গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় মনোরমার খুপরিতে বসে রোগী দেখছিলাম। রাত সাড়ে নটার মধ্যে যে করেই হোক বাড়ি ফিরতে হবে। বহরমপুর থেকে শ্বশুর- শ্বাশুড়ির আসার কথা।
একমনে রোগী দেখে যাচ্ছি, হঠাত বাইরে হই হই চিৎকার। ভালো করে শুনে বুঝলাম অনেকে মিলে ‘আল্লাহ আকবার’ চিৎকার করছে।
খুপরির সামনে অপেক্ষা ঘরের কাঁচের দরজা ঠেলে রোগীরা সব হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সকলেই বেশ ভয় পেয়েছেন। তবে আমার মাথায় এলো না এই কাঁচের দরজা, কাঁচের ঘর কী করে তাঁদের বাঁচাবে। একটা লাঠির বাড়ি মারলেই সব ঝনঝন করে ভেঙে যাবে।
একটু পরে বাচ্চাদের ডাক্তারবাবুর ঢোকার কথা। বেশ কিছু বাবা- মা বাচ্চা কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরাও কাঁচের ঘরে ঢুকেছেন। বাচ্চারা আরশোলা-টিকটিকির ভয় পায়, কিন্তু ধর্মের ভয় পায় না। তাঁরা এতো ভিড়ের মধ্যে থাকতে নারাজ- তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো। পরিস্থিতি যাকে বলে বেশ জমজমাট।
এতক্ষণ সকলেই আগে ডাক্তার দেখাতে চাইছিলেন। এখন কেউই আর দেখাতে আসছেন না। ভয় পাচ্ছেন দেখানো হয়ে গেলে কাঁচের ঘর থেকে হয়তো বের করে দেবে। কারণ ইতিমধ্যেই গৌতমদা একবার বলে গেছে, ‘যাদের হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা বেরিয়ে আসেন। ভয়ের কিছু নেই। উল্টোদিকেই থানা। এখানে কেউ কিছু করার সাহস পাবেন না।‘
এর মধ্যে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আল্লা, আমাদের সকলকে রক্ষা করো।’
একটি তরুণ ছেলে রেগে মেগে বলল, ‘আল্লাই মারতে আসছেন, আর আপনি আল্লার কাছেই জীবন ভিক্ষা চাইছেন? সেম সাইড গোল হচ্ছে না দাদু?’
বয়স্ক ভদ্রলোক খেপে গেলেন। বললেন, ‘কিছু না জেনে শুনে বড়বড় কথা বলো কেন? তোমার বাবা-মা বয়স্ক মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শেখাননি?’
অন্যরা দুইজনকেই শান্ত করার চেষ্টা শুরু করলেন। এ অঞ্চলের হুমাইপুর, পাটুলিতে বহু মুসলিম মানুষ আছেন। তাঁরা মনোরমাতে দেখাতে আসেন। আজকেও অনেকে দেখাতে এসেছেন। তবে তাঁরাও এই ঝামেলার সময় স্বজাতির সাথে দাপাদাপি করার চাইতে বিধর্মীদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বেশি পছন্দ করছেন।
একজন মাঝ বয়সী মহিলা বললেন, ‘আমার ইরিটেবেল বাওয়েল সিনড্রোম আছে। টেনশন হলেই পটি পায়। এখন খুব পাচ্ছে। এখানে ল্যাট্রিন কোথায় আছে।’
গৌতমদা বলল, ‘চেম্বারের পেছনেই পায়খানা।‘
‘কিন্তু একা কী করে যাব? বাইরের পরিস্থিতি কী? এখনও কী ওরা লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।‘
গৌতমদা বলল, ‘রাস্তা এখন শুনশান। আশেপাশে কেউ নেই। সকলে চৌমাথায় গিয়ে রাস্তা অবরোধ করেছে। আপনি নিশ্চিন্তে যান।‘
অন্য একজন ভদ্রমহিলা বললেন, ‘চলুন দিদি, আমি গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।‘
আমি আবার রোগী দেখা শুরু করলাম। টুকটুক করে রোগী দেখছি। বাইরের হই হট্টগোল ধীরে ধীরে কমছে। অবরোধকারীদের কল্যাণে রাত নটার আগেই রোগী দেখা শেষ করে ফেললাম। অনেকেই নাম লিখিয়ে ঝামেলার ভয়ে আসেননি। আমার সুবিধাই হলো। আজ দেরী করে ফিরলে রুপালীর মুখ ভার হতো। গৌতমদাকে ডাকলাম, ‘শিগগিরি আমাকে ছাড়ো। বাড়িতে কাজ আছে।‘
গৌতমদা বলল, ‘কিন্তু যাবেন কী করে?’
‘সে কি, এখনও অবরোধ চলছে?’
‘অবরোধ তো কখন উঠে গেছে। ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে।‘
বৃষ্টি হোক, দাবানল হোক, দাঙ্গা হোক- সাড়ে নটার আগে আমাকে বাড়িতে ঢুকতেই হবে। আমি ও আমার স্কুটার দুজনেই চুপচুপে ভিজে ঠিক নটা তেইশে বাড়ি ঢুকলাম। তবু রুপালীর মুখ ভার। ওর বাবা মা এখনও বহরমপুর থেকে এসে পৌঁছন নি। শুধু মধ্যমগ্রাম নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ চলছে।
আমার খিদে পেয়েছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে খেতে চাওয়া সম্ভব নয়। শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঢুকলেন রাত এগারোটা পার করে। খেতে খেতে রাত বারোটা।