মুহূর্তের পদস্খলনে গোড়ালি ভেঙে কয়েক টুকরো! ফেসবুকে ভাঙা পায়ের প্লাস্টার করা ছবি দিয়েছি। আরোগ্য কামনা করে অসংখ্য বার্তাও পেয়েছি। পা ভেঙে ঘরে বসে থাকতে সত্যিই ভাল লাগে না, লাগার কথাও নয়। কিন্তু এই সূত্রে যে অসাধারণ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম আমাদের রাজ্যের বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার, পা না ভাঙলে তা অজানাই থেকে যেত! সেই গল্পই আজ বলি আপনাদের!
প্যাভলভে ধোবীঘরের র্যাম্পে যখন পা হড়কে পড়লাম, তখনই বুঝেছি যা হওয়ার হয়ে গেছে! আমার অফিসের সহকর্মীরা আমাকে গাড়িতে তুলে কোথায় যাব, কোথায় যাব করতে করতে নিয়ে গেলেন পিয়ারলেস হাসপাতালে। প্রথমে ভেবেছিলাম ফর্টিসে যাব, কিন্তু আমার ডাক্তারকে কিছুতেই ফোনে যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমার সহকর্মীরা আলোচনা করে স্থির করলেন পিয়ারলেস যাবেন। সেই মতো গিয়ে পৌঁছোলাম পিয়ারলেসে। হুইলচেয়ার করে এমার্জেন্সিতে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু তার পরের তিনঘণ্টা যেভাবে কাটল, দুঃস্বপ্ন বললেও কম বলা হবে! বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে এমন জঘন্য ধারণা হবে কোনওদিন ভাবিনি!
ট্রলি হুইল করে নিয়ে গিয়ে এমার্জেন্সিতে দুটো বেডের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিল। পেছনদিকে তাকিয়ে দেখলাম নম্বর ৩৫২২। এমার্জেন্সিতে একটা রিসেপশন, সেখানে একজন মেয়ে ডাক্তার, একজন পুরুষ ডাক্তার। আমি তো টানটান হয়ে পিঠ সোজা রেখে ট্রলিতে বসে আছি। মারাত্মক ব্যথা করছে। একটু পরে একজন খুব মিষ্টি দেখতে তরুণ ডাক্তার এলেন।
এসে বললেন, ‘শুনুন, আমি আইভি চালাচ্ছি, পেনকিলার দেব।’
আমি বললাম, ‘একদম নয়। একদম আমাকে আইভি দিয়ে পেনকিলার চালাবেন না!’
‘আপনি ব্যথা সহ্য করতে পারবেন?
‘হ্যাঁ, পারব!’
‘ডাক্তার কখন আসবেন আমি জানি না কিন্তু…’
‘ঠিক আছে, আমি ব্যথা সহ্য করছি। আপনি আইভি দেবেন না…’ মনে মনে বললাম, আমার শরীর, আমি বুঝব |
তারপরে তো বসেই আছি। একসময় ডাক্তারবাবু এলেন। ব্যথার জায়গাটা দেখে বললেন, ‘ঠিক আছে, এক্স রে করতে যান। এক্স রে দেখে আমি বলব কী করতে হবে।’
তারপরে এক অনন্ত অপেক্ষা। এক্স-রে করতে নিয়েই যাচ্ছে না, নিয়েই যাচ্ছে না! কী ব্যাপার? না, ওই ট্রলি ঠেলার লোক নেই! আমি তখন বলছি, এক্স-রেটা অন্তত করুন, আমার তো একটা ফার্স্ট-এড দরকার! না হলে আমি এমার্জেন্সিতে আসব কেন! এই করতে করতে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর এক্স -রে-তে নিয়ে গেল! এক্স-রে করার সময়ও খুব জোর দিয়েছে। সে না হয় বুঝলাম, করতেই হবে, না হলে ছবি উঠবে না! তারপর আমাকে আবার ঠেলে ঠেলে এমার্জেন্সিতে নিয়ে এল, এসে সেই গলতার মধ্যে আবার ঢুকিয়ে দিল।
এবার আমার পাশে একজন ফুড পয়জনিংয়ের রোগী। একটি অল্পবয়সী মেয়ে। সে প্রাণপণে বমি করবে বলে আয়াকে ডাকছে! অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর একজন এলেন, এসে মেয়েটিকে বললেন ‘আগে আপনার কোভিড টেস্ট করতে হবে।’ সোয়াবের কাঠি মেয়েটির নাকে আর গলায় ঢোকানো হচ্ছে আর সে সমানে ওয়াক তুলছে! মেয়েটি কিন্তু বেশ স্মার্ট, কিন্তু এত অসুস্থ যে একদম জোর পাচ্ছে না! নার্স মেয়েটিকে বকতে শুরু করলেন, ‘এইটুকুতে এরকম করলে চলে!’ মেয়েটিও বলছেন, ‘আসলে আপনারা এ সব করতে করতে এমন হয়ে গেছেন যে আর কিছু আপনাদের গায়ে লাগে না!আমি তো হিউমান’
যাই হোক, কোনওমতে সোয়াব টেস্ট তো হল। এখন ওকে আইভি চালাতে হবে। এবার সেই মেয়ে আগে শুনেছে যে আমি আইভি করাব না বলেছি। সেও বলতে শুরু করেছে, ‘আমিও আইভি করাব না, আমার চ্যানেল খুঁজে পাওয়া যায় না, খুব ব্যথা লাগে।’ বললে কী হবে, চ্যানেল তো করতেই হবে! ফুড পয়জনিংয়ের কেস, স্যালাইন চালাবে। একজন নার্স দৌড়োতে দৌড়োতে এলেন, এসে সূচ দিয়ে খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিলেন। চ্যানেল পাওয়া যাচ্ছে না আর মেয়েটি পরিত্রাহি চিৎকার করছে! আর নার্স বকছেন মেয়েটিকে আর সেই সঙ্গে পাশের একজন গ্রুপ ডি স্টাফকে বলছেন, ‘দ্যাখ না, রক্তটা নিডলের মুখে এসেও ঢুকে চলে গেল!’ একজন প্রশিক্ষিত নার্স রোগীর সামনে এভাবে কথা বলছেন! ওদিকে মেয়েটির আর চেঁচানোরও ক্ষমতা নেই, সে গামলায় সমানে সবুজ বমি করছে আর এ সব আমার পাশে আমি হতে দেখছি!
এ সব যখন চলছে, সেই সময়ে আর একজন মাঝবয়সী মহিলা রোগী এলেন এমার্জেন্সিতে। একদম আমার সামনে। তাঁর একটা হাত দুর্ঘটনায় জখম হয়েছে। তিনি হাউহাউ করে কাঁদছেন আর রেসিডেন্ট ডাক্তারকে বলছেন আমার আঙুলটা বাদ যাবে না তো! এখন একটা দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ তো একটু আশ্বাস চায়! বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার তার ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছেন না! মহিলার উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা না করে তিনি তখন মোবাইল দিয়ে হাতের ছবি তুলছেন নিজের বসকে পাঠাবেন বলে।
এর মধ্যে আমার কাছে একজন দক্ষিণ ভারতীয় প্যারামেডিক এলেন। এসে বললেন ইসিজি করবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? উনি বললেন, এটা আমাদের নিয়ম। কিন্তু নিয়মের তো একটা মাথামুন্ডু থাকবে! তিনি কোনও কথা না বলে আমার শরীরে ইসিজির চাকতি বসিয়ে দিলেন। বেশ, তা হলে ইসিজির পরে আমার রিপোর্টটা বুঝিয়ে দিন! না, তিনি সেটাও করবেন না। তা হলে ইসিজিটা করলেন কেন? কিছু না বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি চলে গেলেন। এই হচ্ছে এমার্জেন্সির হাল!
এরপর আবার ডাক্তার এলেন। এক্স-রে দেখে বললেন আপনার গোড়ালির দু’ জায়গায় ভেঙে গেছে, সার্জারি করতে হবে। শনিবার সার্জারি হবে। আপনার অ্যানাসথেটিস্ট লাগবে, কার্ডিওলজিস্ট লাগবে, কোভিড টেস্ট করতে হবে। আমি বললাম, আমি সার্জারি করাব কিনা বাড়ির লোকের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বাড়ির লোককে ডেকে আনা হল। বাড়ির লোক চাইছিল আমি ভর্তি হয়ে যাই। আমি বললাম, আমি এখান থেকে এক্ষুনি বেরোতে চাই! ওদিকে চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছে আর বলছে ‘রত্নাবলী রায় লামা’ (LAMA), মানে লিভ এগেন্সট মেডিক্যাল অ্যাডভাইস। যাকে সাধারণ চলতি ভাষায় বন্ড সই করে বেরোনো বলে! সেই লামা দিতে আরও এক ঘণ্টা কাটাল! তার মধ্যে গাদা গাদা তুলো দিয়ে একটা জঘন্য প্লাস্টার করে তিন হাজার টাকা নিয়ে নিল।
ফেরার পথে সেই এক গল্প। আমাকে যে কার পার্কে নিয়ে যাবে, তার জন্য হুইলচেয়ার ঠেলার লোক নেই। তার জন্য ফের অপেক্ষা! সব মিলিয়ে এক বীভৎস অভিজ্ঞতা।
একটা হাসপাতালের এমার্জেন্সি দেখে তার অন্য বিভাগগুলোর সম্পর্কে বোঝা যায়। পিয়ারলেসের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে আমি অন্তত নিশ্চিত! ভাবা যায়, একটা এমার্জেন্সিতে একজন রেসিডেন্ট ডাক্তার রোগীর নাম উল্লেখ করে করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, অমুক কোভিড পজিটিভ, তমুক কোভিড পজিটিভ! রোগীদের প্রিভেসি যাক চুলোর দোরে! তাঁদের অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা, কষ্ট কমানোর কোনও চেষ্টা নেই, সব কিছুতে প্রচণ্ড গা-ছাড়া মানসিকতা, এখানে গেলে রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। শারীরিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবেও! এর থেকে বোধহয় সরকারি হাসপাতালে গেলেই ভাল হত!
একদম শেষে ফুটনোটে বলি, বাড়ি ফিরে পরিচিত ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন সার্জারি করার দরকার নেই কারণ ১) আমার বয়স এবং ২) খেলাধুলো আমার পেশা নয়| ‘ক্লোসড ম্যানিপুলেশন’ প্রক্রিয়ায় প্লাস্টার করে দিয়েছেন ভাল করে। সে ছবি তো আগেই দিয়েছি!
#PeerlessHospital #Etiquetteofcare #privacyofpatients #bodilyintegrity #privatehealthcare #kolkata
Satti WB er treatment services niye ar kichu balar apekkha rathena.