**************************
– তুই তো বললেই এক্ষুনি রেগে যাবি কিন্তু সত্যিটাকে অস্বীকার করবি কীভাবে?
সকাল সকাল দুই বন্ধু মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন। বন্ধু বলতে ডা. মিত্র আর তাঁর বাল্যবন্ধু আরণ্যক। আরণ্যক সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মর্নিং ওয়াক শেষে দুজনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন। আচমকা আরণ্যকের ঈষৎ শ্লেষ মিশ্রিত কথায় মৃদুল ভ্রু কুঁচকে তাকালো..
– আমি আবার কোন মহাভারতটি অশুদ্ধ করলাম?
– দ্যাখ, দ্যাখ শ্রেয়সী কী লিখেছে?
আরণ্যকের পরিবার বা বন্ধুদের প্রায় সবাইকেই মৃদুল চেনে। কিন্তু অনেক ভেবেও শ্রেয়সীর নাম মনে করতে পারলো না। হেসে বললো- শ্রেয়সী-টি কে ভাই? কোনোদিন সে ভদ্রমহিলার নাম শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না..
আরণ্যককে সামান্য বিব্রত দেখালো। কাঁধ নেড়ে জবাব দিল- ওরকম কেউ না.. আমার ফেসবুক বন্ধু। যাক গে, কী লিখেছে শোন..
মৃদুল জানে পরিচয় না থাকলে আরণ্যক ফেসবুকেও বন্ধু করে না। ফ্রেন্ডলিস্টে মেরে কেটে শ’তিনেক লোক। মৃদুল চোখ সরু করে বললো- বলেই ফেল। প্রাতঃকালে বন্ধুবরের ‘ওরকম কেউ নয়’-এর বাণী শ্রবণ করা যাক।
– ইয়ার্কি মারিস না। সিরিয়াস কথা বলছি। দ্যাখ কী লিখেছে.. শ্রেয়সীর জেঠিমার কোন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্ট্রোক হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিল। মারা যাওয়ার পরেও দশদিন ভেন্টিলেটরে রেখে টাকা শুষে গেছে। কী বলবি এগুলোকে?
– কী আবার? ‘সংগৃহীত’।
– ভাল্লাগছে না মৃদুল। আমি একটা সিরিয়াস কথা বলছি।
– আমিও সিরিয়াস ভাই। দ্যাখ, পোস্টের নিচে ‘সংগৃহীত’ লেখা। কাজেই এটা তোর ‘ওরকম কেউ নয়’ নিজে লেখে নি।
– তার মানে?
– মানে পরে বলছি। তার আগে তোর ধারণাটা কীরকম জেনে নিই। আচ্ছা, তুই ভেন্টিলেটর বলতে ঠিক কী বুঝিস?
– কী আবার? কেমন সব ইড়িং-বিড়িং মেশিন। রোগীর যমের ডাক এলে এই মেশিনে তুলে বাড়ির লোককে সর্বস্বান্ত করা হয়। এমনকি মারা যাওয়ার পরেও..
– হুঁ বুঝেছি। জানিস তো আরণ্যক, জীবনে কখনো কখনো একটু কম কথা বলার অভ্যেস রাখা উচিত। জ্ঞানই দিলাম ধরে নে। মানে, যেগুলো বুঝিস না..
– এসব মিথ্যে বলছিস?
– পৃথিবীতে আজ অব্দি এমন কোনও উপায় বের হয়নি যেভাবে মরা মানুষকে দশদিন ভেন্টিলেটরে রেখে দেওয়া যায়। আইসিইউ-র টেম্পারেচার কত হয় বল তো? মৃতদেহ পচতে শুরু করবে না? তোর ধারণা কী বলে? নাকি বলবি গন্ধ মাখিয়ে, গা-গরম করে আর ম্যাজিক মলম বুলিয়ে সব টাটকা রেখে দেওয়া হয়? এমনিতেই মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যে মৃতদেহ কাঠের মতো শক্ত হয়ে যায়।
– ওই তো লিখেছে বগলের তলায় ইঞ্জেকশন দিয়ে টাটকা রাখা হয়।
– হ্যাঁ রে.. ইঞ্জেকশনটার নাম গোবরামাইসিন। তোদের মতো শিক্ষিত লোকের বোধবুদ্ধিও এরকম হলে.. যাক, গল্পটা শুনেই নে।
– আবার গল্প?
– ভেন্টিলেটর ফুসফুসে হাওয়া ঢোকানোর মেশিন। যখন নিজের শ্বাস ভালোভাবে নিতে না পারে তখন বাইরে থেকে শ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। হাওয়ার চাপ, আয়তন, রোগীর নিজস্ব শ্বাস শুরু করার ক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের ভেন্টিলেশন করা হয়। তবে হ্যাঁ, মানুষটির বেঁচে থাকাটা জরুরি। মরা মানুষের ভেন্টিলেশন হয় না।
– এরকম ব্যাপার?
– ভেন্টিলেশন আজকের ব্যাপার ভাবিস না। বাইবেলের যুগেও এর উল্লেখ আছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের জেনেসিস ২:৭-এ লিখছে, “ঈশ্বর ধূলিকণা থেকে মানুষ সৃষ্টি করলেন। তারপর নাসারন্ধ্রে ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন জীবনের বায়ু” ২ কিংস ৪:৩৪ বলছে, “ঈশ্বর শিশুটির সামনে ঝুঁকলেন। তারপর মুখে মুখ লাগাতেই শিশুটি জীবনের উত্তাপ খুঁজে পেল।” খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতকে গ্রীক চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী গ্যালেন শ্বাসযন্ত্রের গঠন বর্ননা করেন। তিনি মনে করতেন, শরীরে রক্ত সংবহন বজায় রাখার জন্য শ্বাসবায়ু একান্ত প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, বাইরে থেকে বুকে হাওয়া ঢুকিয়ে জীবন বাঁচানো বহুদিন ধরে প্রচলিত। যদিও তার বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান প্রথম করেন বিজ্ঞানী ভেসেলিয়াস। প্রতিভাবান মানুষটি ২৩ বছর বয়সেই অ্যানাটমির প্রফেসর হয়ে মৃতদেহ কাটাছেঁড়া শুরু করেন এবং যথারীতি চার্চের বিষনজরে পড়েন। এই ধর্মীয় গোঁড়ামিগুলো সব যুগেই সত্যি জানিস তো.. ধর্মের দালালরা না থাকলে বিজ্ঞান আজ আরও কয়েক হাজার বছর এগিয়ে থাকতো।
– সেটা তুই ঠিকই বলেছিস..
– যাক গে, যা বলছিলাম.. ১৫৪৩ সালে ভেসেলিয়াস কুকুরের ওপর ভেন্টিলেশনের পরীক্ষা করেন। নিজস্ব পরীক্ষার ফলাফল নথিভুক্ত করে লেখেন, “শ্বাসনালীতে ফুটো করে ঘাসের তৈরি নল ঢুকিয়ে ফুঁ দিলে পশুটির বুক ফুলে ওঠে। মৃতপ্রায় পশুর শরীরে জীবন ফিরে আসে।” একইরকম পরীক্ষা করে ১৬৬৭ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট হুক সাফল্য পান। মাথায় রাখিস, সে সময় মানুষ সংবহন আর শ্বাসতন্ত্রের জটিল বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতো না। তাই মৃতপ্রায় লোককে তেলের পিপের ওপর গড়িয়ে, ছুটন্ত ঘোড়ার সাথে বেঁধে, পায়ে বেত্রাঘাত করে, মাথা নিচের দিকে করে ঝুলিয়ে, পায়ুদ্বারে ধোঁয়া দিয়ে জীবন ফেরানোর চেষ্টা করা হ’ত। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে তোর হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু এরকম অন্ধকার সময়েও কিছু মানুষ কালের চাকাটাকে জোর করে আলোর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
– ওরেব্বাস! বিশাল ব্যাপার তো..
– আজকের যে ভেন্টিলেটরগুলো দেখিস এগুলো সব বাইরে থেকে হাওয়া ঢোকানোর মেশিন। আগে কিন্তু এরকম ছিল না। বরং, উল্টোটাই করা হত। ভেতরে বায়ুশূন্যতা তৈরি করলে বুকের খাঁচা নিজের থেকেই ফুলে উঠতো আর হাওয়া চলে আসতো ভেতরে। সাধারণত লোহার খাঁচার মতো দেখতে হ’ত জিনিসগুলো। মাথা বাদে বাকি শরীর ভেতরে থাকতো। এতে বাদবাকি শরীরের যত্ন নিতে সমস্যা হচ্ছিল। পরে এমন ভেন্টিলেটর তৈরি করা হয় যা দেখতে পুরো ছোটোখাটো ঘরের মতো। এমনকি সার্জেন তার ভেতরে ঢুকে অপারেশনও করে ফেলতেন। এরকম ভেন্টিলেটরের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয় ১৯৩০-৬০ সালের পোলিও মহামারীর সময়। প্রফেসর ফিলিপ ড্রিঙ্কার ও লুই আগাসি শ এরকম ভেন্টিলেটরের সাহায্যে বহু শ্বাসযন্ত্র বিকল হওয়া পোলিও আক্রান্ত মানুষের প্রাণ বাঁচান। বস্টনের শিশু হাসপাতালে একসাথে চারটি শিশুকে রাখার মতোও লৌহ-ফুসফুস তৈরি করা হয়।
– আচ্ছা তুই বল, আমরা স্বাভাবিক শ্বাস নিলে তো বুকের মধ্যে ঋণাত্মক চাপ তৈরি হয়। তাহলে এরকম ভেন্টিলেটর-ই তো ভালো ছিল। হঠাৎ বাইরে থেকে হাওয়া দেওয়া শুরু হ’ল কেন?
– সমস্যা অনেক ছিল। প্রথমত, এত বড় একটা জিনিস দিয়ে একজনের প্রাণ বাঁচাতে গেলে গোটা দেশটাকেই হাসপাতাল বানিয়ে দিতে হ’ত। তাছাড়া ফুসফুসে প্রয়োজন মতো হাওয়া ঢোকানো যাচ্ছিল না। খাদ্য শ্বাসনালীতে ঢুকে যাওয়া রোধের কোনও উপায় ছিল না। আর দাম? তখনকার দিনে একটা আয়রন লাং-এর দামে ইউ ইয়র্কে তিনতলা বাড়ি কেনা যেত।
– তারপর?
– এদিকে বন্যার মতো ধেয়ে আসছে পোলিও অতিমারী। কোপেনহেগেনের ব্লেগডাম হাসপাতালে তখন প্রতিদিন জনা পঞ্চাশেক পোলিও রোগী ভর্তি হয় আর তাদের মধ্যে ৬-১২ জনের শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়। আর গোটা শহরের জন্য একটি আয়রন লাং বরাদ্দ। জরুরি মেডিক্যাল টিম মিটিং হ’ল। অনেক আলাপ আলোচনার শেষে উপায় বাতলে দিলেন অ্যানাস্থেশিওলজিস্ট ডা. বিয়ন ইবসেন। শ্বাসনালী ফুটো করে হাওয়া ভর্তি ব্যাগ পাম্প করতে শুরু করলেন মেডিক্যাল আর ডেন্টাল ছাত্ররা। পালা করে একটানা ৬ ঘন্টা। এই ৬ ঘন্টা মুখের কথা নয়। তোকে দিলে প্রত্যেক মিনিটে একবার করে ঘড়ি দেখবি। এইভাবে একটানা পাম্প করে ১২০ জন শিশুর জীবন বাঁচানো হয়। এখনো অনেক ভেন্টিলেটরহীন প্রান্তিক হাসপাতালে ডাক্তাররা এভাবেই রোগীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
– কিছু মনে করিস না ভাই। এত কিছু জানতাম না রে..
– এভাবে হবে না। শাস্তি হিসেবে রাতে কোথায় খাওয়াবি বল? সঙ্গে একটা পেন। দক্ষিণা। আর শোন, নার্সিং হোমের বিলগুলোতে ডাক্তারের ভাগে কত পড়ে দেখে নিস। কেউ কেউ ‘ইয়ে’ আছে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে গড়পড়তা বেচারারা.. বুঝিসই তো, ডাক্তার বসে বসে বিল বানায় না..
– কান ধরছি। মাফ কর ভাই..
হাসতে হাসতে বললো আরণ্যক- আসলে কী বলতো.. ভেন্টিলেটর নিয়ে এসব অপপ্রচার যারা করে তারা কেউ নিজের চোখে পেশেন্ট দেখে নি। সব জ্ঞানই ‘সংগৃহীত’।
– এই রে.. দেরি হয়ে গেল। অফিস বেরোতে হবে। চ, চ..
– আরে দাঁড়া, দাঁড়া.. গল্পগুলো ‘ওরকম কেউ নয়’-কেও জানিয়ে দিস..
বলেই হাসিতে ফেটে পড়লেন ডা. মৃদুল মিত্র।
লেখাটা পড়ে চমৎকৃত