কেন লিখি? এই প্রশ্নের উত্তরে সাহিত্যিকদের বলতে শুনেছি “না লিখে থাকা যায় না যে”। আমার এই লেখাটিও যতোখানি লেখা,তার থেকেও অনেক বেশি না লিখে থাকতে না পারা। ছোটোবেলা থেকে যে মানুষটার লেখা প্রতিনিয়ত আমায় মানুষ করে চলেছে তার নাম রবীন্দ্রনাথ। যে বয়সে কেউ প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার মানেই বোঝে না সেই বয়সে সহজ পাঠের বিশ্বম্ভর বাবুর গল্পটি ছিল আমার ভীষণ প্রিয়, বাবা বার বার পড়াতেন। তা সেটি স্কুলের মঞ্চে উঠে সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য নাকি আমার জন্য একটি পুরষ্কারও বরাদ্দ হয়েছিল। সেটিই বোধহয় আমার জীবনের প্রথম ও শেষ “প্রথম পুরষ্কার” যেটি যথারীতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু গল্পটা হারায়নি। কলেজজীবনে এসে যে লেখাটি জীবনে কম্পাসের কাজ করেছিল এবং এখনও যে লেখাটিতে পথের হদিশ পাই সেটির নাম হলো “গোরা”। আজ বড়ো বেশি মনে পড়ছে এই লেখা দুটোর কথা। ইচ্ছা করছে সহজ পাঠটা বের করে আবার মঞ্চে উঠে পড়ি সকলের মাঝে গিয়ে বিশ্বম্ভর বাবু ডাকাতদের চিকিৎসা করেছিলেন, কেন করেছিলেন ? কে জানে, কিন্তু করেছিলেন।
এই বাংলার সিনিয়র চিকিৎসকেরা ঘোষণা করলেন বাংলাদেশী রুগী তাঁরা দেখবেন না, সকল চিকিৎসকদের কাছে আবেদনও করে বসলেন সকলেই যেন সেই সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের কিছু যুবক ভারতের পতাকাকে অপমানিত করেছে, বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হচ্ছে তাই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। কথাগুলো শুনেই হিপোক্রেটিসের নাম বিন্দুমাত্র মাথায় আসেনি জানেন, শহরের কোনও এক মেডিকাল কলেজে কালো পোশাক পরে কী শপথ নিয়েছিলাম একটি বাক্যও মাথায় আসেনি। মাথায় এলো সেই বিশ্বম্ভর বাবুর সপ্তগ্রাম যাত্রা, পথে ডাকাতদের আক্রমণ, আহত ডাকাতদের শুশ্রূষা করার গল্প।
বর্তমানে সাথে সহজ পাঠ নেই, একটু গোরা পড়ব সাথে সেটাও নেই। দিল্লিতে থাকি। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না বাংলার ডাক্তাররা বাংলা ভাষায় এসব লিখছে। প্রধানমন্ত্রী চা ওয়ালা ছিলেন বলে তাঁর সাম্প্রদায়িক ভাষণ নিয়ে আমরা যা নয় তাই বলি, অথচ শিক্ষিত মার্জিত ডাক্তারবাবু একই রকম কাজ করলেন। ফোন লাগালাম রিহাদকে, বললাম আজই দেখা করব। রিহাদ বাংলাদেশের ছেলে, এমন একটি পরিবারে সে বড়ো হয়েছে যেখানে সিনেমা দেখা গান শোনা ছিল অপরাধ। বিশ্বম্ভরবাবু যে ডাকাতদের চিকিৎসা করতে পারেন এমন গল্প শোনার সৌভাগ্য তার ছোটোবেলায় হয়নি। তার চেতনাকে নাড়া দেয় প্রথম এক নাস্তিক অঙ্কের মাস্টার। পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন উপায়ে সে ধর্মীয় বইপত্রের বাইরেও নানা বই পড়ার সুযোগ পায়। তার কাছে যখন এই গল্প আমি শুনি, তার জীবনের পথ চলার সাথে গোর্কির পৃথিবীর পথে উপন্যাসের আমি মিল খুঁজে পাই। বই যে কতো দুর্লভ হতে পারে, নতুন চিন্তা, স্বাধীন মুক্ত চিন্তা যে মানুষের মুখে ঠিক কেমন আলো ফোটাতে পারে তা রিহাদের মুখে যে সেই গল্প শুনেছে সেই বুঝবে। সে বাংলাদেশের পড়াশুনায় সন্তুষ্ট হয়নি, পয়সার দারুণ অভাব সত্ত্বেও সে বাড়ির গোরু বিক্রি করে এসেছে দিল্লির একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়তে দেশকে পাল্টাবে বলে। ওরা দেশকে পাল্টাতে চাইছে, দেশের বাইরে এসে কিছু শিখে দেশকে পাল্টানোর স্বপ্ন ওরা দেখতে পারে। আমি ভাবলাম আমরা কি সেই স্বপ্ন দেখতে পারি? ওরা কিন্তু পারছে। জিজ্ঞেস করলাম সবাই বলছে বাংলাদেশ মানেই মৌলবাদ, বাংলাদেশ নাকি হয়ে যাবে আফগানিস্তান! রিহাদের ভাষা, রিহাদের গলা, রিহাদের লেখা আমায় বুঝিয়ে দিল ভারত থেকে বাংলাদেশ আসার সময় সে কোনও হিমালয় পর্বত দেখেনি, পায়নি কোনও ঘন অরণ্য বা কোনও মরুভূমি। কেবল দুটি নির্লজ্জ কাঁটাতার, সহস্র বছরের ইতিহাসে ভূগোলে এক যে ভূখন্ড তা হঠাৎ কীভাবে আফগানিস্তান হবে!
রিহাদেরা দেশ পাল্টানোর জন্য দেশ থেকে বেরোচ্ছে, আমরা দেশ পালটে যাচ্ছি কেবল, নিজের দেশকে আর পাল্টাচ্ছি না। এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি ততোক্ষণে অনেক চিকিৎসকই এই বিষয়ে নিজেদের মতামত স্পষ্ট করা শুরু করে দিয়েছেন। অনেকেই বাংলাদেশী রুগী বয়কটে সমর্থন জানিয়েছেন। চিকিৎসকদের মনে হয়েছে এইভাবে টাইট দেওয়া যাবে একটা দেশকে। এই মেরুকরণের পরিবেশে যা সবচাইতে বেশি কষ্ট দেয় তা হল পরিচিত মানুষদের এর শিকার হতে দেখা।
এতোসবের পরে শেষমেশ চিন্তা করে দেখলাম ধরুন একজন চিকিৎসক চেম্বারে রুগীকে জিজ্ঞেস করলেন কী নাম? বয়স কতো? তারপর জিজ্ঞেস করলেন বাড়ি কোথায়? রুগী উত্তর দিলো ঢাকা। তখন কি তিনি হঠাৎ করে থেমে যাবেন? তখন কি তিনি সত্যিই আটকে যাবেন? মানুষের ব্যথা, যন্ত্রণা শরীরের ক্ষত তিনি কি দেখা বা শোনা আচমকা বন্ধ করে দিতে পারবেন? রুগীর নাম পদবী পরিচিতি শুনে কি সত্যিই এই বোধ কাজ করে উঠতে পারে? সন্দেহ হলো আমার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রতিটি মানুষই একেকটা বই, প্রত্যেকটি পেশেন্ট আলাদা, প্রত্যেকেটি আলাপ আলাদা। আমার মনে বিশ্বাস জন্মালো যিনি এই কথা সোশ্যাল মিডিয়াতে বলছেন তিনিও হয়তো পারবেন না। আইন নয়, হিপোক্রেটিস নয়, শপথ নয় পারবেন না কেন জানেন? কারণ চিকিৎসক তথা কোনও মানুষই কখনও এতোটা যান্ত্রিক হতে পারেন না। পোস্টগুলিই বরং যান্ত্রিক, ঘৃণাটাই বরং ঠুনকো, আমি ঠিক জানি জয় হবে আমার সেই সহজ পাঠের। রুগী আর ডাক্তার যখন মুখোমুখি হবে তখন ব্যাধির পরাজয়ই হবে উভয়ের একমাত্র লক্ষ্য। দুপক্ষের ব্যাধিই পরাজিত হবে।
খুব ভালো লেখা , সময়োপযোগী…
ভালো থাকবেন…
আপনার ফোন নম্বর টা যদি দেন, বিরক্ত করবো না…
7583913907
সহজ পাঠের এই গল্পটি রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ লিখেছেন। সমাজের ক্ষেত্রে কত বড় পাঠ ভাবা যায় না। বর্তমানে বিশ্বম্ভরের মত ডাক্তার নেই। নিজেই রুগী দেখতে চলেছেন সপ্তগ্রাম। কত বাঁধা বিঘ্ন জেনেও। এখন যতই অসুস্থ হোক কোন ডাক্তারই বাড়িতে আসতে চান না। রুগীর যত অসুবিধাই হোক। দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন ব্যধির কোন জাত ধর্ম বা পেশা দেখা হয় না। ডাকাত বলে তো কোন মনুষ্য জীব জন্মায় না। সমাজ তাকে তৈরি করেছে। আমরা নাম দিয়েছি মাত্র । তাই বলে তো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সে হারায়নি। মানবিকতার দিক। তাই বিশ্বম্ভরবাবু বললেন ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আয়। চিন্তা করুণ সেটাও ফ্রি। এত বড় মাপের হৃদয় ডাক্তার কোথা থেকো পেল।