চিকুনগুনিয়াকে কেন ডেঙ্গুর ভাই বলছি? কারণ চিকুনগুনিয়া (Chikungunya) ডেঙ্গুর মতই একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ; প্রাথমিক লক্ষণগুলিও একরকম এবং একই প্রজাতির এডিশ মশার কামড়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া হয়। তবে চিকুনগুনিয়া গুরুতর হলেও ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের মত মারণঘাতী নয়।
চিকুনগুনিয়া রোগের ভাইরাসটির নাম চিকুনগুনয়া ভাইরাস (CHIKV) যেটি আলফা ভাইরাস গোত্রের এবং টোগাভাইরাস পরিবারের। সংক্রামিত স্ত্রী এডিশ ইজিপটি অথবা অ্যালবোপিকটাস মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া রোগ হয়। প্রবল জ্বর এবং গঁাটে গঁাটে বা সন্ধিতে সন্ধিতে এবং মেরুদণ্ডে প্রবল ব্যথা এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ১৯৫২ সালে তানজানিয়ায় প্রথম চিকুনগুনিয়া ভাইরাসকে পৃথক করা যায়। ১৯৬০এর দশক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব এবং কোন কোন জায়গায় মহামারী দেখা যায়। এটিও একটি ক্রান্তীয় অঞ্চলের (Tropical) পতঙ্গবাহিত রোগ। ২০০৬ থেেক এই রোগের পুনরাবির্ভাব (Reemergence) ও বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। ভারতে ও অন্যত্র বেশ কিছু স্থানীয়স্তরের মহামারী (Outbreak) দেখা যায়।
চিকুনগুনিয়া শব্দটির উৎপত্তি পূর্ব আফ্রিকার সোয়াহিলি জনজাতিদের শব্দভাণ্ডার থেকে। এর অর্থ যন্ত্রণায় বেঁকে যাওয়া। এই জ্বরে দেহের গ্রন্থিগুলিতে প্রবল যন্ত্রণা হয় যা কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর অবধি থেকে যেতে পারে। এডিশ মশা দিনে কামড়ায়। মানুষের দেহে জীবাণুর যৌন চক্র এবং মশার দেহে অযৌন চক্র সংঘটিত হয়। অল্প জলে ঘরের আনাচে কানাচে এডিশ মশা ডিম পাড়ে। জলের সংস্পর্শে ডিম থেকে লার্ভা, লার্ভা থেকে পিউপা, পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হয়। সংক্রামিত মানুষই হল এই রোগের উৎস (Source) এবং আধার (Reservoir)।
সংক্রামিত মশার কামড়ের ২ থেকে ১২ দিনের মধ্যে মানুষের দেহে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ ও লক্ষণগুলি দেখা যায়। আকস্মিক প্রবল জ্বর। ৪-৭ দিন থাকে। এর সাথে শীতভাব; মাথা, চোখের পিছনে পিঠ এবং সারা দেহের পেশী ও গ্রন্থিগুলিতে ব্যথা; কারো কারো চোখে কংজাংটিভাইটিস এবং লসিকাগ্রন্থির প্রদাহ। ৬০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে চামড়ায় লালচে রঙের ছোট ছোট গোলকৃতি ফুসকুড়ি (Morbiliform or Maculopapular rashes) দেখা যায় যা ৩-৭ দিন থাকে। অনেক ক্ষেত্রে চুলকায় (Prurities)। অনেকের ক্ষেত্রে ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণের জন্য দেহাকাণ্ড এবং হাত ও পায়ের চামড়ায় লালচে বিবর্ণ দাগ (Purpura) দেখা যায়। এছাড়াও কফি রঙের বমি, পেট ব্যথা, নাক দিয়ে রক্তপাত, চামড়ায় লালচে ছোপ (Petechiae) দেখা যায়। শরীরের গ্রন্থিগুলির, বিশেষ করে হঁাটু, গোড়ালি, কোমর, মেরুদণ্ড, কব্জি, কনুই ও আঙ্গুলগুলির প্রদাহ (Inflammation), যন্ত্রণা (Arthropathy), স্ফীতি (Swelling) ও শক্ত হওয়ার (Striffness) ঘটনা ঘটে। গ্রন্থিগুলির তীব্র যন্ত্রণায় রোগীরা খুব কষ্ট পান। আবার কোন কোন চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোন উপসর্গ ও লক্ষণ দেখা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে একইসাথে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ (Co-infection) পাওয়া যায়। HLA-B27 লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন সম্পন্ন ব্যক্তিরা চিকুনগুনিয়ায় বেশি ভোগে। প্রাদুর্ভাবপূর্ণ (Endemic) এলাকায় লোহিতকণিকার সাথে চিকুনগুনিয়ার জীবাণুু থেকে যায় (Recrudescence)।
একসময় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াকে শহর ও শহরতলির রোগ (Urban and peri-urban diseause) বলা হত। এখন শহর ও গ্রাম সর্বত্র ছড়ি পড়েছে। ১৬-২৮০ সেলসিয়াস উষ্ণ তাপমাত্রা, ৬০-৮০ শতাংশ আদ্রতা এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে এডিশ মশার বংশবৃদ্ধি হয়। এডিশের ডিমগুলি প্রবল শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যেও এক বছরের বেশি টিকে থাকে (Dessication)। সামান্য জল পেলেই একদিনের মধ্যে লার্ভার পরিণত হয়।
এনজাইম লিনকড্ ইমিউনোসরবেন্ট এসে (ELISA), আর টি—পি সি আর, ভাইরাস আইসোলেশন প্রভৃতি পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় করা হয়। নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। কোন কোন জায়গায় MV-CHIK টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। জ্বর ও ব্যথার জন্য সঠিক মাত্রায় প্যারিাসিটামল ব্যবহার করা হয়। বিশ্রাম, বেশি করে জল পানের সঙ্গে গৃহ চিকিৎসককে অথবা হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখিয়ে চিকিৎসা করা বাঞ্ছনীয়। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে রক্তের শ্বেতকণিকা ও অনুচক্রিকা কমে যেতে পারে, কিন্তু হিমাটোক্রিট ঠিক থাকে।
প্রতিবিধানের উপর জোর দেওয়া হয়। এর প্রধান দিক বাহক মশার নিয়ন্ত্রণ। গর্ত ইত্যাদি বুজিয়ে ফেলা (Land Filling and Source Reduction); সঠিক পদ্ধতিতে জল সংরক্ষণ (Proper Water Storage Practice) ও সাতদিনের একবার জমানো জল পাল্টানো; লার্ভাঘাতী স্প্রে ব্যবহার; জলাশয়ে লার্ভাভুক গাপ্পি, গাম্বুসিয়া মাছ ছাড়া; সঠিক নিষ্কাশন ও পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা করা; সঠিকভাবে বর্জ্য সংস্থাপন প্রভৃতির মাধ্যমে মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। পতঙ্গ সমীক্ষার (Vector Survey) কয়েকটি সূচক :
হাউজ ইনডেক্স (HI): যে গৃহগুলিতে এডিশ মশা পাওয়া গেছে
সবশুদ্ধ যে কটি গৃহে সমীক্ষা করা হয়েছে ´১০০
কনটেইনার ইনডেক্স (CI): যে কটি জল রাখা বা জমা পাত্র বা জায়গায়
এডিশ মশার লাভা পাওয়া যায়
যে কটি পাত্র স্থান সমীক্ষা করা হয়েছে ´১০০
Breteau Index (BI): যে কটি পাত্রে ও স্থানে লার্ভা পাওয়া গেছে
যে কটি গৃহে সমীক্ষা করা গেছে ´১০০
Man Per Hour Density (MPHD): যে কটি স্ত্রী এডিশ মশা ধরা গেছে
যত মিনিট মশা ধরার কাজে ব্যয় হয়েছে
´যতজন কর্মী নিয়োজিত ছিলেন
যে অঞ্চলে আগে চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যায়নি সেখানে এক বা একািধক রোগীর রক্তপরীক্ষায় চিকুনগুনিয়ার জীবাণু পাওয়া গেলে তাকে মহামারী (Outbreak) বলা হয়। ২০০২ সালে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর যে ‘জাতীয় পতঙ্গবািহত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (NVBDCP) গ্রহণ করে তাকে ১) ম্যালেরিয়া, ২) ডেঙ্গু, ৩) জাপানি এনকেফেলাইটিস, ৪) কালাজ্বর ও ৫) লিম্ফ্যটিক ফাইলেরিয়াসিস এর সাথে ৬) চিকুনগুনিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৫ সালে এই জাতীয় কর্মসূচিটি জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (NRHM) সাথে সংপৃক্ত হয়। ২০১৯ এ দেশের ২১টি রাজ্য ও তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৮১,৯১৪ জন চিকুনগুনিয়া রোগী সনাক্ত করা গেছে যায় মধ্যে ১২,২০৫টি (১৪.৯%)টি রক্তপরীক্ষায় প্রমাণিত। ২০২৩এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ একটি টিকা বের করেছে (IXCHIQ) যা ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। অনেক কিছু জানলাম। ডাক্তার বাবাকে ধন্যবাদ জানাই।