দশচক্রে ভগবান ভূত একটা প্রচলিত বাগধারা। উল্টোটাও কখনও ঘটে। সাক্ষী আমি নিজেই। ঘটনা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের। বলি শুনুন।
আমার বাবাকে একদা ভর্তি করেছিলাম সার্জারি ওয়ার্ডে। মেডিকেল কলেজের ডিএইচবি বিল্ডিংএ। হার্নিয়া অপারেশন। প্রফেসর ডি সেনগুপ্তর আন্ডারে ভর্তি। অপারেশনের পরে পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারের জন্য মেইল অ্যাটেন্ড্যান্ট রেখেছি। নির্ধারিত সময়ে ছুটিও হয়ে যাবে কদিন বাদে। গল্প সেই ছুটি দেবার পরের।
এখনকার দিনের মেডিকেল কলেজ ছাত্ররা তাদের নিজের বাড়ির কাউকে অসুখ হলে সাধারণত মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে না। কারণ একটা না। হয় তো অনেক কিছু।
তার মধ্যে প্রধান একটা হচ্ছে আস্থাহীনতা। ঘটনা কিন্তু সত্যি। আজকাল মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র কজনের বউয়ের ডেলিভারি মেডিকেল কলেজে হয় হাতে গুণে বলা যায়। প্রাক্তন ছাত্রীরাও নিজেদের প্রেগন্যান্সির শেষে লেবার পেন উঠলে পছন্দমত কর্পোরেট হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে ভর্তি হচ্ছেন। নিকটজনদের অন্যান্য অসুস্থতার ব্যাপারেও চিত্র একই। সরকারি হাসপাতাল নির্ভরতা ছেড়ে বেসরকারি জায়গায় ভর্তির প্রবণতা নিশ্চিত ভাবে বেড়েছে।
শুধুমাত্র একটা মাত্র হাসপাতালের বিশেষ ওয়ার্ডে প্রভাবশালী মানুষেরা ভর্তি হন আইনি নিষ্কৃতি পেতে। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর জন্য এ এক আশ্চর্য লজ্জাজনক অভিজ্ঞান, এই রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়।
এই ফাঁকির কথা মন্ত্রী সান্ত্রী, খোদ আইন আদালত ও আপামর জনগণ জানে। অথচ সেই একই হাসপাতালে অন্যথায় যে ‘ভুল চিকিৎসা’ হয় ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অবধি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত প্রকাশ্যে বলে। অন্তত সেদিনও বলেছে, তার নিজের পায়ের চিকিৎসার কথা উঠেছিল যখন।
আমাদের সময় কিন্তু ঘটনা অন্য রকম ছিল। কেউ ভুল বুঝবেন না প্লিজ্। এটা সেই প্রচলিত গানের মত নয়। সেই যে গান আছে না! ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। সেই রকমের কোনও ব্যাপার না।
আমরা নিজেদের আত্মীয়বন্ধুদের, এমন কী মা বাবাকেও মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার প্রয়োজনে ভর্তি করাতাম। অধিক কী বলব, আমার দুটি বাচ্চাই জন্মেছে মেডিকেল কলেজের ইডেন হাসপাতালে।
মেডিকেল কলেজেই ভর্তি করানোর বা ভর্তি হবার কারণগুলো এক এক করে বলি। সবাই নয়, কিন্তু মেডিকেল কলেজের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরাই ছিলাম পাতি একটু নীচের দিকের মধ্যবিত্ত বাড়ির। সেই সময়ে বেসরকারি হাসপাতাল বলতে ছিল মাত্রই হাতে গোণা কয়েকটা জায়গা। সেগুলো ছিল বড়ই খরচাবহুল।
শুধু তাই নয় মেডিকেল কলেজের শিক্ষক চিকিৎসকরা আমাদের জ্ঞান মতে কোনও ভাবেই বেসরকারি চিকিৎসকদের থেকে ন্যূন ছিলেন না। বরং আমাদের বিচারে বেশ এগিয়ে থাকাই। তাঁদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের যোগাযোগ ছিল খুব নিবিড়। শুধু তাই নয়, শিক্ষক-ডাক্তারদের ওপর নির্ভরতাও ছিল খুব।
আর তাঁদের পরবর্তী টায়ারের যাঁরা অর্থাৎ আরএমও আরএস, সিনিয়র ও জুনিয়র হাউসস্টাফেরাও ছিলেন খুব সহানুভূতিশীল এবং যোগাযোগ সম্ভব।
সর্বোপরি আমরা নিজেরাও খুব ভিজিল্যান্ট থাকতে পারতাম যার যার নিজের ভর্তি পেশেন্টের ব্যাপারে।
এই ভিজিল্যান্ট থাকার পয়েন্টটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। আমাদের সহপাঠী সমীর তার বাবাকে ভর্তি করল। সার্জারি ওয়ার্ডে। খুব যন্ত্রণাদায়ক পাইলস্ হয়েছে তাঁর।
মেডিকেল কলেজ, সবাই জানে শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। পেশেন্টদের হাতেকলমে পরীক্ষা করেই আমরা শিখি। এবং সেই হাতে কলমে শেখা ব্যাপারটা অনেক সময়েই রোগীর পক্ষে যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক। সমীরের বাবার রোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে কোনওরকম শারীরিক পরীক্ষা করা, রোগের নাম শুনে যে কেউ বুঝবে খুবই যন্ত্রণার।
সমীর ছিল কলেজের নাম করা দৌড়বীর। সে তার বাবার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে একাধিক বার সগর্জনে ঘোষণা করেছিল,
— এই পেশেন্টকে যে কেউ ছোঁবে, তাকে নন স্টপ ম্যারাথন দৌড় করাব।
বলা বাহুল্য এর পর অসুস্থ কাকাবাবুকে পরীক্ষা করার জন্য ছুঁয়ে দেখার। সাহস দেখায়নি আমাদের কোনও উৎসাহী সহপাঠী।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললে, সত্যের অপলাপ হবে। এজরা ওয়ার্ডে আটখানা দশখানা বেড নিয়ে একটা স্টুডেন্টস কেবিন ছিল। কোনও ছাত্র যথার্থ অসুস্থ হলে সেখানে ভর্তি হবার কথা। কিন্তু আমরা কয়েকজন মানসম্মান তোয়াক্কা না করা প্রায় ভিখিরি শ্রেণীর ছাত্র, যাদের মাসের শেষদিকে খাবার সংস্থান থাকত না, আমরা স্রেফ খাবার জোগাড় করার জন্য স্টুডেন্টস কেবিনে ভর্তি হতাম। এই ভর্তি হবার তীব্র প্রতিযোগিতায় কখনও কখনও তীব্র মনোমালিন্য, এমন কী হাতাহাতির উপক্রমও হত। পৃথিবীর অনেক আদিম যুদ্ধের মূলেই যে সুতীব্র ক্ষুধা, আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছিলাম। স্টুডেন্টস কেবিনে সহায়সম্বলহীন কারওর একটানা দু আড়াই বছর ভর্তি থাকাটা বিরল ছিল না।
এই সব পুরোনো দিনের কথা সেরে যা দিয়ে গল্প শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরি।
আমার বাবার হার্নিয়া অপারেশনের পর যথাকালে ছুটি হল। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরের করণিক। সেই সময়ের নিয়মে, চিকিৎসা বাবদে কিছু খরচ হয়ে থাকলে সেটা নিজের অফিসে বিল করলে পাওয়া যেত। এখনকার নিরিখে সেই সময়ের অ্যাটেনড্যান্ট খরচা খুবই সামান্য। নিম্নবর্গের চাকুরে বাবার কাছে সেই টাকাটা পাওয়া কিন্তু বেশ জরুরী ছিল।
তো বাবার অ্যটেনড্যান্টের নাম ছিল ভগবান। আমি সেই নামে তাকে চিনতাম, বাবাও সেই নামই জানতেন। সেই নামেই বিল জমা করেছিলেন। বাবার দাখিল করা বিল এক অদ্ভুত কারণে, অবজেকশন খেয়েছিল। বাবাকে কেঁচে গণ্ডুষ করে নতুন করে বিল বানাতে হয়েছিল।
কেন? খুব সামান্য ব্যাপার। অ্যাটেনড্যান্টের দেওয়া রেভেনিউ স্ট্যাম্পে সই করা যে রসিদ সাবমিটেড হয়েছিল বিলের সঙ্গে, সেখানে তার সই ছিল হিন্দিতে। সেই সইয়ে তার নাম সে লিখেছিল ‘যমরাজ’। এদিকে অরিজিনাল বিলে তার নাম লেখা হয়েছিল, আমরা যা জানতাম… ‘ভগবান’। তাই বিল অবজেকশন।
অনেক পরে আমার চেনা ভগবান বলে সেই মানুষটিকে আমি পাকড়েছিলাম,
— নাম ভাঁড়ালে কেন তুমি, ভগবানদাদা?
উত্তরে সে যা বলল, শুনে আমি এককথায় বাকরহিত।
— কা বোলে ডাকদার সাহাব।
ওই অ্যাটেনড্যান্টরা সেই কালে স্টুডেন্টদের, মানে তখনও আদৌ ডাক্তার না হওয়া অর্বাচীনদেরও সম্মানার্থে ডাক্তারই বলতেন।
ভগবানদাদা যা বললেন তার সার কথা, ওঁদের মুলুকে হিরোদের নামে নামকরণ তো হয়ই, হরবখত অ্যান্টিহিরোদের নামেও নামকরণ হয়।
যেমন রামবিলাস, হরিভজন, এই সব নাম হয়, তেমনই আবার দুর্যোধন, রাবন ইত্যাদি নামও বিরল নয়। সেই ধারাতেই ভগবানদাদার পিতৃদত্ত নাম অপিচ পারিবারিক নাম হল যমরাজ।
কিন্তু এই পোড়া বাংলায় এসে, এই অ্যাটেনড্যান্টের কাজটি জোগাড়ের পর সে পড়ল বিপদে। তার নাম ‘যমরাজ’ জেনে কোনও বাঙালি রোগীর বাড়ির লোকই তাকে অ্যাটেনড্যান্ট রাখতে রাজি হয় না। সে আর ‘ডিউটি’ পায় না। কে আর জ্ঞানত চায়, তার রোগীর মাথার কাছে বসে ডিউটি দিক স্বয়ং যমরাজ। না বাঙালি তত উদারতার শিক্ষা পায়নি।
বিপদ বুঝে কিছুদিন পর তাই সেও পিতৃদত্ত নাম হেলায় ত্যাগ করেছে নিজেই।
— কা বোলে ডাকদর সাহাব, ঝামেলা উমেলা সমঝিয়ে হামার নাম বদলিয়ে নিলম।
যমরাজ পালটে ভগবান হয়ে গেলাম।
কেয়া কিয়া যায় সাহাব… পাপী পেট কা সওয়াল হ্যায় না!
★











উপভোগ্য!