁচিশ বছরে এরকম ভালো আর সম্পূর্ণ লেখা আমি পড়িনি। সিএমওএইচ সাহেবের উৎসাহব্যাঞ্জক কথা শুনে, খুশি মনে বাড়ী ফিরলাম। ঐ খুশি কিন্তু উৎকন্ঠা আর হতাশায় পরিণত হল কয়েক মাসেই। একবার বিদায় ঘন্টা বেজে গেলে আর পুরনো জায়গায় কাজে মন বসে না। অথচ ঐ কয়েকমাসের মধ্যেই এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল যাতে আমার পরের অন্তত দশ বছরের জীবনধারা নির্দিষ্ট হয়ে গেল।
ডক্টর সিমসনের লেখাটা পড়ার পর থেকেই মনে হতে থাকল, এটা সব ডাক্তারেরই পড়া উচিত। কিন্তু আমি এখনও হলফ করে বলতে পারি, এ রাজ্যের হাজারে একজন ডাক্তারবাবুও ওটা পড়েননি। যাঁদের বাড়ীতে ঐ জিমা জার্নালটি নিয়মিত যায়, তাঁদেরও চারশ জনের একজন ওই নিবন্ধটি পড়েন নি। আমার কাছে ঐ জুন ২০০৭ এর জিমাটি অমূল্য ধনের মতো সংরক্ষিত আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ঐ জার্নালটি আমি ডাক্তারদের বসার ঘরের মেঝেতে গড়াতে দেখেছি।
ওসব বাজে কথা রেখে এবার আসল কথায় আসি। আমার কাছে ক্যানিং-এর একটি বিজ্ঞান সংগঠনের ক্যালেন্ডারের কিছু সাপের ছবি ছিল একসময়। তাও কয়েক বছর হল ছিঁড়ে যাওয়ায় দীনেশবাবুকে দিয়ে দিয়েছিলাম। কলকাতায় ওদের যে বাসাবাড়ী থেকে বছর পাঁচ সাত আগে ঐ ক্যালেন্ডার সংগ্রহ করেছিলাম, গিয়ে দেখি সে বাসা ওনারা ছেড়ে গেছেন অনেকদিন। সৌভাগ্যক্রমে দীনেশবাবুর কাছে ঐ ছেঁড়া ক্যালেনডারের ছবিগুলি পেয়ে গেলাম। স্ক্যানও নয়, একটা চার মেগা পিক্সেলের ডিজিটাল ক্যামেরায়,আমার ছেলে ছবিগুলি তুলে নিল। ঐ গোটা বারো ছবির সাথে, হাবড়া প্লাটফর্মের তাবিজ বেচা সাপুড়ের থেকে তোলা আর কয়েকটা ছবি নিয়ে একটাা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরী হল।
সুপার অফিসের কম্পিউটারে একজন “বড়” ডাক্তারকে দেখানোর চেষ্টা করলাম। উনি ওসব হাবিজাবি জিনিস দেখার জন্য দেড় মিনিটের বেশী সময় নষ্ট করলেন না। এরপর নাক কান গলার বিশেষজ্ঞ সার্জেন ম্যাডামকে দেখালাম। উনি একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলেন। জোর দিয়ে বললেন, এটা সকলকে দেখাতে হবে। একটা ক্লিনিক্যাল মিটিং করা হোক। ওনার উৎসাহেই কদিন পর একটা ক্লিনিক্যাল মিটিংয়ের আয়োজন করা হল। ঐ ৭ ই আগস্ট ২০০৭ দুপুরে, সকালের আউটডোর শেষ হলে,চোখের আউটডোরে করা হল সেই আলোচনা সভা। পাশের অশোকনগর হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদেরও ডাকা হল। আর নিমন্ত্রণ করা হল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল আসোসিয়েশের হাবড়া শাখাকে।
বিরিয়ানীর একটা প্যাকেট না থাকলে আবার ক্লিনিক্যাল মিটিং হয় নাকি! হবে, তাও হবে। একজন শুভানুধ্যায়ী চল্লিশ প্যাকেট বিরিয়ানীর ব্যবস্থা করলেন। অন্য আরেকজন প্রোজেক্টর ভাড়া করে দিলেন। তবুও আগের দিন পর্যন্ত যা হিসেব পাওয়া গেল, কুড়ি পঁচিশ জনের বেশী ডাক্তার হবেনা। তাহলে চল্লিশটা প্যাকেটের কি হবে? ডাকা হল সিস্টারদেরও। সিএমওএইচ স্যারকে ডাকা হলেও আসতে পারেন নি।
চোখের ডাক্তার সাপ-টাপ কি সব দেখাবে,এটাই একটা খবর। চেয়ারপার্সন তো একজন বড় ডাক্তারই হবেন। কিন্তু একজনের ওসব বাজে কাজের সময় নেই। অন্যজন আমাকে খোলাখুলি জানালেন, সাপ কামড়ের উনি প্রায় কিছুই জানেন না। ওসব চেয়ারম্যানট্যান বললে যাবেনই না। উনি ছিলেন।
চোখের প্যারামেডিক্যাল স্টাফ গোবিন্দবাবুকে সিস্টাররা চেপে ধরলেন আপনার চোখের ডাক্তারবাবু বলবে আর আপনি থাকবেন না, এ হয় নাকি। গোবিন্দ বাবু আবার বাইরের খাবার কিছু খান না, বিরিয়ানী তো নয়ই। তবুও দিদিদের চাপে গিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসে গেলেন। হল একটা ক্লিনিক্যাল মিটিং। আমি যে বছর ছয়েক ছিলাম, ঐ একটিই। পরে আর কোনদিন হয়েছে কি না জানি না।
গোবিন্দবাবু কি শুনলেন, কি বুঝলেন জানা হল না ঐ দিন। দু একজন ডাক্তারবাবু জানালেন, ভালোই হয়েছে। গোবিন্দবাবু রাত্রে ফোন করে জানালেন, ঐ ছবিটবিগুলো ওনার খুব কাজের মনে হয়েছে। একটা সিডিতে যদি তুলে দেওয়া হয়, তবে উনি লোকজনকে দেখাতে পারেন। আমি জানালাম, ওসব কেউ দেখবে না। মনে মনে গাইলাম মনসুর ফকিরের গান, “আমার সাঁই দরদীর কথা, কে বা শুনবে রে?”
দুদিন পর হাসপাতালে গোবিন্দবাবু আবারও বললেন। চোখের সর্বভারতীয় সংগঠনের দু একটা সিডি তখন আমরা দেখেছি। সার্জেন অপারেশন চলতে চলতেই প্রতিটা ধাপের বর্ণনা দিয়ে পড়াচ্ছেন। ওরকম করে আমাকেও সাপের বর্ণনা ইত্যাদি দিয়ে সিডি তৈরী করতে বললেন। ওরে বাবা, সে সব খুব বড়সড় ব্যাপার,আলাদা মেসিন টেসিন লাগে, এসব বলে এড়িয়ে গেলাম।
পনেরোই আগস্ট মাইল-দুই দুরের একটা স্কুলে মেডিক্যাল ক্যাম্প। আমাদের চোখের আউটডোরের ম্যানেজার দেবাশীষ, আমাদের একটা গাড়ী করে নিয়ে চলল। ঐ গাড়ীতেই গোবিন্দবাবু আমাকে একেবারে পেড়ে ফেললেন যাকে বলে। সেই সিডি তৈরী করুন। একসময় বললেন, কতো টাকার মেসিন? আমি আপনাকে পাঁচহাজার টাকা দিচ্ছি, কিনে নেন। এ লোকটা এতো গুরুত্ব দিচ্ছে ব্যাপারটাকে। এবার কিন্তু আমি ভাবনা চিন্তা শুরু করলাম।
বাড়ী ফিরে ছেলেকে বললাম ব্যাপারটা ও জানাল, একটা হেডফোন লাগবে, কথা রেকর্ড করতে। নিচের তলার রনিদার কাছ থেকে একটা হেডফোন এনে কয়েক মিনিটের চেষ্টায় কথা রেকর্ডের ব্যাপারটা বুঝে গেল। এবার আমার পাওয়ার পয়েন্ট ছবিগুলো নিয়ে চলল ওর এক্সপেরিমেন্ট। এক ঘন্টাও লাগেনি ওর নিজস্ব কায়দায় সিডি তৈরীর পদ্ধতি নির্ণয় করতে। তখন কিন্তু ছেলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। একশো বাষট্টি টাকা দিয়ে একটা হেডফোন কেনা হল। গোবিন্দবাবুকে জানালাম, হবে।
এরপর আমার গুঁতোগুঁতি চলল কদিন বাড়ীর কম্পিউটর নিয়ে। এদিকে মাঝে মাঝেই বড় অফিসে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে ফিরে আসা চলছেই।
এর মধ্যেই একটা দায়সারা গোছের সিডি তৈরী করে দিলাম। পরদিনই উনি এক ডজন ফাঁকা সিডি এনে বললেন, কপি করে দিতে হবে। আরে, কে দেখবে এসব? উনি জানালেন, ঐ প্রথম সিডি দেখে, ওনার প্রতিবেশী এক প্রফেসার খুব প্রসংশা করেছেন। কি আর করা! করলাম ডজন খানেক কপি। আমার পরিচিত দু একজনকেও দিলাম।
ঐ যে গোবিন্দবাবু সিডি কিনে বিতরণের একটা প্রথা চালু করলেন, আজও তা চলছে। উনি বোধ হয় শ’দুই সিডি এদিক-ওদিক দিয়েছেন। আমি? হাজার ছাড়িয়েছে হয়তো, হিসেব তো রাখি না।
এই একটি সিডি গোবিন্দবাবু, আমাকে না জানিয়েই,বড় সাহেবকে দিয়ে এলেন। আমাকে দেখলেই তখন সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। অক্টোবরের দু তারিখ একটা অনুষ্ঠানে সাহেবের সাথে দেখা। সিডি দেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করায় বললেন, ” ওটা তুই তৈরী করেছিস? দারুন হয়েছে। আমাদের সব ডাক্তারকে দেখাবো।” এমন উৎসাহ দিয়ে অধস্তন কর্মচারীকে ক’জন কথা বলেন? একটা দারুন উৎসাহ পেলাম ঐ একটা কথায়।
এবার গোবিন্দবাবু ধরলেন, বাংলায় করতে হবে। একটা একটা অক্ষর ধরে বাংলায় লেখা। তারপর আবার বাংলায় বলে রেকর্ড করা। প্রায় একশ ঘন্টা কাজ করে ওটাও তৈরী হল। একেবারে বাড়ী বসে তৈরী, আমার হস্তশিল্প।
এরপরতো একদিন অকল্পনীয় প্রচেষ্টায় ছাড়া পেয়ে কলকাতায় চলে এলাম। কিন্তু গোবিন্দবাবুর সাথে যোগাযোগটা থেকেই গেল। আমিতো পরে রাজ্য সরকারের সাপ কামড় বিষয়ক নানান কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে গেলাম। এমন কি কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ডাক পেলাম। গোবিন্দবাবু কিসের নেশায় মেতে আছেন? এ কাজের জন্য কোন রকম প্রশংসা কেউ করেনি। হাবড়া হাসপাতালের চোখের ডিপার্টমেন্টের অর্ধেক কাজ উনিই করতেন। একদিন অনুপস্থিত হওয়ার জন্য অপমানজনক ভাবে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। পঁয়ত্রিশ বছরের উপর চাকরী করেছেন। শেষদিকে দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে উঠে আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। কতো লোক শুধু ইউনিয়নের জোরে সারা জীবন বাড়ীর কাছে চাকরী করল দেখলাম। আমার কাজের খুব সুবিধা হয়, বলে এক বড় সাহেবকে সরাসরি অনুরোধ করলাম। অফিসে ডেকে, ঘন্টা দেড়েক বসিয়ে রেখে, সাহেব শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি সাপ ধরতে পারেন?”
গোবিন্দবাবু রিটায়ার করে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। আসলে আমাদের কাজটাকে “সাপুড়ের” কাজের থেকে বেশী মর্যাদা এখনও কেউ দেয় না। আমরা তো পারছি না ছেড়ে যেতে। একটা মানুষও সাপের কামড়ে মরলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
প্রতিটি কথা সত্য।