“ডায়াস্টেসিস এটা!”
“ফ্র্যাকচার নয়? উপরের জিগজ্যাগ লাইনগুলো দেখে তো ভাঙা বলেই মনে হচ্ছে।”
“ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যেখানে খুলির জোড়াটা (suture) লাগানো ছিল, তীব্র আঘাতের ঘায়ে সেটা খুলে গিয়ে দু পাশে সরে গিয়েছে কপালের হাড়। তবে পিছনের লাইনগুলো ফ্র্যাকচারের সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।”
“ব্রেনের সিটি স্ক্যান রিপোর্টে কোন ইন্টার্নাল হেমারেজ চোখে পড়ল না! তাহলে তো এক্ষুনি কোন কিছু করার প্রয়োজন নেই! তাই না?”
“ঠিক। মস্তিষ্কে এই মুহূর্তে কোন অপারেশন করার প্রয়োজন নেই। শুধু বিশ্রী ভাবে ফেটে যাওয়া কপালটাকে সুন্দরভাবে রিপেয়ার করে দিতে হবে।” হালকা হেসে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সিনিয়র।
আমাদের হাসপাতালের সিটি স্ক্যানের কনসোল রুমের ভিতরে, মনিটরের দিকে তাকিয়ে কথোপকথন চলছিল আমাদের দুজনের। সারা দিন যাবত একটা লম্বা মস্তিষ্কের অপারেশন শেষ করার পর ক্লান্ত উভয়েই। কিন্তু ইমারজেন্সি পেশেন্ট তো আর সময় বুঝে আসেনা। যখন আসার সে তখনই আসবে। আজ সকালেই তমলুকে ঘটে যাওয়া একটি মারাত্মক রোড ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্টের পেশেন্ট বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা বেলা এসে উপনীত হয়েছে আমাদের ইমার্জেন্সিতে।
একুশ বছর বয়সী একটি তরুণ যুবক, নাম ইকবাল। বাইকে করে আরো দুই বন্ধুকে নিয়ে চলেছিল সে মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে। হাইওয়েতে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাত ঘটেছে তাদের। হেলমেট পরেছিল কিনা সেটাও জানা নেই। চালক রাস্তার বাঁদিকে পড়ায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। পিছনের একজন ডান দিকে পড়ায় উল্টো দিকের গাড়িতে রান ওভার হয়ে এখন মেদিনীপুর হাসপাতালের মর্গে। তিন নম্বরের খবর জানা নেই।
ইকবাল অবশ্য এইসব কিছু জানে না। সে আপাতত ইমার্জেন্সি বেডে শুয়ে রয়েছে চুপচাপ। তার শরীরের ডান হাতে এবং ডান পায়ের বিভিন্ন হাড্ডিতে ছোট-বড় ফ্র্যাকচার রয়েছে। আর ঠিক কপালের মাঝখান থেকে ব্রহ্মতালু অবধি এঁকেবেঁকে উঠে গেছে একটা ত্বক ফাটানো ল্যাসারেশন। যার ভিতরে মাথার হাড় উঁকি মারছে,রক্তপাতের মধ্যেই।
মনিটরের মধ্যে যে ছবি আমরা দেখছি তাকে বলে থ্রি ডি রিকনস্ট্রাকশন। সি টি স্ক্যানের বিভিন্ন কাট মিলিয়ে কম্পিউটার তৈরী করে দেয় এই ইমেজ। সাধারণ মানুষের পক্ষেও এক পলকে এই ছবি দেখে বুঝে যাওয়া সম্ভব চোটের গভীরতা ঠিক কতটা। নিউরোসার্জেনের পক্ষে তো বটেই, ই.এন.টি. অথবা ফেসিওম্যাক্সিলারি সার্জনদের জন্য বিশেষ কাজের বস্তু এটা।
ছবিতে যতই বীভৎস দেখাক রোগী কিন্তু একেবারেই অতটা খারাপ নয়। ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে কোন অভিযোগ তার প্রায় একদমই নেই। অতগুলো ভাঙাচোরা নিয়েও হাত পা নাড়িয়ে দেখাচ্ছে বললেই। শরীরের চারিদিকে বিভিন্ন রকমের টিউবের সঞ্চালন চালু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। নার্স আর ইমার্জেন্সি ডাক্তারেরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত ।এতগুলো ভাঙাচোরা দেখে বড় অর্থোপেডিক টিম এসে গম্ভীরমুখে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে। আমাদের নিউরোসার্জারি ক্লিয়ারেন্স দিলেই ওদের কাজকর্ম শুরু হয়ে যাবে।
এর মধ্যেই কোভিড ইমার্জেন্সির নার্স আর ডাক্তাররা তাদের কাজ নিয়ে তুমুল ব্যস্ত। পিপিই পড়ে ত্রস্তপায়ে ছোটাছুটি অব্যাহত রয়েছে। স্যানিটাইজেশন চলছে একটু পরে পরেই।
সারাদিনের অপারেশনের ক্লান্তি নিয়ে এখন ইকবালের কপালটাকে নিয়ে বসতে হবে আমায়! নিজের কপালকে আর গালাগাল দিয়ে ভারাক্রান্ত করলাম না। অর্থোপেডিক টিমকে ওদের অপারেশনের জন্য তৈরী হতে বলে বসে গেলাম ইকবালের কপাল নিয়ে।
কাজ করতে করতেই বুঝতে পারলাম সিনিয়রের হাসির মর্ম। যার সাথে জড়িয়ে আছে আরো একটি দুঃখজনক ঘটনা।
এই কোভিডের জ্বালাতনের মাঝখানেই আমাদের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছিল এরকমই একটি হেড ইঞ্জুরি পেশেন্ট। টাক মাথা, বছর তিরিশেকের এক যুবক। লকডাউন চলাকালীন একরাতে নির্জন রাস্তায় সে বাইক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মাথা ফাটায়। তার ব্রেনের ভেতরেও ইন্টার্নাল ইঞ্জুরি তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু বাঁ চোখের ভুরু থেকে মাথার মাঝখান পর্যন্ত অনেকটা হাইওয়ের মতো একটি ল্যাসারেশন ছিল। বাইরের কোন ক্লিনিকে কেউ একজন তাড়াহুড়োতে রিপেয়ার করায় সেটি যেন আরো বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে ছিল আকাশ পানে। মাথায় চুল না থাকায় সেটাকে আর লুকিয়েও রাখা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল যে ছেলেটির নাকি অনেকদিন ধরেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এই কোভিড টোভিডের চক্করে শুভমুহূর্ত ঠিক করা হয়ে উঠছে না। আর এর মধ্যেই তিনি তালেগোলে ঘটিয়েছেন এই কীর্তি! লকডাউনের বাজারে ফাঁকা রাস্তায় কিভাবে ছেলেটা বাইক থেকে পড়ে গেল তাই নিয়েও রয়েছে নাকি অনেকরকম ধন্দ!
যাই হোক তার এবং তার পরিবারের অনুরোধে মাথার বিচ্ছিরি সেলাইটাকে সুন্দর করার দায়িত্ব পড়লো আমাদের উপর। বিয়ের পাত্র বলে কথা! সিনিয়র দায়িত্ব টা আমার উপরেই চাপিয়ে দিলেন চোখ বুজে।
নির্দিষ্ট দিনে আমি যত্ন করেই শুরু করে দিলাম কাজটা। আর চিন্তিত পেসেন্ট অপারেশন চলাকালীন আমাকে রানিং কমেন্ট্রি দিয়ে যেতে লাগলো তার বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে। সব কিছুর শেষে ঘুরেফিরে একটাই অনুরোধ “ডাক্তারবাবু কোন বিশ্রী দাগ যেন না থাকে!” টাক মাথায় বিচ্ছিরি দাগ থাকলে নাকি তার ভাবী বউ বলেছে বিয়ে ক্যানসেল।
যাইহোক অনেক আশা নিরাশার মধ্যে রোগীর ছুটি হয়ে গেল। ফলো আপ ভিসিটে পেশেন্ট ফিরে এলে আমরা উৎসুক হয়ে পড়লাম তার মাথার দাগ নিয়ে। দেখা গেল খুব সুন্দর আর সমান ভাবে জুড়েছে তার ক্ষত। টাক মাথায় একটি সূক্ষ্ণ দাগ ছাড়া আর বিশেষ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বিধি বাম। সে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানালো শেষ পর্যন্ত কন্যাপক্ষ বিয়ে বাতিল করে দিয়েছে।
না দাগের জন্য নয়। লকডাউনের রাতে সে বাইরে একা কি করতে বেরিয়ে ছিল সেই কারণে!
আমরা সবাই মিলে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এমনিতেও সেই মেয়েটির সাথে ওর হয়তো বিয়ে টিঁকতো না। উপদেশ দেওয়া হলো নতুন উদ্যমে পাত্রী খুঁজে বার করার। কিন্তু সে একেবারেই মুষড়ে পড়েছে এই হঠাৎ বিয়ে ভাঙায়। বললে “আমি ঠিক করেছি আর বিয়েই করবো না,স্যার।”
আমাদেরও খারাপ লাগছিলো। আমাদের এত যত্নের অপারেশন কোন কাজেই লাগলো না যে!
এইসব ভেবেই ইকবালের মাথায় রিপেয়ার চলছিল আমার। সারাদিনের লম্বা অপারেশনের শেষে। কিন্তু ছেলেটি গোটা অপারেশনেই ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে আপত্তি করল না এতটুকুও। সেটা অবশ করা ওষুধের গুণ না তার সহ্যশক্তি সেটা অবশ্য বোঝা গেল না। আমার কাজ শেষ হলে অর্থোপেডিক টিম ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল।
এরপর খবর পাচ্ছিলাম অপারেশন হয়ে গেছে ইকবালের এবং সে সুস্থই আছে। বিভিন্ন কাজের চাপে আমার আর দেখা হয়ে ওঠেনি ওকে। এছাড়া আমাদের দেখার ডাকও পড়েনি। দিন পাঁচেক বাদে একদিন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখা ইকবালের সাথে। আধশোয়া অবস্থায় বেডে, নার্স খাইয়ে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো ।চিনতে পারলো কিনা তা যদিও বোঝা গেল না।
আমি ওর কাছে গিয়ে মাথার ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখলাম। খুব সুন্দর শুকিয়ে এসেছে। যদিও ইকবালের মাথাভরা চুল এবং সেলাইয়ের বেশিরভাগ অংশটাই চুলের ভিতরে। তবুও বোঝা গেল সেলাই কাটার পর একটা সূক্ষ্ণ দাগই পড়ে থাকবে খালি। চেষ্টা না করলে বাইরে থেকে বিশেষ বোঝাও যাবে না।
সেই টাক মাথা হবু বরটির কথা ভেবে এবার একটু খারাপই লাগলো আমার।
Osadharon lekha… Kichhu mone na körle contact number ta ki pete paari?
Hoyto bipod e konodin onek kaaj e lagbe .