রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ঘরে ঢুকে জামাটা খুলে খাটের উপরে বইয়ের স্তুপের মধ্যে ছুড়ে ফেলে জুতো খুলে গা এলিয়ে দিলাম। খাটের অর্ধেকটা মোটা মোটা বইগুলো দখল করে নিয়েছে। এক সময় ওগুলো নিয়ে রাতদিন বসে থেকে অনেকগুলো বসন্ত ওদের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি তাই বোধহয় সহজে মায়া ছাড়তে পারিনে। এর অনেকগুলোই দরকার হয় আবার বেশ কিছু দরকার হয় না, তবুও রয়েছে। ফেলতে মায়া লাগে।
ছোট ঘর। এর মধ্যেই আমাদের দু’জন করে থাকতে হয়। দুটো হাসপাতালের রোগীর খাট দুদিকে পাতা। প্রত্যেকটা খাটের পাশে একটি ছোট টেবিল, একটি চেয়ার। আর মাঝখানে একটা পুরানো পাখা তার প্রত্যেকটা ব্লেডে পুরু হয়ে যাওয়া ঝুল। পরিষ্কার হয় না। চালালে ঘড় ঘড় শব্দ হয় প্রায়ই। আর ঘরের চারদিকে দড়ি টানানো। তাতে ঝুলছে জামা কাপড়। সবই অগোছালো অপরিষ্কার। একটু ভালো এক দু’সেট জামা কাপড় খাটের নীচের লোহার ট্রাঙ্কে রাখা। এটাই আমাদের যাবতীয় সম্পত্তি। টেবিলও বইপত্র, খাতা, এটাওটা দিয়ে ভর্তি। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পরে পরে একবার ঝাড়পোঁছ করি। তুলনায় তপনের টেবিলটা পরিষ্কার থাকে।
তপন আর আমি এক ঘরে থাকি। একসঙ্গে পড়েছি, একসঙ্গে এই হাসপাতালে এসেছি বিশেষজ্ঞ হতে। এখন তারই প্রাণপণ সংগ্রাম চলছে। “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” বললেও কেউ কান দেয় না। বসে কাঁদলেও বাঁচার কোন পথ নেই। এটাকেই ভবিতব্য এবং ভবিষ্যত হিসাবে মেনে নিয়েছি।
তপন ওর খাটে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে একটা বই পড়ছিল। সম্প্রতি ওকে কবিতার ভূতে ধরেছে। আমি ও সব বুঝিনা তাই মাথা গলাইনা।
এবার স্নান করে এসে ক্যান্টিনে খেতে যাবো। দুজনে রাত্রে একসঙ্গেই খেতে যাই।
উঠতে যাবো এমন সময় মোবাইলে গান বেজে ঊঠলো ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু’। ওটাই রিং-টোন বানিয়ে রেখেছি।
এত রাতে সাধারণত বাড়ির ফোন আসে। বাড়িতে বলে রেখেছি দিনে ফোন না করতে। অত চ্যাঁচামেচির মধ্যে কথা বলা মুশকিল। তাই সবাই রাত দশটার পরেই করে।
না বাড়ির ফোন নয়। পিসিমার ফোন। আমার মেজো পিসি। বনগাঁর কাছে গোপালনগরে থাকে। পিসিমা এত রাতে? কারোর শরীর খারাপ করলো না তো!
‘হ্যালো’… বলার পর ওপাশ থেকে পিসিমার গলা ভেসে এলো।
‘শঙ্কু’ কেমন আছিস? গলায় বেশি উদ্বেগ নেই। মানে তেমন কিছু হয়নি।
বললাম ‘ভালো, তুমি কেমন আছো? পিশেমশাই কেমন আছে?’
‘আমরা সবাই ভালো আছি!’
এক চিন্তা দূর হলো। কিন্তু এত রাতে তো পিসি ফোন করে না। কারণ খুঁজতে লাগলাম মনে মনে। এখন কারণ খোঁজাটা যেন চার্লি চ্যাপ্লিনের মর্ডান টাইমসের মতো হয়ে যাচ্ছে। সে যেখানেই নাটের মতো কিছু দেখছিল, সেখানেই রেঞ্জ দিয়ে টাইট দিতে যাচ্ছিল। অভ্যাসের বশে! আমাদেরও তেমনি হচ্ছে– জ্বর নিয়ে এলো তো কি কারণ হতে পারে, পেট খারাপ হলো তো কি কারণ হতে পারে, বুক ধড়ফড় করছে তো কি কারণ হতে পারে– সারাদিনই এই কারণের পিছনে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছি। নিজের পিসিমা ফোন করেছে তার পিছনেও কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু কারণ তো কিছু আছেই! বললাম ‘বলো পিসি, এবার তোমার আসল উদ্দেশ্যটা বলে ফেল।’
‘এই এমনি ফোন করলাম, তোর সাথে তো কতদিন কথা হয় না, দেখা তো দুরের কথা। তোদের বাড়ি গেলেও দেখা পাইনা।’
‘কি আর করবো বলো, যা চাপ যাচ্ছে! বাড়িতে যাওয়ার সময়ও পাই না।’
‘তা ঠিকই! তোদের যে কি কষ্ট বুঝি! তবে একবার পাশ করে বেরোলে আর কষ্ট নেই। কি আর করবি বল!’
‘না না পিসি, বেরোনোর পরে আরো কষ্ট আমাদের! একটা কথা আছে জানো তো ঢুকতে কষ্ট, ঢুকে কষ্ট, বেরোতে কষ্ট, বেরিয়ে কষ্ট। এরপর তো আসল লড়াই।’
‘শোন শঙ্কু যাই করিস শরীরের দিকে তাকিয়ে করিস। তোর পিসেমশায়ের দেখ মাস্টার মানুষ তাও সারাদিন বিড়ি খায় আর খক খক করে কাশে।’
‘পিসেকে বিড়ি খেতে বারণ কর, সিগারেট খেতে বলো। একজন হাই স্কুলের টিচার বিড়ি খাবে এটা মানা যায় না।’
মেজ পিসি ফোন ধরলে আর ছাড়তে চায় না। বকবক করেই যায়। তবে পিসির মনটা খুব ভালো। বাবার থেকে বয়সে বড়ো। তবুও সারাদিনের ক্লান্তির পর এত কথা বলতে ভালো লাগছে না। আহা ফোন ছাড়াও যায় না।
পিসি বলে চলেছেন—’সামনে তো পুজো। কতদিন আমাদের বাড়ী আসিস না। এবার আয়না পুজোয়।’
এটা ঠিক। পিসির বাড়ী অনেকদিন আগে গিয়েছিলাম। কোথাওই যাওয়া হয় না। বললাম কেন, ‘পুজোর কথা বললে পুজোয় কিছু আছে নাকি?’
‘না! পুজোয় আবার কি থাকবে? পুজো থাকবে। আর আয় পুকুরের মাছ ধরে খাওয়াবো। তুই তো মাছ খেতে ভালোবাসিস। একসময় তো পুকুর থেকে ছিপ ফেলে মাছও ধরেছিস।’
পিসিদের বাড়ীর লাগোয়া একটা বেশ বড়ো পুকুর আছে। সেখানে ছিপ ফেললে রুই, কাতলা ওঠে। জাল দিয়েও ধরা যায়। আমার ওখানে বেশ লাগে। গ্রামের সুন্দর পরিবেশ। মাঠ, ধান, পুকুর, মাছ, আমবাগান— সব মিলিয়ে দারুণ।
”বল, আসছিস তাহলে!
‘দেখি…।’
‘দেখি দেখি করিস না। আর একটা ব্যাপারও আছে?’
এবার বোধহয় এত রাতে ফোন করার আসল কারণ বেরোবে। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোবে।
‘আর কি কারণ…?’
‘তোকে একটা মেয়ে দেখাবো।’
‘আমাকে মেয়ে দেখাবে কেন?’ প্রায় চীৎকার করে বলে উঠলাম।
পিসি রোমান্টিক গলায় বললো, ‘আহা কেন মেয়ে দেখাবে? মেয়ে দেখাবো তোর বিয়ের জন্য।’
‘বিয়ে? আমার?’ কথাটা একটু জোরে হয়ে গেছিল।
সেটুকু শুনেই তপনের কবিতা মাথায় উঠে গেছে। বই বন্ধ করে বেড়ালের মতো গুটি গুটি পায়ে আমার পাশে এসে বসে মোবাইলে কান গুঁজে দিল। সেও সব শুনতে চায়। পিসি বলে চলেছেন ‘দ্যাখ তোর নয় নয় করেও আঠাশ হতে গেল বয়স। এখন বিয়ে করবি না তো কবে করবি? বুড়ো হয়ে গেলে?’
আমি বললাম – ‘নিজে পাইনে ঠাই আর শঙ্করাকে চাই! বিয়ে করে খাওয়াবো কি?’
‘ও সব ছাড়। বিয়ে করে বাপের হোটেলে ফেলে দিবি। তোর বাপ তো চালচুলো ছাড়াই বাইশে বিয়ে করেছিল। তার তুলনায় তুই তো দামড়া।’
‘না পিসি, আর কিছু দিন যাক। পাশ করে একটা চাকরি বাকরি পাই। তারপরে ভাববো।’
‘সে আমি বুঝবো। তুই এই পুজোতে অবশ্যই আসবি। এই বলে রাখলাম।’
বেশী আর কথা বলতে ভালো লাগছিল না। বললাম ‘আচ্ছা ছুটি পেলে দেখবো। এখন রাখি?’
‘সে রাখ। আমি আবার দুদিন পরে ফোন করবো। এদিকে মলি, জামাই ওরাও পুজোতে আসবে। তোর সাথে দেখা হয়ে যাবে।’
মলি পিসির মেয়ে। আমার চেয়ে দু বছরের ছোট। তার বিয়ে হয়েছে দু বছর আগে। ওরা ব্যাঙ্গালোরে থাকে।
‘ঠিক আছে রাখছি।’ বলে ফোন রেখে দিলাম।
তপন প্রায় লাফিয়ে উঠলো। ‘গুরু চলো। আমিও তোমার লেজুড় হয়ে যাবো। যদি আমার ভাগ্যে কিছু জোটে।’
‘তুই ওই আনন্দে থাক।’ বলে আমি তপনকে পাত্তা না দিয়ে উঠলাম। স্নান না করলে গা ঘিন ঘিন করছে। পুজো এলেও গরম কাটেনি। এখনো পাখা চালাতে হয়। আর সকাল থেকে এক জামা কাপড়ে থেকে অস্বস্তি লাগে।
স্নান করে এসে আমরা দু’জন তাড়াতাড়ি ক্যান্টিন থেকে খেয়ে এসে বসলাম। এখন কিছু গাল-গল্প চলবে। তারপর ঘুম। ঘুমানোর কোন সময় নেই। কোনদিনই বারোটার আগে নয়। প্রায় দিনই একটা দেড়টা বাজে। পাশের ঘরের কেউ এলো তো গল্প জমে গেল– ব্যাস। আজ কেউ আসেনি। আমি আর তপন।
‘শঙ্কর, আমরা কিন্তু যাচ্ছি তাহলে। এ সুযোগ ছাড়া নেই।’
‘ছুটি পাবি? ইউনিটকে সামলাবে?’
‘রানাদাকে চাপিয়ে দেবো। আর দরকার হলে অন্য কাউকে বলে দেবো।’
‘দেখা যাক’, বলে বিছানায় বসলাম। মশা আছে। মশারি টানাতে হয়। না তাতে কোন কষ্ট নেই। মশারির চার কোন বাঁধাই থাকে। সকালে পাশগুলো গুটিয়ে উপরে ওঠানো আর রাত্রে নীচে নামানো। মশারি ধোয়ার কোনো ব্যাপার নেই, কালক্রমে সে তার আসল রং হারিয়ে কালো হয়ে গেছে।
তপন একটা হারামজাদা। ওর পেটে কোন কথা থাকে না। কথারা পেটে গিয়ে ডালপালা মেলে। তাই ওকে বেশী কিছু না বলাই ভালো।
তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো আলো নিভিয়ে দিলাম। সবার টেবিলে টেবিলে ল্যাম্প আছে। দরকারে সেটা জ্বেলে পড়ে। অন্যরা ঘুমায়। তপন টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিল।
যাবো পিসির বাড়ি? বিয়ে করতে যে ইচ্ছে হয় না, তা নয়, কিন্তু পরিস্থিতি এমন একটা তালগোল পাকিয়ে আছে যে সময় বা অর্থ কোনোটাই নেই। বাবার ঘাড়ে বউকে ফেলে দেবো– সে হয় না। তবুও তবুও কারও সাথে একটু মনের কথা একটু গল্প– সেও আমাকে আপন ভাববে, আপন করে চাইবে…। মাঝে মাঝে দেখা হবে। দেখা না হলে ছল ছল করে পাখীর নীড়ের মতো করে চাইলে কার না সাধ হয়! না দেখি— দেখেই আসি না, সে কোন জন। পিসি কাকে দেখাবে? না! কাল গিয়ে ছুটির ব্যাপারে কি করা যায় ভাবতে হবে। আজ বেশ একটা রোমান্টিক ঘুম হবে। এমনিতেই আ্যডমিশন ডে, আজ আমাদের ইউনিটের নয়। তার উপরে পিসির রোমান্টিক প্রস্তাব। ঘুম এসে গেল।
সকালে তপনের সাথে বিশেষ তেমন কথা হলো না। এমনিই বেলাতে ঘুম ভাঙলো প্রায় সাড়ে আটটায়। তারপর স্নান করে গোছগাছ করে টিফিন খেয়ে যেতে যেতে সাড়ে ন’টা বেজে গেল। দেরী হয়ে গেল। তপন আজ আগেই বেরিয়ে গেছে। কলবুক পেয়ে। ওদের ইউনিটের আজ অ্যাডমিশন ডে।
গিয়ে ফাইল নিয়ে তাড়াতাড়ি রাউন্ড দিয়ে টেবিলে বসলাম। তপনও টেবিলে বসেছে, অন্যদিকে দু’জন সিস্টার বসা। টেবিল ভর্তি ফাইলের স্তুপ। একেক জন পেসেন্টের একেকটা ফাইল। মিতু সিস্টার মিচকে হেসে বললো, ‘ডক্টর সরকার পুজোতে যাচ্ছেন?’
‘কোথায়?’
‘মেয়ে দেখতে?’
তার মানে তপন এসে আগেভাগেই সব বলেছে। নিশ্চয়ই কিছু রং লাগিয়ে বলেছে। ও একটা হারামজাদা। পেটপাতলা।
‘কার জন্যে সিস্টার?’ রানাদা ঢুকতে ঢুকতে বললো।
‘ডাঃ সরকারের! পুজোর পরে বিয়ে।’
‘..তাই নাকি শঙ্কর। কংগ্রাচুলেশন।’
আমি অবাক, এর মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল। তপনের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘– তপন এবার বলেছে আমার বাচ্চার মুখেভাত কবে’?
‘রাগছ কেন গুরু। এতো খুব ভালো খবর। আমার ওরকম একটা পিসি থাকলে আমি এতদিন বাচ্চা কোলে করে ঘুরে বেড়াতাম।’
রানাদা বসে বললো, ‘ঘটনা কিরে শংকর?’
‘কিছুনা, মেজ পিসি বলেছে পুজোয় যেতে। বেড়াতে যাবো।’
‘শুধু বেড়ানো নয়, দেখাশোনাও হবে। একসাথে রথ দেখা ও কলাবেচা।’ তপন ফুট কাটলো।
‘বা! দারুণ খবর! লাগিয়ে দে যৌবন তো বসে থাকবেনা। পরীক্ষায় দুবার গাড্ডা মারলেও আবার বসতে পারবি। কিন্তু দুটো বসন্ত চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।’
বললাম ‘তোমার তো বেশ কয়েকটা পেরিয়ে গেছে। তুমি বসে আছো কেন?’
বলতে বলতে স্যার ঢুকলেন। আর আমরা কেউ কোন কথা বললাম না এবার রাউন্ড শুরু হবে।
পুজো এসে গেছে। আর দিন দশেক। পুজোর মধ্যে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। বরং কলকাতায় থেকে ঘরে শুয়ে বসে কাটাতে ভালো লাগে। আর ওই সময় হাসপাতালে ডিউটি কম থাকে। ঘরে থাকলাম, সন্ধ্যে বা রাত্রে ডিউটির ফাঁকে এক দুদিন একটু হেঁটে ঘুরলাম—এই ভালো। এর মধ্যে সময় পেলে অষ্টমীর দিনে বাড়ী গিয়ে পাড়ার পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে আসি।
স্যারের রাউন্ড আজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আসলে বাইরের আকাশে বাতাসে পুজোর আমেজ শুরু হয়েছে, নেহাৎ কেউ দায়ে না পড়লে হাসপাতালে ভর্তি হয় না। তাই এখন চাপও কমে আসছে।
রাউন্ডের পর স্যারকে বললাম, ‘স্যার, এবার পুজোয় একটু ছুটি চাই।’
স্যার বললেন ‘কেন? কোথাও বেড়াতে যাবে?’
ফচকে মিতু সিস্টার পাশ থেকে বলে উঠলো– ‘না স্যার। বিয়ে করতে।’
স্যার বিস্ময় নিয়ে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই নাকি?’
আমি অস্বস্তিতে পড়ে বললাম, ‘না স্যার, পিসির বাড়ী যাবো।’
তপন এবার আবারো ফোড়ন কাটলো, ‘শুধু বেড়ানো নয় স্যার। ওখানে একটা দেখাশোনার ব্যপারও আছে।’
‘তাহলে তো ছুটি দিতেই হবে।’ তারপর স্যার রানার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রানা! এবার তপনকে নিয়ে পুজো তুমি সামলাবে।’
তপন বলে উঠল, ‘স্যার, শংকরকে সামলাতে যে আমাকেও যেতে হবে।’
‘ও ঠিকই তো। তাহলে তুমিও যাচ্ছো। যাও। রানা তুমি একাই তাহলে দেখো। আর দরকারে ডাঃ সোমের পিজিটিকে ডেকে নিও। আমি ডাঃ সোমকে বলে দেবো।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘শংকর আমাকে ছবি দেখিয়ো। আমি কিন্তু ছবি দেখে খুব ভালো predict করতে পারি।’ বলে মুচকি হেসে স্যার বাইরে পা বাড়ালেন।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য আগে যাওয়া হলো না। অন্যরাও যাবে। তাই প্রথম দু’দিন ডিউটি সামলে নবমীর দিন সকালে আমি আর তপন মেজ পিসির বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
মেজ পিসির বাড়ি যেতে গেলে আগে বনগাঁ যেতে হয়। সেখান থেকে বাস ও ট্রেন বা অটোতেও গোপালনগর যাওয়া যায়। আমরা ট্রেনকেই বেছে নিলাম। বেশ ফাঁকা ট্রেন। বনগাঁ থেকে রানাঘাট লাইনের ট্রেন। লোকজন কম। গোপালনগর ষ্টেশনে নেমে একটা টোটো নিয়ে পৌছে গেলাম পিসি বাড়ি।
বনগাঁ-চাকদা মেন রোদ থেকে আরেকটা রাস্তা গোপালনগর। বাজারের কাছ থেকে চলে গেছে উত্তর দিকে। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই পিসিদের বাড়ি। এখন আশেপাশে বেশ বসতি হয়ে গেছে। আগে যখন এসেছিলাম তখন আরো ফাঁকা ফাঁকা ছিল, গ্রাম্য ভাবটা বেশী ছিল। তবুও পিসিদের বাড়িটাই দু’বিঘে জমির উপরে। তার দক্ষিণে রাস্তা। উত্তর দিকে আমবাগান। সেখানে নারকেল, সুপারি, কাঁঠাল গাছ, জাম গাছ সবই আছে। তার উত্তরে বড়ো একটা পুকুর। পুকুরের পাড়ের উচু জমিতে বেশ কিছু ফলের গাছ, তরকারী গাছ। আর পুকুরে অনেক মাছ। আমার দারু্ণ লাগে এখানে এলে। তপনও বললো, ‘এবার তোর পিসি বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতে হবে।’
নবমীতে আমরা গিয়ে আনন্দে হৈ-হুল্লোড়ে কাটালাম দুপুরটা। মলি এসেছে, প্রশান্ত এসেছে। সে এক এলাহি আয়োজন। পুকুরের মাছ, খাসির মাংস, নানারকম মিষ্টি, পায়েস যতো কিছু পারে পিসি করেছে। জামাই মেয়ে বলে কথা।
পুজো দেখার ব্যবস্থা হয়েছে বনগাঁ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। আমরা বেরবো রাতে প্রায় সারা রাতের প্রোগ্রাম। গাড়ি ঠিক করা আছে। রাত আটটায় আসবে। যদিও বনগাঁ শহরে বিকাল ৩ টার পরে গাড়ি চলাচল বন্ধ। শহরের বাইরে গাড়ি রেখে পদব্রজে ভ্রমণ।
এলাহি ব্যপারে। অনেক পুজো হয়। কোন কোন পুজো তো জৌলুসে এবং চাকচিক্যে কলকাতার যে কোন পুজোর সমান। হেঁটে হেঁটে পায়ে ব্যথা ধরে যায়। আবার কোন কোন পুজোর সামনে বিরাট লাইন। মলিও প্রশান্তকে নিয়ে প্রথম এসেছে কাজেই তার উৎসাহ আরো বেশী। আমরা প্রায় রাত তিনটে নাগাদ ঘরে ফিরলাম। পরের দিন প্রায় সকাল ন’টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো। আগেই অন্য সবাই উঠে গেছে আমাদের দেরী হলো।
আজই মেয়ে দেখতে যাবার দিন। পিসির সম্পর্কে আত্মীয়। পিসেমশাইরা দুই ভাই। ছোট ভাই বনগাঁয় থাকে। কি সব ব্যবসার সাথে যুক্ত। বনগাঁ বর্ডার এলাকা বলে এখানে নানারকম ব্যবসা চলে। তেমনি কোন export import ব্যবসার সাথে তিনি জড়িত। পাত্রী তাঁর বড় কন্যা। বনগাঁ কলেজেই বি.এ. পাশ করে এখন কলকাতায় এম.এ. পড়ছে।
ঠিক হলো আমরা টিফিন খেয়ে বেরোবো। যেতে আসতে আধঘন্টা আর ওখানে ঘন্টাখানেক সব মিলিয়ে দু’ ঘন্টার মামলা। আমরা দুজন, মলি-প্রশান্ত আর পিসি যাবে। পিসেমশাই নাকি আজ জম্পেশ করে চিকেন কষা রান্না করবে বাড়ি বসে। একটা গাড়ি বলা হয়েছে। কালকের গাড়িটাই। সেটা করে যাবো তাতে করেই আসবো।
বাড়িটা বেশ ভালো। প্রায় কাঠা চারেক জায়গার উপর দোতলা বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায়, ধনবান লোকের বাড়ি। শুধু বাইরেটাই নয়, ভিতরটাও বেশ পরিপাটি। বাড়ির একদিকে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। সেখানে কয়েকটা গাছ আছে। বাড়ির সামনে একটু খোলা জায়গা। সেখানে কিছু গাছ আছে টবে। আর কিছু মাটিতে বসানো।
বাড়িতে ঢুকে একটা বসার ঘর বেশ বড়ো। তার একপাশে একটা বেশ বড়ো দেওয়াল টিভি। সোফা সেট একদিকে বেশ সাজানো গোছানো ঘর। অন্যদিকে আলাদা সোফা। মাঝে একটা সেন্টার টেবিল।
প্রথমে আমরা সেখানে গিয়ে বসলাম। যেহেতু পিসির দেওরের বাড়ি আর মলির কাকার বাড়ি এ বাড়ি ওদের নিজেদের বাড়ির মতোই।
ঘরে ঢুকে আমরা বসলাম। মলি বসলো না। তরতর করে দোতলায় চলে গেলো। পিসি একটু বসেই উঠলো, বললো ‘শঙ্কু তোরা বোস, আমি একটু উপরে যাই।’ বসে রইলাম আমি, তপন আর প্রশান্ত। মলির বাবা বাজারে, মা আমাদের আপ্যায়ন করে ঘরে বসিয়ে উপরে গেছে – কন্যাকে এখন দেখতে পাইনি।
‘চলবে… ‘তপন বললো।
‘কি চলবে?’
‘প্রাথমিক পর্বে সব ঠিক আছে। তোর শ্বশুর বেশ মালদার পার্টি মনে হচ্ছে।’
প্রশান্ত হাসলো। বললো ‘তা ঠিক, কাকার পয়সা আছে অনেক।’
‘আর রাজকন্যা?’ তপন বললো।
তপন রহস্যময় হাসি হেসে বললো ‘আগে বলে দেওয়া ঠিক হবে? আর তো অল্প কিছু সময় পরেই চাক্ষুষ দর্শন হয়ে যাবে। ভালোই দেখতে।’
ধমক দিলাম তপনকে। ‘তুই চুপ করবি?’
তপন চুপ করে গেল। কিন্তু সাথে সাথে একটা বড়ো প্লেটে সরবত নিয়ে হাজির হলো মলি। পেছনে তার কাকীমা।
‘শঙ্কুদা, আমি এখন কনে বাড়ির লোক বুঝলি। ঢকঢক করে এক চুমুকে খেয়ে নে। আগে গলা ভেজা, না হলে কথা বলবি কি করে?’
‘তুই খুব ফচকে হয়েছিস! এই প্রশান্তর পাল্লায় পড়ে।’ সবাই সরবতের গ্লাস তুলে খেলাম। একটু তেষ্টাও পেয়েছিল ঠিকই।
মলি টিভি চালিয়ে দিয়ে প্লেট নিয়ে চলে গেল। আমরা বোকা বাক্সের দিকে চেয়ে থাকলাম।
বেশিক্ষণ থাকতে হলো না। একটু পরেই মলি আবার নীচে নেমে এলো। বললো ‘শঙ্কুদা, চল তোরা উপরে চল। দেখা সাক্ষাৎ পর্ব চুকে যাক।’
বেশি তাড়া না দেখিয়ে আস্তে আস্তে ধীরগতিতে উঠলাম। প্রশান্তও উঠলো।
মলি তার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলো, ‘তুমি উঠলে কেন? তুমিও আবার মেয়ে দেখতে যাবে নাকি? বোসো এখানে।’
প্রশান্ত ‘তাই তো’ বলে বসে পড়লো। আমাদের নিয়ে মলি দোতলায় উঠলো।
উপরেও বেশ কয়েকটা ঘর। তার একটার মধ্যে মলি আমাদের নিয়ে ঢুকলো। এটি সম্ভবত দোতলার বসার ঘর। এ ঘরটাও বেশ সুন্দর করে সাজানো। আসবাব কম, কিন্তু যা আছে সেগুলো বেশ ছিমছাম। একদিকে সোফাসেট, অন্য দিকে একটি সিম্পল খাট। দরকারে কেউ থাকতে পারে। এঘরেও একটি টিভি আছে। আর দেওয়ালের একদিকে বেশ ডিজাইন করা একটি সোকেস।
মলি আমাদের বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোরা বোস, আমি আসছি।’
আমরা বোকার মতো দুজনে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ, মলির আসতে দেরী হচ্ছে।
আমি উঠে দেওয়ালের শো-কেসের দিকে গেলাম। পরিপাটি করে সাজানো শো-কেস। বেশ কয়েকটা ট্রফি সেখানে। এ ছাড়া নানা রকম পুতুল, সো-পিস দু একটা মডেল, লাফিং বুদ্ধ এবং কিছু অ্যান্টিক কালেকশন। হঠাৎ করে দু’নম্বর তাকের মাঝখানটায় আমার নজরে পড়লো একটি নটরাজের মূর্তি। কিন্তু ভঙ্গিমাটা একটু অদ্ভুত ধরনের। যেন একেবারে জীবন্ত। আর জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে যেন সারা পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে।
মূর্তিটা আমার খুব চেনা মনে হলো। মনের ভিতর একটু হাতড়াতেই বেরিয়ে এলো তাইতো এ মূর্তি অবিকল আমার হারিয়ে যাওয়া মূর্তির মতো, যা গত প্রায় বছর খানেক ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তা কি করে সম্ভব! আমার বাড়ির শো-কেসের মূর্তি এখানে আসবে কি করে?
অবশ্য সেই মূর্তি নাও হতে পারে। ওই রকম মূর্তি তো নিশ্চয়ই আরও তৈরি হয়েছে। আমি হরিদ্বারে গিয়ে কিনেছিলাম। এরাও হয়তো সেখানে থেকে এনেছে, কিন্তু অবিকল একই। মূর্তিটা আমার খুব প্রিয় ছিল! বার বারই মনে হতে লাগলো– এ মূর্তি এখানে যেভাবেই আসু্ আমার সেই মূর্তি। শো-কেসের কাচ সরিয়ে সেটি পরখ করতে যাবো অমনি দরজায় শব্দ হলো। একসঙ্গে ঢুকে পড়লো মলি, পিসি, মলির কাকীমা আর কন্যা। আমি সরে এলাম। কিন্তু মনের দ্বন্দ্ব কাটলোনা।
আমি সোফায় বসলাম। মলি বললো, ‘দিয়া, তুই এটায় বোস।’ বলে কন্যাকে বসিয়ে দিল আমাদের পাশের সোফায়। পিসি, কাকীমা ও বসলো।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। মেয়ে দেখতে এসেছি – ব্যপারটাই কেমন সেকেলে। একটা প্রেম করতে পারলে আজ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। অবশ্য এটাকে অন্যভাবেও নেওয়া যায়— মেয়েও আমাকে দেখবে, তার পছন্দ আছে কি না। একদম না দেখে তো হয়না। আর এখন সেই হাঁটিয়ে, চুল টেনে, গা ঘষে পাউডার উঠিয়ে দেখার কথা ভাবাও যায়না। তাই এখন দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে পারস্পারিক পছন্দয় মেয়ে দেখা। কিন্তু দেখবো কাকে? যে সামনে বসে আছে– সে তো এক অপরুপ সুন্দরী। যেমন গায়ের রং তেমনি শার্প মুখের গড়ন, চলন, বলন, এমনকি স্টাইল। কে বলবে এই মেয়ে বনগাঁর গ্রাম্য পরিবেশে থাকে। তপনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে।
আমরা কেউ কিছু বলছিনা দেখে মলিই মুখ খুললো। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো ‘দিয়া, এই আমার শঙ্কুদা—ওরফে ডাঃ শংকর সরকার আর ইনি শঙ্কুদার বন্ধু ডাঃ তপন রায়। আর এই সুন্দরী মেয়েটি আমার বোন মাত্র দশ-মাসের ছোট দিয়া।’
‘আপনার নাম কি দিয়া? না অন্য নাম আছে?’ তপন মুখ খুললো।
দিয়া সপ্রতিভ উত্তর দিল। ‘না, আমার একটাই নাম।’
‘দিয়া মানে তো দ্বীপ বা প্রদীপ?’
‘হ্যাঁ।’
মলির মনে হলো গোল টেবিল বৈঠক শুরু হয়েছে। আর কারও না থাকাই বাঞ্ছনীয়। তাই পিসি ও কাকীকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বলে গেল, ‘কাকা এসেছে। নীচে প্রশান্তর সঙ্গে কথা বলছে। তোরা কথা বল আমি আসছি।’
ঘরে আমরা তিনজন। আমি, তপন আর দিয়া। তপন বললো ‘আপনার নাম সার্থক!’
‘মানে!’
‘আপনি যেখানেই যান, আলো হয়ে যায়।’ দিয়া হাসলো, হাসিটা সুন্দর। বললো ”থ্যাঙ্কস। দিয়ার মধ্যে কোন জড়তা নেই। বললো ‘যা কিছু আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’ আমার হয়ে তপনই বেশী কথা বললো। আমি একটা-দুটো কথা বললাম। আর কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই আমার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছিলো নটরাজের মূর্তি। আর আমি আলমারির দিকে তাকালাম। দিয়াও সেটা লক্ষ্য করলো। বললো ‘আপনি বার বার ওদিকে কি দেখছেন?’
‘কই! কিছুনা! এমনিই’ বলে বললাম শো-কেসের সবই কি আপনার জিনিস।
‘বেশিরভাগ আমার। দু একটা ভাইয়ের।’
আমার জানা দরকার ওরা হরিদ্বারে গিয়েছিল কিনা। বললাম– ‘বেড়ানোর শখ আছে?’
‘খুব।’
‘হরিদ্বারে গিয়েছেন কখনো?’
‘না। এখনো যাইনি। তবে পুজোর পরে যেতে পারি।’
আমার মাথাটা আরো ভারী হয়ে গেল। আমার আর কিছু জানার নেই। মেয়ে দেখতে যেমন বা কথাবার্তা যেমন তাতে অপছন্দ করার কোন জায়গা নেই। যদি আমাকে পছন্দ করে। সে কথা পরে জানা যাবে। আপাতত নটরাজ রহস্য আমার মাথায় চেপে বসলো। ওই নটরাজ আমার কি না, সেটা দেখতেই হবে।
মলি ঢুকে বললো ‘কিরে কথা বার্তা শেষ? না আরো আছে?’
হেসে বললাম ‘আমার শেষ।’ দিয়া দাঁড়ালো। ঘাড় ঝুকিয়ে দুহাত জোড় করে বললো ‘আসি।’
আমারাও প্রতিনমস্কার করলাম। ওরা বেরিয়ে গেল।
এই কিছু মুহূর্ত। এখনি আমাকে দেখে নিতে হবে। আমি তড়াক করে উঠে এগিয়ে গেলাম। সামনের স্লাইডিং কাঁচ সরিয়ে তুলে নিলাম মূর্তিটি। তারপর উলটে দেখলাম। নীচে S লেখা। আমি লিখেছিলাম। পিতলের রঙের উপরে মার্কার পেন দিয়ে অনেকদিন আগে লেখা। এখন পিতলের রং কালচে হয়ে গেছে। তবুও লেখাটা স্পষ্ট।
তপন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। তপন বললো, ‘বা! মূর্তিটা তো খুব সুন্দর।’
‘তপন, এটা আমার মূর্তি।’
‘এখানে এলো কি করে? সেটাই তো ভাবছি। আমার ঘরের আমার নটরাজ মূর্তি কি করে এখানে এলো?’ বলে মূর্তিটা যথাস্থানে রেখে আমরা এসে আবার সোফায় বসলাম।
তপন বললো, ‘তোর কি দিয়ার সাথে আগে পরিচয় ছিল? তোদের তো আত্মীয়।’
‘নারে! আমি তো এই প্রথম দেখলাম।’
‘তাহলে তোর বোন মলি এনে দিতে পারে।’
‘না। তা হবে না। আমার পছন্দের মূর্তি আমার ঘর থেকে আমাকে না বলে কেউ নেবেনা। আর আমিও মলিকে কখনো দিই নি।’
‘তবে? ভৌতিক মূর্তি। হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে?’ তপনের গলায় বিস্ময়!
আমরা কথা বলতে বলতেই আবার মলি ঢুকলো। সাথে দিয়া। ওদের হাতে বড়ো বড়ো প্লেট। তার মধ্যে নানারকম মিষ্টি। ওরা টেবিলের উপর রেখে পাশে বসলো। একে একে আবার অন্যরাও এসে গেল। পিসি, প্রশান্ত, দিয়ার মা এবং বাবা।
দিয়ার বাবার চেহারার সাথে পিসেমশাইয়ের চেহারার মিল আছে। তবে পিসেমশাই যেমন কম কথা বলেন, ইনি একটু বেশী। কিন্তু ভালোমানুষ বলেই মনে হলো।
অত মিষ্টি আমাদের কারও পক্ষে খাওয়াই সম্ভব নয়। তবু দু-একটি খেলাম। তারপর আমাদের ডিউটি, কাজকর্ম, বাড়ির খবর ইত্যাদি নিয়ে গল্প হলো। আমরাও ওনার কাজকর্ম ব্যবসা ইত্যাদি নিয়ে কথা বললাম। তারপর একসময় চলে এলাম। কিন্তু আমার এবং তপনের মাথায় ঘুপাক খেতে লাগলো কি করে আমার নটরাজ এখানে এলো।
পিসেমশায়ের জম্পেশ করে রান্না করা কষা মাংস খেয়ে আমরা দুপুরে একটা ঘুম লাগালাম। কাল রাতে ঘুম হয়নি ঠাকুর দেখার জন্য। বিকালে বাড়ি যাবো। একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে।
বিকাল পাঁচটা নাগাদ উঠলাম। হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এবার বেরোবো। প্রশান্ত এসে বসলো।
প্রশান্ত একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। কম্পিউটার গ্রাফিক্স এর উপর। ও ইঞ্জিনিয়ার। বেশ আমুদে। আমাদের মতো উল্টোপাল্টা ডিউটি নয়, ওদের ঘড়ি ধরে ডিউটি। পরিবারকেও যথেষ্ট সময় দিতে পারে। যদিও চাপ আছে।
মলি এসে যোগ দিল আমাদের সাথে। এ কথা সে কথা বলার পর বললাম- ‘মলি একটা রহস্য উদ্ধারে সাহায্য কর না?’
‘রহস্য?’
‘হ্যাঁ রহস্য। আচ্ছা বল তো আমার ঘরের নটরাজ মূর্তি দিয়ার ঘরের শো-কেসের মধ্যে কি করে এলো?’
মলিও অবাক হলো। ‘তাই নাকি? সে কি রে?’
প্রশান্তও অবাক হয়ে সন্দিগ্ধ ভাবে বললো, ‘এক মূর্তি নাও তো হতে পারে, হয়তো একই রকম দেখতে অন্য মূর্তি।’
বললাম, ‘না প্রশান্ত, আমি দেখেছি। ওটা আমার মুর্ত্ ওর নীচে দাঁড়ানোর স্ট্যান্ডে আমার নাম লেখা আছে।’
‘সে কি?’
‘হ্যাঁ। হ্যাঁরে মলি, তুই আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে এসে এদের দিসনি তো?”
‘ধুর।’ মলি বললো। ‘এসব মূর্তি- ফুর্তি নিয়ে আমার অত আগ্রহ নেই। আর আমি নিলেও তোকে না বলে কেন নেবো?’
‘তবে তো সত্যিই রহস্য’ প্রশান্ত বললো। ফেলুদাকে ডাকতে হবে। না হলে এই প্রশান্ত মিত্তিরকেই মাঠে নামতে হবে।
‘দেখো নেমে। আমার তো মাথামুন্ডু কিছু ঢুকছে না।সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়?’ তপন বললো।
‘ধুর! তাই বলা যায় নাকি? একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জেনে নিতে হবে।’
পিসিমা ঢুকলো। আমাদের আলোচনায় ছেদ পড়লো। আমরা সবাই বুঝলাম পিসির সামনে এ আলোচনা না করাই ভালো। পিসি এসেছে চা খাওয়ার তাড়া দিতে। পিসেমশাই রোজ বিকেলে সাড়ে পাঁচটায় চা খায়। তার সে সময় হয়ে গেছে। আমাদেরো গোছগাছ করে বেরুতে হবে। সাড়ে ৬ টায় গোপালনগর থেকে ট্রেন।
আমরা ঠিকসময়েই বেরিয়ে এসে ট্রেনে চেপে বসলাম। আবার সেই হাসপাতাল- আবার সেই ডিউটি।
আবার সেই রাউন্ড পার্টি মিট। পুজোর পরে এখন ধাক্কাটা বেশী। ভিড় বেশী।
রাউন্ডের পর পার্টি মিট শেষ। আমরা সবাই সেখানে বসে চা খাচ্ছি। আমি, তপ্ রানাদা ও স্যার—ডাঃ রায়।
চায়ে চুমুক দিয়ে প্রসঙ্গটা স্যারই তুললেন। ‘তারপর শংকর, তোমার মেয়ে পছন্দ হলো?’ স্যার বেশ কৌতুকপ্রিয় একটু পেছনে লাগা স্বভাব।
‘আরে তাইতো!’ লাফিয়ে উঠলো রানাদা। ‘কি হলো শংকর – বলিসনি তো!’
‘পছন্দ আবার হবে না? ডানাকাটা পরীর মতো দেখতে স্যার। বাবারও টাকা কড়ি আছে। সব দিকেই ভালো।’ তপন বললো।
‘তাহলে এই শীতেই লাগিয়ে দাও’ বলে হাসলেন স্যার।
‘কিন্তু …,’বললাম আমি…
‘আর যদি, কিন্তু রাখিস না। তাহলে একেবারে দাঁড়ি হয়ে যাবে।’ রানাদা বললো।
‘আহা রানা! শংকরকে বলতে দাও। সারা জীবন ঘর করবে, যদি- কিন্তু থাকলে হবে?’ স্যার রানাদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন স্যার, ‘বলো শংকর, তোমার সমস্যা বলো।’
আমি বললাম, ‘একটা রহস্য! মেয়েসংক্রান্ত কোন ঘটনা নয়, কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না।’
‘কি ব্যাপার?’
‘স্যার, আমার নটরাজের মূর্তি কি ভাবে ওই বাড়ির শো-কেসের মধ্যে চলে গেল?’ বলে সব ঘটনা বললাম।
‘সে কি রে!’ রানাদা বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো।
‘তোমার মূর্তি তো নাও হতে পারে, হয়তো একই দেখতে অন্য আরেকটি মূর্তি।’
‘না স্যার। আমি দেখেছি। আমার নাম রয়েছে। একই মূর্তি।’
‘তুই জিজ্ঞাসা করিসনি, এই মূর্তি কোত্থেকে এলো? ল্যাটা চুকে যেত।’
‘না রানাদা। সে সুযোগ পাইনি।’
‘তাহলে শংকর, তুমি বলছো তোমার মূর্তি ওদের বাড়ির শো-কেসে।’ স্যার একটু চিন্তা করলেন। তারপর ধীরে ধীরে যেন স্বগতোক্তির মতো কেটে কেটে বললেন ‘অথচ তুমি দাওনি’। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘তাহলে অন্য কেউ নিয়ে যায়নি তো। বলছো তোমার পিসির রিলেটিভ।’
‘না স্যার। তেমন ঘটেনি।’
‘তাহলে… তাহলে… ‘যেন একটু অন্ধকারে হাতড়ে কিছু না পেয়ে স্যার রানাদার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। ‘তাহলে… কি হতে পারে রানা?’
রানাদা একটু ভেবে মাথা দুলিয়ে বললো – ‘ভৌতিক কান্ড স্যার। মাথায় কিছু ঢুকছে না।’
স্যার ভ্রু কুচকে চায়ে শেষ চুমুক দিলেন। স্যার কিছু ভাবছেন। তারপর বললেন শংকর ওই মেয়ে তো তোমাদের আত্মীয়?
‘তেমন কিছু না স্যার। লতায়-পাতায়।’
‘সে না হয় সম্পর্কের জন্য তোমার বিয়ে আটকালো না, কিন্তু সে কি তোমাদের বাড়ি আসতো?’
‘না স্যার।’
‘একটু ভালো করে খোঁজ নাও তো?’ বুঝলাম স্যার সুতো খুঁজছেন। সমাধানের সূত্র হাতড়াচ্ছেন।
‘তুই তো আর বাড়ি থাকিস না, জানবি কি করে? ওই মেয়ে তোর নাম শুনে তোর প্রেমে পড়ে তোর বাড়িতে এসে তোর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে শো-কেসে সাজিয়ে রেখেছে। তাই তো স্যার?’
তারপর একটু মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বললেন স্যার, ‘একটু বেশিই কল্পনা হয়ে যাচ্ছে না?’
আমরা সবাই হেসে উঠলাম। স্যার হাসতে হাসতে বললেন—’হতেও পারে রানা। ‘There are more things in heaven and earth, than are dreamt of in your philosophy’ বলে বললেন ‘পড়েছ?’
‘না স্যার’, রানাদা উত্তর দিলো।
‘সেক্সপিয়ার। পড়ে দেখো। শুধু নেলসন নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?’
তারপর স্যার চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে উঠতে উঠতে বললেন – ‘শংকর তাহলে একটু খোঁজ নাও, দেখি তোমার রহস্যের সমাধান হয় কি না?’
স্যার চলে গেলে আমরা তিনজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। স্যার বোধ হয় কোন অনুমান করেছেন। দেখা যাক, স্যারকে দেখেছি রোগের ব্যাপারেও আমরা যেটা ভাবতে পারিনা স্যার সেটা ভাবেন – এবং শেষ পর্যন্ত সেটা মিলে যায়। আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন কোন উপসর্গ শেষ পর্যন্ত রোগ নির্ণয়ের প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সহজেই যেটা এড়িয়ে যাই। এক্ষেত্রেও তাই হবে হয়তো, তাই খোঁজ নিতে হবে।
খোঁজ নিলাম। মা বললেন, ‘হ্যাঁ। বছর খানেক আগেইতো দিয়া এসেছিলো তোর পিসির সাথে।’
‘আমি জানিনা তো!’
‘জানবি কি করে? তুই আর বছরে কদিন বাড়িতে থাকিস? তোর পিসিও একরাত থেকে চলে গেল। তাই দেখা হয়নি। তারপর বললো কেনরে?’
‘এমনি।’
‘এমনি বলেতো কিছু হয় না। তোকে দিয়া কিছু বলেছে?’ তারপর যোগ করে দিল ‘ভারী সুন্দর মিষ্টি মেয়ে। আমার কিন্তু পছন্দ।’
আমি ‘রাখছি’ বলে ফোন রেখে দিলাম। ফোন তো রেখে দিলাম। কিন্তু স্যারের অনুমানই কি ঠিক? দিয়া আমাদের বাড়ি এসে ওটা চুরি করে নিয়ে গেছে?
তা হয় নাকি? ওর বাবার অনেক টাকা। বাড়িও আমাদের থেকে অনেক ভালো। তবু দিয়া চুরি করবে কেন? কোন কিছু পছন্দ হতেই পারে কিন্তু তাই বলে লুকিয়ে কাউকে না বলে ওড়নার তলায় করে নিয়ে যাবে? তাই হয় নাকি?
না। মাথাটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হিসাব মিলিয়ে দেখলাম প্রায় বছর খানেক ধরেই আমি জিনিস্টা আমার ঘরে দেখছিনা। । তবে কি স্যারই ঠিক? ওই মেয়ে চোর? ধ্যুৎ। আর ভাববো না।
প্রতিদিনই সকালে রাউন্ডের পরে পার্টি মিট হয়। তারপরে স্যারের সাথে বসে আমাদের কিছু কথাবার্তা হয়। কোন রোগ নিয়েও আলোচনা হয়। সাহিত্য-সংস্কৃতি, এমনকি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও কথা হয়, নানা বিষয়ে স্যারের অনেক জ্ঞান। একাধারে তিনি আমাদের বন্ধুর মতো, আবার তাকে আমরা তেমনি শ্রদ্ধা করি।
পরের দিন পার্টি মিটের পরে স্যারই জিজ্ঞাসা করলেন। ‘শংকর খোঁজ নিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ স্যার। আমাদের বাড়িতে বছর খানেক আগে এসেছিল।’
‘তার মানে স্যার ওই মেয়ে চুরি করে নিয়ে গেছে?’ তপন বললো।
তপনের দিকে স্যার তাকিয়ে কিছু বললেন না। রানার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘রানা কি বলো?’
‘বেশী কষ্টকর মনে হলে কষ্ট করে কল্পনা করার দরকার নেই।’
রানাদা আমতা আমতা করে বললো, ‘না স্যার, আপনি যখন বলছেন হতে পারে। কিন্তু ওরকম বড়ো লোকের মেয়ে চুরি করবে? চাইলে তো অনেক মুর্তি কিনতে পারে।’
‘হ্যাঁ পারে। কিন্তু রানা মানুষ কি শুধু অভাবে চুরি করে? মানুষের মনটা বড়ো জটিল, বুঝলে। সে নিজেই জানে না সে কি চায়? তুমি কোনদিন বাস ট্রেনের টিকিট ফাঁকি দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ, দিয়েছি।’
‘সেটাও এক ধরনের চুরি। আমাদের কাছে পয়সা থাকা সত্ত্বেও বাসের ভাড়া ফাঁকি দিতে, অন্য কোথাও চুরি করতে চেষ্টা করি। এবং আনন্দ পাই। সে কি অভাবে?’
‘তা ঠিক স্যার।’ যেন রানাদা বাধ্য হয়ে বললো।
‘তাহলে ওই মেয়েই চুরি করেছে?’
‘সম্ভবত’, স্যার বললেন। ‘তবে এটা নির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনো আসেনি। অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে কোন অপরাধই অপরাধ নয়।’ ডাঃ রায় এখন ডাক্তার নয়। কোন তদন্তকারী গোয়েন্দা। তিনি সাক্ষী জোগাড় করতে চান। প্রত্যক্ষদর্শী।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘শংকর, তোমার পিসির সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? আর পিসিমা কেমন ধরনের মানুষ?’
‘খুব ভালো স্যার। পিসিমা খুব সরল মানুষ তবে কথা একটু বেশী বলেন, আর আমাকে খুব স্নেহ করেন।’
‘খুব ভালো। যারা বেশি কথা বলে তারা ভালো মনের মানুষ হয়। কোন কিছুই তারা সাধারণত গোপন করে রাখতে পারেন না। তুমি তোমার পিসিমার কাছে ওই মেয়েটার স্বভাব কেমন জানতে পারবে?’
‘বেশ করবো, স্যার।’
‘বেশ কথা হবে।’ বলে স্যার উঠলেন। আমরাও উঠলাম।
রাতে পিসিকে ফোন করলাম। আমি ফোন কম করি। আর কয়েকদিন আগেই ঘুরে এসেছি। পিসি কিছুটা অবাক হলো প্রথমে। যথা যথারীতি দিয়ার কথা উঠলো। দিয়ার বাড়ির সবাইও আমাকে খুব পছন্দ করেছে— এ সব বললো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি হাল্কা ভাবে বললাম– ‘পিসি মেয়ে দেখতে ভালো আমি স্বীকার করছি। কিন্তু ওর স্বভাব চরিত্র নিয়ে কিছু বলো।’
পিসি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন দিয়ার স্বভাব নিয়ে একটা কথাও বলবিনা। এখনকার মেয়েদের মতো ফেই ফেই করে দশটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায় না।
ইয়ারকি করে বললাম ‘দশটা না হোক একটা দুটো?’ এবার পিসি স্বাভাবিক সুরে বললো ‘নারে শঙ্কু, ওর কোন বয়ফ্রেন্ড নেই, মলি জেনে নিয়েছে।’
‘তাহলে সব দিকেই ভালো বলছো?’
‘সব দিকেই ভালো। তবে…’ পিসি একটু থামলেন।
‘তবে কি?’
‘দেখ তোরা দুজনেই আমার খুব আদরের। পরে এই নিয়ে তুই আমাকে কিছু না বলিস, তাই বলছি… আমাদের দিয়ার মতো ভালো মেয়ে হয় না। কিন্তু ওর একটু হাত টানের স্বভাব আছে!’
‘মানে!’ এবার আমি চমকালাম। স্যারের কথা মনে পড়লো।
‘মানে তেমন কিছু নয়! ও এখন থেকে ওখান থেকে কাউকে কিছু না বলে পছন্দের জিনিস নিয়ে আসে। দু’একজনে বলে ও চুরি করে। কিন্তু ও কেন চুরি করবে বল। ওর বাবার কত টাকা! ও যা চায় তাই পায়।’ তার পরে একটু থেমে বললো ‘তবে এটা আমরা কিছু মনে করি না।’
‘জানিয়ে ভালো করলে।’ বলে আরো দু একটা কথা বলে পিসির ফোন রেখে দিলাম। পিসির কথা একটু হাতটানের স্বভাব আছে। আর বিয়ের পরে এই স্বভাব থাকবেও না। তখন একজন মনের মানুষ পাবে।
পিসির কথা ঠিক কি না জানিনা! আমার সাথে বিয়ে হলে এই স্বভাব বাড়বে না কমবে জানি না! তবে এটা জানলাম আমার নটরাজ মূর্তি দিয়াই কাউকে না বলে নিয়েছে। একে অন্য ভাষায় চুরি করা বলে। আর মনে হলো ওই শো-কেসের অনেক জিনিসই হয়তো এইভাবে জোগাড় করা।
পরদিন যথারীতি পার্টি মিটের পরে স্যারের সাথে আমাদের বৈঠক বসলো। দিয়া এবং নটরাজ রহস্যই আমাদের আপাতত আলোচনার প্রধান বিষয়।
স্যার বললেন ‘শংকর, খবর নিয়েছ?’
‘নিয়েছি স্যার। পিসি বলেছেন দিয়ার একটু হাতটানের স্বভাব আছে।’
‘হাতটান না হাত সাফাই?’ তপন বলে উঠলো। স্যার রহস্য সমাধান করে পরিতৃপ্ত মুচকি হেসে রানাদার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘রানা, কি বলো? কষ্ট কল্পিত? There are more things…’
স্যার কথা শেষ করে উঠতে পারলেন না। হঠাৎ রানাদা উঠে স্যারের কাছে গিয়ে স্যারের পায়ের ধুলো নিয়ে বললো, ‘আপনি গুরুদেব স্যার।’
‘গুরুদেব একজনই রানা। আমি যুক্তি দিয়ে ভাবি।’
‘আমরা তো ভাবতে পারি না, স্যার?’ তপন বললো।
‘ভাবতে গেলে একটু পড়তে হবে তো? What mind does not know , eye cannot see? মন বড়ো জটিল হে। যতো পড়বে ততো জানবে আর ততো অবাক হবে।
‘ওটা কি একটা রোগ স্যার? যে বই পড়ে পাবো?’
‘নিশ্চয়ই,’ স্যার বললেন। ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়ার নাম শুনেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার। নাম শোনা। কিন্তু বেশী কিছু জানিনা।’ রানাদা বললো।
স্যার বলে চললেন, ‘এই রোগ নিশ্চয়ই আগেও ছিল, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে এটা নিয়ে চর্চা হয়। একজন সুইস চিকিৎসক ম্যাথুর ) মতে cleptomania মানে কোন উদ্দেশ্য বা দরকার ছাড়া চুরি করা। কোন জিনিস দেখলে বা দোকানে গেলেও এরা যদি ভাবে চুরি করবো তবে করবেই। চুরি না করা পর্যন্ত এরা স্থির হতে পারে না চুরি করার পরেই যেন শান্তি। কেউ কেউ একে চুরির পাগলামিও বলেছেন।
রানাদা বিস্ফারিত চোখে বললো ‘স্যার, আপনি গুরুদেবই কতো জানেন।’
‘ধুর। তোমাদের কাছে শোনার পরে যখন মনে হলো এটা একটা ক্লেপ্টোম্যানিয়া কেস হতে পারে তখন একটু পড়ে ঝালিয়ে নিলাম। না হলে এই বুড়ো বয়সে অত মনে থাক। তোমরাও পড়ো জানতে পারবে। আর এখন তো সবাই নেটে, মুঠোফোনে পাবে।’
‘আপনি মোটেই বুড়ো নন, স্যার।’
‘আরে বুড়োই। বয়স তো পঞ্চাশ পেরোলো। শুধু তোমাদের সাথে আছি বলে তরতাজা থাকি।’ বলে স্যার উঠতে গিয়েও আবার বসলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘শংকর, তাহলে কি করবে?’
রানাদা বললো ‘শংকর তো ভাবনায় পড়ে গেল, স্যার।’
তপন বললো, ‘মেয়েটা কিন্তু দারুণ, স্যার।’ আমি তখনই কিছু বলতে পারলাম না। স্যার এবার উঠতে উঠতে বললেন ‘তবে এই স্বভাব অনেকেরই কম বেশী থাকে। অন্য দিকে ঠিক থাকলে পজিটিভ ভাবনা ভাবতে পারো’, বলে স্যার উঠলেন। আমরাও উঠলাম।
পজিটিভ ভাবনা ভাবার আগে এই রোগটা নিয়ে আমাকে আর একটু পড়ে নিতে হবে।