আমাদের ক্লাবে শুক্রবার মেডিকেল ক্যাম্প শুরু হয় সকাল ছটা থেকে। কিন্তু কখন থেকে মানুষজন আসতে শুরু করেন বলা মুশকিল। ছটায় আমরা যখন ক্লাব ঘর খুলি, তখন অন্তত জনা পঞ্চাশেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে।
নিজেদের মধ্যে কলকল করে গল্প করছেন। ধমক দি- চুপ করুন সব। আশেপাশের বাড়ির লোকেরা নইলে এবার অভিযোগ করবে। লাইন ঠিক করুন।
গুঞ্জন কিছুটা বন্ধ হয়। কথা বন্ধ হওয়ার পর তাদের খিদে পায়। শ্রমজীবী মানুষ সব। ঘন ঘন খিদে পায়। ব্যাগ, পুটলি ইত্যাদি থেকে খাবার বেরোয়। কতরকমের খাবার, মুড়ি, রুটি, ছাতু, পান্তা ভাত…
ডাক্তার দেখিয়েই তারা কাজে যাবেন। হালকা খেলে চলবে না। ভারী কিছু খাওয়া চাই। অল্প পয়সায় পেট ভরাতে হবে। আশপাশ থেকে দুটো তিনটে কুকুর চলে আসে। তারা মুড়ি, রুটির ছেঁড়া টুকরো পায়। শুঁকে দেখে। কখনো খায়, কখনো পছন্দ হয়না। চলে যায়। কাক ঠোঁটে করে মুড়ি নিয়ে উড়ে যায়। পাঁচিলের উপর কয়েকটা কাঠবিড়ালি ভিড় করে। তারা ভয় পায় না। মানুষদের হাপুস হুপুস করে খাওয়া দেখে। তাঁদের ভাগ্যেও খাবার জোটে।
গত পাঁচবছর ধরে আমাদের ক্যাম্পে প্রথম রোগী সনাতন শীল। তিনি দুমাস আগে মারা গেছেন। উনি রাস্তাতেই থাকতেন। অন্যদিন কোথায় ঘুমাতেন জানি না, বৃহস্পতিবার ক্লাবের চাতালে এসে ঘুমাতেন। আমরা ঢোকা পর্যন্ত লাইন ঠিক রাখতেন।
চোখে কম দেখতেন। রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা ৪০৭ ধাক্কা মারে। আশেপাশের দোকানদাররা অনেকেই ওনাকে চিনত। বারাসাতে ভর্তি করেন। সেখানেই দুদিন পর মারা গেছেন। এক দোকানদার এসে খবর দিয়ে গেছেন। ওনার সাতকুলে কেউ নেই। এখনও হয়ত সনাতন বাবু বারাসাত হাসপাতালের মর্গেই পরে আছেন।
রোগী দেখতে হয় ঝড়ের গতিতে। বেশিরভাগ মানুষই ওষুধ নিতে আসেন। দু সপ্তাহের ওষুধ নিয়ে যান। আবার দু সপ্তাহ পর আসেন। টপাটপ ওষুধ কাটি। মেটফরমিন, এম্লোডিপিন, টেলমিসারটেন…
বুড়ো বাবাকে ধরে ধরে মাঝ বয়সী মহিলা আসেন। বলেন, বাবাকে প্রতিবার আনা যায় না। একই তো ওষুধ। দুমাস অন্তর বাবা কে আনি? বাকি সময় আমি এসে ওষুধ নিয়ে যাই?
আমি বলি, নিয়ম নাই। পেশেণ্টকে না দেখে ওষুধ দেওয়ার নিয়ম নাই। রোগী না দেখে ওষুধ দেওয়া শুরু করলে সবাই এসে ভিড় করবেন। একেক জন পাঁচ সাতজনের ওষুধ নিয়ে যাবেন। অত ওষুধ পাব কোথায়?
ভদ্রমহিলা হাসেন। বলেন, নিয়ম তো আপনিই বানিয়েছেন। আপনিই একমাত্র মাঝে মাঝে ভাঙতে পারেন। বাবাকে নিয়ে এলে ভ্যান ভাড়া লাগে পঞ্চাশ টাকা। তারপর বাবাকে বাড়ি দিয়ে কাজে যেতে দেরি হয়ে যায়। পাঁচ বাড়ি কাজ করি। বিষয়টা একটু বোঝেন।
আমি নেতিবাচক ঘাড় নাড়ি। বলি, হবে না। নিয়ম ভাঙতে পারব না।
ভদ্রমহিলা হাসেন। বলেন, দেখা যাক, পরের সপ্তাহে বাবাকে আনব না। আপনি ওষুধ দিলে দেবেন, না দিলে না দেবেন।
টুকটুক করে লাইন এগোয়। অদ্ভুত ভাবে যতজন দেখা হয়, ঠিক ততজন রোগী এসে লাইনে দাঁড়ান। লাইনের দৈর্ঘ্য ধ্রুবক থাকে। সাতটা অবধি এরকম থাকে। তারপর আস্তে আস্তে রোগী দেখার গতিবেগ বাড়ে, রোগী আসার গতিবেগ কমে।
এতদিন ধরে দেখতে দেখতে বেশিরভাগ মানুষই চেনা হয়ে গেছেন। ডাক্তারদের পক্ষে মানুষদের চেনা অপেক্ষাকৃত সহজ। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এখনও অজানা কারণে ডাক্তারদের বিশ্বাস করেন। তাঁদের কাছে অকপটে নিজেকে মেলে দেন। সদ্যবিবাহিত বউটি সহজেই পিঠের কাপড় সরিয়ে দেখান কিভাবে তার স্বামী বিয়ের পর থেকেই নিয়মিত মারধোর করছে। যে খবর এখনও সে কাউকে বলতে পারেনি। এমনকি তার নিজের দাদাকেও না।
আমার সমবয়সী একজন বলেন, ডাক্তারবাবু, ওষুধ খেলে ব্যথা কমছে। না খেলেই যে কে সেই।
আমি বললাম, আর কত টাকা বাকি? এখনও আড়াই হাজার টাকা হয়নি?
ইনি প্যাডেল ভ্যান চালান। গত তিনমাস ধরে ভ্যানে একটা সমস্যা হচ্ছে। ভ্যানটা ডানদিকে টাল খাচ্ছে। ওনাকে ভ্যান চালানোর সময় ডান হাতে অত্যধিক বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে। ফলে ডান কাঁধে ব্যথা হচ্ছে। প্রথমদিনই বলেছিলাম, ভ্যান সারিয়ে নিলে হয়।
বলেছিলেন, খোঁজ নিয়েছি। সারাতে প্রায় আড়াই হাজার টাকা লাগবে। অতো টাকা একবারে খরচ করা শক্ত। আস্তে আস্তে জমাচ্ছি। হয়ে যাবে অল্প দিনে। ততদিন ওষুধ খাই।
সে টাকা আর জমছে না। দু সপ্তাহ আগে বলে গেছিলেন প্রায় হয়ে গেছে। দুই হাজার পেরিয়ে গেছে। এ সপ্তাহে বললেন, মেয়ের স্কুলের টাকা দিলাম। খাতা টাতা কিনতে হলো। ঐ ফাণ্ড থেকে দিতে হলো। সাতশো টাকা বেড়িয়ে গেছে। তবে একমাসের মধ্যে হয়ে যাবে ঠিক। এবারের মতো ওষুধ দেন।
এভাবেই চিকিৎসা চলতে থাকে। ঠেকা দেওয়া চিকিৎসা। ধমকের চিকিৎসা। সহানুভূতি জানানোর চিকিৎসা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পেরলে আমার খিদে পায়। লাইনের শেষ প্রান্ত বারবার উঁকি দিয়ে দেখি।










