সেটা ছিলো ফাগুন মাস। রংয়ের মাস। কিন্তু মা বাবা আমার জ্ঞানত কোনোদিন দোল খেলে নি। তখন দূরে একটা কোকিল ডাকছে। স্থান দিনহাটা। মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ, কুচবিহার, দিনহাটা। তখন আমি আরও অনেক ছোট্ট। মা তখন ওখানের ডাক্তার। বাবা ওখানে এসডিও। বাবা অফিসে। কী যেন কী কারণে মা সেদিন ঘরে। আমি মন দিয়ে কোকিলটাকে ভ্যাঙাচ্ছি। কোকিলটাও তারস্বরে সাড়া দিচ্ছে। দূরে একটা বাছুরকে তার মা চেটে চেটে পরিষ্কার করছে।
“ওম্মা ওটা কী করছে?”
“ওটা তো গরুটার বাচ্চা, তাই ওকে আদর করছে…”
“কই তুই তো আমায় ওভাবে আদর করিস না!” বহুদিন আমরা দুজনকে তুই তুই করতাম।
মা আমাকে বুকের মাঝে নিয়ে বললো “আমি যে তোকে বুকের মাঝে নিয়ে আদর করি…তুই যে আমার বুকের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছিস…”
বাছুরটাও তখন গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে গরুমা’র দুধ খাচ্ছিলো।
গল্প শুনতে শুনতে আমি মায়ের পেটের ওপরে উঠে বসে ছিলাম।
“নেমে বস। আমার পেটে ব্যথা….”
“কেন? ব্যথা কেন?”
“আমি যখন ডাক্তার হয়েছি তখনও সব কাজ করে তারপর হাসপাতালে যেতাম। তখন টাকার জন্য মাড়োয়াড়ি বাড়িতে ডেলিভারি করাতে যেতাম-বাড়িতে গিয়ে পেটের জল বার করতাম-একবার এ্যাতো জল জমেছিল যে পেটে ফুটো করতেই ছাদ পর্যন্ত জল ছিটকে উঠেছিল।তখন
খাওয়া হতো না তো। তাই খুব অসুখ করলো।পেটের ভেতরে টিবি।তারপর আমি সব ছেড়ে সিকিমের রাজার কাছে চাকরি নিলাম।সিকিমের প্রথম লেডি ডাক্তার। ওখানের পরিষ্কার বাতাসে আস্তে আস্তে আমার রোগ সেরে গেলো।”
আমি জানি সেই সময়ে আরও একজন গেছিলো সিকিমে (অন্যায় ভাবে ঐ দুজনের কিছু ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়েছি)। সদ্য পিতৃহারা হয়ে, সংসার চালানোর ঠ্যালায় পড়ে, রাস্তা মাপার কাজ নিয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে, সংসার চালাতে সিনেমা হলের ম্যানেজারি থেকে পার্ট টাইম টিচার.. এরও পাঁচ ভাই দুই বোন কিন্তু সব কিছু করেও সংসার আর চলে না। সেই ছেলেটা গেল সিকিম-রাস্তা জরীপের কাজ নিয়ে। ঘোড়ায় চেপে রাস্তা মাপা, রাস্তা তৈরি।তাঁবুতে রাত কাটিয়ে আবার পরের দিন ঘোড়ার পিঠে-হয়তো বরফের ভেতর দিয়ে-হয়তো কমলা বনের পাশ দিয়ে। সেই সময়ে একদিন গ্যাংটকে তার দেখা হলো মায়ের সঙ্গে। কবিতা বলা, বাঁশি বাজানো সেই শুধু হায়ার সেকেন্ডারি পাশ ছেলে। সেই মেয়ে তখন টিবি থেকে সেরে উঠে সিকিমে মেয়েদের ডাক্তার হিসেবে খুব নাম করছে (রাজার ছাপ দেওয়া সেই প্রশংসা পত্র আমি পড়েছি)।হয়তো গালে আবার লালচে রং ধরেছে। গালে না ধরলেও মনে তো রং ধরেই ছিলো।
পথে পাওয়া এক ভাই( নিতাইমামা) আর ভাইবৌ (অরুণামামী) করলো ঘটকালি। মনের রং পাকাপোক্ত হলো।
ক্রমশঃ