দামিনী নাগ। বাড়ি দুর্গাপুরে। পেশায় আইনজীবি।হাইকোর্টের মামলায় অংশগ্রহণ করতে আসছিলেন ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে কলকাতায়। রাস্তায় আচমকা উল্টোদিক থেকে একটা গরু ঢুকে পড়ায়, তাকে প্রাণে বাঁচাতে গিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে উল্টে যায় গাড়ি।
দীর্ঘক্ষণ অজ্ঞান থাকার পর দামিনী নিজেকে আবিষ্কার করেন হাইওয়ের কাছে এক হাসপাতালে, স্থানীয় মানুষের বদান্যতায়। শরীরের উপরিভাগের তীব্র যন্ত্রণার সাথে বুঝতে পারেন নিম্নাঙ্গে কোন সাড় পাচ্ছেন না। পা দুটো চেষ্টা করেও নাড়ানো যাচ্ছে না।
তার ঠিক দিন কয়েক পরের ঘটনা। আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। মে মাসের গরম, এই কোভিডের উৎপাত সবে শুরু হয়েছে তখন। লকডাউন আর সংক্রমণের গণ হিস্টিরিয়া তৈরী হচ্ছে আস্তে আস্তে।
MRI scan-এ পরিষ্কার দেখা গেল পিঠের মেরুদন্ডের মধ্যবর্তী দুটি ভার্টিব্রা ভেঙেছে সেই তীব্র আঘাতের ফলে। স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরি হয়ে নাভির ঠিক নীচ থেকে অসাড়। দুই পা চলনশক্তিরহিত। ডাক্তারি ভাষায় ‘ট্রমাটিক প্যারাপ্যারেসিস’!
অপারেশন করার সময় বোঝা গেল যা স্ক্যান দেখাচ্ছে অবস্থা তার থেকেও গুরুতর। চোট এতটাই সাংঘাতিক যে ভার্টিব্রা ফ্র্যাকচার হয়ে পিঠের মেরুদণ্ড নড়ে গেছে অনেকটা। ভিতরকার স্পাইনাল কর্ডও বদলেছে তার সরলরেখার মতো অবস্থান। এঁকেবেঁকে গেছে সাপের মতো।
স্ক্রু আর রড লাগিয়ে ফিক্স করে দেওয়া হলো মেরুদণ্ড। স্পাইনাল কর্ডের উপর চেপে বসা ভাঙা হাড়ের টুকরো কেটে বার করে দেওয়া হলো এমনভাবে যাতে আবার নিঃশ্বাস নিতে পারে স্নায়ু। কিন্তু নার্ভ এমনই এক তন্তু যা একবারের জন্যই দিয়েছেন উপরওয়ালা। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে নবজন্ম হওয়া খুব কঠিন।
কাজেই অপারেশন চলাকালীন আমরা বুঝতে পারছিলাম যতই যত্ন করা হোক না কেন, খুব শক্ত এই প্যারালিসিস থেকে নিম্নাঙ্গের সাড় ফেরৎ আসা। একপ্রকার প্রায় অসম্ভব। তবে মানুষের শরীর এমন এক বিশেষ পদার্থ যাকে নিয়ে শেষ কথা বলা কখনোই সম্ভব নয়। আসলে সমগ্র মেডিক্যাল সায়েন্সটাই তো তাই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আজকে যা অসম্ভব লাগছে কালকে দেখবেন সেটাই ঘোর বাস্তব।
অপারেশনের কয়েকদিন পর রোগীর ছুটির সময় এসে গেল। দুপায়ে প্যারালিসিসের কোন উন্নতি লক্ষ্য করা গেল না এই কদিনে। মাত্র তিরিশ বছরের মেয়েটির স্বামী,আর ছোট একটি ছেলে বর্তমান। আমরাও কোন আশার কথা শোনাতে পারলাম না। বাড়িতে ফিজিওথেরাপি ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা করে বাড়ির লোক অ্যাম্বুলেন্সে বর্ধমানে নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে গেলেন রোগীকে। বাকী জীবনটা কিভাবে এই অসাড় পা দুটোকে নিয়ে, অন্যের ভরসায় চলবে এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই বোধহয় বাড়ি চলে গেল মেয়েটি। স্ট্রেচারে শুয়ে আর ক্যাথেটারকে সঙ্গী করে।
গল্পটা এখানেই হয়তো শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলো না!
কোভিডের দাপাদাপিতে পরবর্তী কালে রুটিন ভিসিটে দামিনী আসতে পারেনি কলকাতায়। ফোনেই কথা হচ্ছিল পরিবারের সাথে আমাদের। দু’মাস আগের শেষ আলাপ অবধি আমরা জেনে ছিলাম খারাপ কিছু হয়নি আর।
কিন্তু দু দিন আগের ভিডিও কনসালটেশন দেখে আমাদের চক্ষুস্থির! পা নড়তে শুরু করেছে মেয়েটির! ক্যাথেটার বার করে দেওয়া হয়েছে মাসখানেক হলো, ফিরে এসেছে প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা আর কিছুটা নিম্নাঙ্গের সাড়। দু পায়ে জোর ফিরে আসছে অল্প অল্প করে। খাটে শুয়ে শুয়ে অনেক রকম ব্যায়াম করে দেখাল আমাদের ওর ফিজিওথেরাপিস্টের তত্বাবধানে। দেওয়াল বা কোন সাপোর্ট নিয়ে হাঁটতেও পারছে কয়েক পা।
আনন্দিত হলাম আমরা। চমৎকৃত হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান।
অনেক ঠাট্টা ইয়ার্কি করা হলো। সবই ওর মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য। এতটা যখন লড়েই ফেললো মেয়েটা, আরো খানিকটা নার্ভের রিকভারি হবে ধরেই নেওয়া যায়। ঠিক কতটা তা অবশ্য কারো পক্ষেই বলা অসম্ভব। তবে অপারেশানের দু’বছর অবধি উন্নতি হতে থাকবে ধরেই নেওয়া যায়।
ওকে উৎসাহিত করে সেদিনের কনসালটেশন শেষ হলো আমাদের।
মানসিক জোর কত যে কঠিন শারীরিক সমস্যার দিশা বদলে দিতে পারে দামিনীর কাহিনী তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
যেখানে এই কোভিডের যুগে সাধারণ সব শারীরিক সমস্যাগুলোকে জটিল করে দিচ্ছে মানসিক রোগ। প্রচুর রোগী আউটডোরে আসছেন মানসিক সমস্যা নিয়ে। হ্যাঁ,নিউরোসার্জারি ক্লিনিকেও। নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ ঘিরে ফেলছে অনেককেই। সর্বোপরি সবার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে চলেছে কোভিড। সব রোগের মধ্যেই কোভিডের ভূত দেখছি আমরা।
আমি এপিডেমিওলজিস্ট নই। আমার ডাক্তারি যুক্তি দিয়ে যেটুকু মনে হচ্ছে কলকাতায় আমরা কোভিডের প্রথম ওয়েভ শেষ করেছি। কেসের সংখ্যা এবং রিকভারি আমাকে সেই কথাই বলছে। কিন্তু এক ওয়েভে তো আর কোভিড যাবে না। মরটালিটি রেট আমাদের এখনো বেশ উপরের দিকেই।
স্প্যানিশ ফ্লুতে তিনটে ওয়েভ এসেছিল। সংক্রমণ ফিরে আসার কারণ ছিল মানুষের মাস্ক ব্যবহার করার অনীহা এবং বাঁধনছাড়া জনসমাগম। বিপুলভাবে ফিরে এসে প্রচুর মানুষের প্রাণ নিয়েছিল সেই মহামারী।
কলকাতায় সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে খুব সম্ভবত পুজোর পর। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এমনিতেই আমার আপনার চারিদিকে প্রচুর অ্যাসিম্পটোম্যাটিক পেসেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছেন,, যাঁদের মুখ দেখেও আপনি কিছু বুঝতে পারবেন না।
যেমন কাল সন্ধ্যায় আমি ইমার্জেন্সিতে কল্যাণ ব্যানার্জিকে দেখতে এসেছিলাম। বাঁকুড়া থেকে আসা তরুণ যুবক কল্যাণের ছোটবেলায় ব্রেন টিউমারের অপারেশন হয়। ভালোই ছিলেন বছর কুড়ি। গত দু দিন বাড়িতে খিঁচুনি হওয়াতে বাড়ির লোক কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। কালকে স্ক্যান করে দেখা গেল নতুন আরো একটা টিউমার গজিয়ে উঠেছে মগজে। অপারেশন করতে লাগবে আবার। ভর্তি করে আজ সকালে কোভিড টেস্ট গেল রুটিন। কোন করোনার ছায়া মাত্র নেই রোগীর উপসর্গে। রিপোর্ট এসেছে পজিটিভ। এখন কোভিড ওয়ার্ডে থাকতে হবে রোগীকে যতক্ষণ না নেগেটিভ হচ্ছেন। সেই কারণে অপারেশনও পিছিয়ে গেল ভদ্রলোকের।
তাই আমরা তো বটেই, আপনিও হয়তো পজিটিভ হয়ে বসে আছেন। আর অল্পের উপর দিয়ে চলে গেলেই তো ভালো। তাই পজিটিভ হয়ে যাওয়াটা এই মুহূর্তে আর খুব বেশি ‘নেগেটিভ ‘শোনাচ্ছে না। বাড়িতেই চিকিৎসা করা যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষের। বাড়াবাড়ি না হলে হাসপাতালে ভর্তি এড়ানো যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই।
তাই জীবনে যাই আসুক না কেন, কোভিড বা নন কোভিড, শারীরিক বা মানসিক সমস্যা, লড়াই করতে হবে সক্কলকে। দেখতে হবে যাতে মানসিক অসুবিধা শারীরিক সমস্যার লড়াইয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে।
উঠে দাঁড়াতে হবে যাবতীয় হতাশার মধ্যে থেকে আশার আলো হয়ে। ঠিক দামিনীর মতো। ফিল্মি নয়, রিয়েল লাইফের দামিনীদের মতো।