আমার ব্যারাকপুর আজ থেকে বিশ বছর আগে যা ছিল এখন এতটাই বদলে গেছে যে অনেক কিছুই আমার চোখেও নতুন লাগে। রাস্তাঘাট, মানুষজন, গাছপালা, মাঠ-ময়দান, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এসব এত নিপাট পালটে গেছে যে নগরটাই আমার কাছে অচেনা হয়ে উঠছে। মানুষের ভারে, চাপে, উন্নয়নের জোয়ারে শহর এভাবেই পালটে যেতে থাকে। ভাঙ্গা শহরের ওপর নতুন শহর গজিয়ে ওঠে। তার ওপর আবার নতুন। পলেস্তারার ওপর পলেস্তারা পড়তে থাকে। স্মৃতি থেকেও ক্রমশ হারিয়ে যেতে যেতে নগরসভ্যতা একদিন ইতিহাস হয় যায়।
কতই বা বয়স এই নগরের? মাত্র কুড়ি বছর। এর মধ্যেই তার এত বদল। আগামির ভারে তার ইতিহাসের দশা কী হবে?
ছোটবেলায় যখন ইতিহাস পড়তাম পানিপথের প্রথম যুদ্ধ দিয়ে শুরু হত পঞ্চম শ্রেণীর সরকারি ইতিহাস বই। মনে মনে ভাবতাম, মাত্র ১৫২৬! মানে পাঁচশ বছরও হয় নি! যদি ধরি আমি একশ বছর বাঁচব, আমার পাঁচপুরুষ। অথচ এই মাত্র পাঁচশ বছরে পৃথিবীর ইতিহাস কি সাঙ্ঘাতিক বদলে গেছে। কি সাঙ্ঘাতিক বদলে গেছে মানুষের জীবন।
অথচ এই ইতিহাস কতটা সত্যি? হাতে পাওয়া কিছু বই, কিছু দলিল-দস্তাবেজ যা কিনা লিখেছে সম্রাটের মাইনে দেয়া লিপিকর, কিছু সৌধ, কিছু মুদ্রা- এসব নিয়ে গড়ে ওঠা একটা ইতিহাস। যেখানে আমার-আপনার মত সাধারণ মানুষ একটা বিরাট কল্পনা, আমাদের লড়াই-বেঁচে থাকা-সংগ্রাম সবকিছু ‘মোগল আমলে সামাজিক অবস্থার’ এক প্যারাগ্রাফে ঢুকে যাবে- শেষ হয়ে যাবে। ভেবে দেখুন জীবনের, ইতিহাসের কী ভয়ানক এক অপব্যয়! শুধুমাত্র রাজরাজড়া আর মহামহিমদের নিয়ন্ত্রিত ইতিহাস মানুষের ইতিহাস হয়ে আমার আপনার মাথার ওপরে চেপে বসে আছে। সেই হারানো ইতিহাসে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না। কুড়ি বছর আগেকার আমার শহরেও আমি নিজেকে খুঁজে পাই না।
অথচ ইতিহাস এমনই। কলমের এক সামান্য আঁচড়ে ভবিষ্যতের ধারণাকে বদলে দিতে পারে। রিচার্ড ডকিং, যিনি সারা বিশ্বে যত না ডারউইনবাদী বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃত ততটাই একজন ঘোষিত নিরীশ্বরবাদী ও বিধর্মী ক্যাথলিক হিসেবে নিন্দিত। উনি ওনার ‘সেলফিস জিন’ বইটির এক জায়গায় লিখেছিলেন সেই বাইবেলের সাঙ্ঘাতিক ‘ঐতিহাসিক ভুল’-এর কথা। যদিও যিশু সম্ভবত কথা বলতেন অ্যারামাইক ভাষায় তার মৃত্যুর বহু বছর পরে ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা হয়েছিল হিব্রুতে। সেই হিব্রু থেকে অনেক বছর পরে ওল্ড টেস্টামেন্টের অনুবাদের কাজ শুরু হয় গ্রিক ভাষায়। গ্রিক ভাষা তখন সারা পৃথিবীর প্রধান ভাষা, আর আলেকজান্দ্রিয়া সারা বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী।
আলেকজান্দ্রিয়ায় বাহাত্তর জন ইহুদি অনুবাদক হিব্রু থেকে গ্রিক ভাষায় ওল্ড টেস্টামেন্টের অনুবাদ কাজ শুরু করেন। এদের বলা হয় ‘সেপচুয়াজেন্ট’। এদের মধ্যে কোনো একজন হয়ত ‘ভার্জিন মেরি’র অনুবাদ ভুল করে বসেন। হিব্রু ভাষায় তা ছিল ‘হা-আলমা’ যার অর্থ ‘যুবতী নারী’। কিন্তু তিনি গ্রিক ভাষায় তার অনুবাদ করে বসেন ‘পারথেনোস’ মানে ভার্জিন, অক্ষতযোনি। তিনি হয়ত তখন দীর্ঘ কাজের ভারে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন কিংবা তার হয়ত ডায়াবিটিস ছিল। সেই সময় হাইপোগ্লাইসিমিয়া-র কারণে তার মাথায় গ্লুকোজ কম যাওয়ায় ওই ‘সামান্য’ ভুল হয়ে যায়। কিন্তু ওই সামান্য একটা অনুবাদের ভুল পরবর্তী ক্রিশ্চান দর্শনের ধারাটিকেই অনেকটা বদলে দিয়েছিল। ‘জেসাস অফ নাজারেথ’ হয়ে ওঠেন কুমারী মেরির সন্তান, অর্থাৎ ঈশ্বরের পুত্র।
এমনটাই ইতিহাস। সামান্য এক কলমের আঁচড় সব কিছু বদলে দিতে পারে। সম্রাট আওরঙ্গজেব কতটা নিষ্ঠুর ছিলেন, তিনি কতগুলো হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন- তা নিয়ে আমাদের ইতিহাসের গায়ে আঁচড়ের পর আঁচড় পড়ে। ঐতিহাসিকদের বিবরণ, দলিল, মহাফেজখানার ছেঁড়া পাতা নিয়ে থিসিসের পর থিসিস, আর তার সুতো ধরে রাজনীতির পর রাজনীতি, ঘৃণা আর করুণার রক্ত ও অশ্রু। আজ কী আছে তার তাৎপর্য, কীই বা আছে তার সত্যতা? কয়েকটা ছেঁড়া পাতা থেকে কে সত্যতা যাচাই করবে? সত্য যা লুকিয়ে আছে তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করা কি এতই সোজা? আর সত্যিটা তো সবসময়ই আংশিক। যদি সম্রাট আওরঙ্গজেব ঠিক করতেন যে তিনি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করবেন আজ ভারতের একটা মন্দিরও কি তার রোষ থেকে রেহাই পেত? সত্য সবসময়ই আংশিক। ইতিহাস সবসময়ই আংশিক। এই আংশিকতা কিছুটা শাসকের ইচ্ছাধীন, কিছুটা ঐতিহাসিকের মেধা নিয়ন্ত্রিত।
যদি আরও পিছিয়ে যাই, আরো। যদি সিন্ধু সভ্যতা, দশ রাজার যুদ্ধ, আর্য-অনার্য, রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণের সময়ে চলে যাই ভেবে দেখুন তো সেখানে কোথায় কী, কোথায় সত্যি আর কোথায় মিথ্যা। কোথায় বিশ্বাস আর কোথায় বাস্তবতা! তবে একটা জিনিস কিন্তু ভেবে দেখবেন সেখানেও আমি আপনি কোথাও নেই। আমরা হয়ত বর্শা হাতে প্রাসাদের প্রহরী বা ঢাল তরোয়াল হাতে সামনের পদাতিক সেনা। সূর্য ডোবার আগেই মরে যাব পিঁপড়ের মতো। আমাদের জন্য একটি লাইনও লেখেননি বেদব্যাস। অথচ আপনি কী অস্বীকার করেন যে এই মহাভারতে আমাদের কোনো ভূমিকাই নেই?
এইভাবেই আমরা হারিয়ে যাই, আর হারিয়ে যেতে থাকে ইতিহাসের নিরপেক্ষতা। অথচ এই অনিরপেক্ষতাকেই নিপুণ কৌশলে আমাদের পেছনে লেলিয়ে দেবার খেলা দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। আমি তাই ইতিহাসকে গল্প বলে মানি। ইতিহাসের মধ্যে গল্পকেই খুঁজে বেড়াই। আমি তাই ইতিহাসের কাছে ফিরে যাই সত্যকে খুঁজে পেতে নয়, নতুন এক গল্পকে খুঁজে পেতে। ইতিহাস বেঁচে আছে। ইতিহাসের সত্যিটা অনেককাল আগেই হারিয়ে গেছে। যদি আদৌ সত্যি বলে কিছু থাকে।
যদি কেউ এই বিরাট প্রেক্ষাপটকে একটা ক্যানভাসের মধ্যে ধরতে চায় তবে তাতে বিমুগ্ধ না হয়ে তাকে সন্দেহ করুন। আমি তো অশিক্ষিত সাধারণ লোক। আমি তাই বিমুগ্ধ হয়েছিলাম ‘সেপিয়েন্স’ পড়ে। আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড। আদিম মানুষ থেকে আধুনিক ধ্বংসপ্রবণ মানুষের ইতিহাস। মুগ্ধবত সেই পাঠ। তারপর নানা জায়গায় কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে তার টেড টক, ইন্টারভিউ, ওবামা প্রশস্তি, বিপাসন, সমকামী জীবন, মোবাইলহীন জীবন- এসব জেনেশুনে তাকে একজন আঁতেল গুরু টাইপের মানুষ বলে মনে হত। এখন নানা পন্ডিতজনের মধ্যে যখন তার কোটি কোটি ডলার উপার্জিত বইয়ের নামে সমালোচনা শুনি তখন বুঝতে পারি ভুল হয়েছিল। ইতিহাসকে ওই প্রেক্ষাপটে ধরা যায় না। এত বিরাট অংশকে সংক্ষেপে লিখতে গেলে যতই বিপাসনের অভ্যাস করুন না কেন আপনি গল্প লিখতে বাধ্য। তাই আপনি বিজ্ঞানীর বদলে একজন ‘পপুলিস্ট বিজ্ঞানী’ বা ‘পপুলিস্ট ঐতিহাসিক’ হতে বাধ্য। বললাম না আমি ইতিহাসের কাছে গল্প খুঁজি। সত্যিটা খুঁজি না। কারণ সত্যি বলে কিছু হয় না।
ভেবে দেখুন তো যেদিন পৃথিবীতে বিরাট কিছু বিপর্যয় আসবে, সমুদ্রের নিচের ইন্টারনেটের মোটা তার সব ছিঁড়ে যাবে, লন্ডভন্ড হবে সভ্যতা সেদিন কোথায় থাকবে আমাদের কাগজের বই, যন্ত্রের স্মৃতি। ব্যাবিলনের লাইব্রেরি তাও না হয় ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ড ও লুটপাট সত্ত্বেও তার পোড়া মাটির কিছু প্যালেট বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারের প্যাপিরাস সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মুছে নিয়ে চলে গেছে সব মনীষা। ধরুন আজ থেকে বহু বছর পরে সব ধ্বংস হয়ে গেলে ভবিষ্যতের কেউ বাংলা বই হিসেবে পেল কেবল মাননীয়ার ‘কবিতাবিতান’ বইটি। সেই মোটা বইটি নিয়ে সে যদি তার রিসার্চ পেপার করে তাহলে আজ আপনি যিনি বাংলা কবিতা লিখে নিজেকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভাবছেন কী হবে আপনার ভবিষ্যৎ? ইতিহাসের এক্কা-দোক্কায় আপনি কোথায়? বাংলা কবিতার ঐতিহাসিকতার নিরপেক্ষতারই বা কী হবে। তার চেয়ে ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সত্য ভেবে লাভ নেই। গল্প খুঁজুন। ইতিহাস থেকে গল্প খুঁজুন।
‘বিগ ব্যাং’ কী বৈজ্ঞানিক সত্য? হয়ত তাই। হয়ত অবশ্যই। হয়ত ওটাই আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তির একমাত্র ‘সত্যিকারের’ থিওরি। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ শুনলাম আরো অন্তত কুড়ি বছর কার্যকরী থাকবেই। আমিও হয়ত বছর কুড়ি বেঁচে যাব। এই সময়ে সে নিশ্চই সেই হারিয়ে যাওয়া মাহেন্দ্রক্ষণের আলো বা বিকিরণ শোষণ করে কিছু একটা ছবি দেবে। সকলের মত আমিও তার প্রতীক্ষায় আছি। তা সে যদি সেই ছবি তোলেও তবে সেটাই কি সত্যি? মহাবিশ্ব কি তাহলে একটাই? একটাই বিগ ব্যাং একটাই মহাবিশ্ব, নাকি অনেক বিগ ব্যাং আর মাল্টিভার্স। বিজ্ঞানও একরকম ইতিহাস। আর তাতেও সত্যির মাত্রাভেদ ঘটে। আমি তাই বিজ্ঞানের ভেতরও গল্প খুঁজি। কারণ আমি দেখেছি বারেবারে এক সম্ভাবনা কিভাবে অন্য অনেক সম্ভাবনাকে জারিয়ে দিতে পারে।