ভয় লাগছে। আমার, আপনার, আমাদের সকলের।
পাশের পাড়ায় কারোর রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে শুনলে ভয় লাগছে। দুটো বাড়ি পরের বয়স্ক ভদ্রলোককে বাড়ির বাইরে দেখা যায় নি প্রায় মাস দুয়েক, প্রথম প্রথম ছাদে উঠতেন। চোখাচোখি হলে হাসতেন, পরের দিকে সেটুকুও আসতেন না। কাল যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে ওনাকে নিয়ে গেল, তখন খুব ভয় হচ্ছিল। ওর ছেলে নিয়মিত বাজার হাট করছিলেন, সেখান থেকেই হয়তো?
পরিচিত এক বন্ধুর বাবা, দেখা হলেই অনেক কথা বলতেন। অনেক খোঁজ খবর নিতেন কাল মারা গেলেন হাসপাতালে বেশ কিছুদিন লড়াই করার পরে। আপনার সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ জ্বর নিয়ে বাড়ি থেকে হাসপাতালে গেল, আর তার পরিবর্তে কয়েক সপ্তাহ বাদে আপনি পেলেন একটা ডেথ সার্টিফিকেট। খুব ভাগ্যবান (অথবা দুর্ভাগ্য) হলে দূর থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখতে পাবেন। এটাই প্রোটোকল! একটা মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁর জীবনের শেষ কটা দিনের প্রতিটা যন্ত্রণাদায়ক মুহুর্তে পরিবারের কাউকে কাছে পেলেন না ,পরিবারের থেকে একরকম হঠাৎ করে চিরদিনের মত হারিয়ে গেলেন একটা মানুষ।
এটা ভাবলেই আতঙ্ক হচ্ছে!
কেউ পজিটিভ হলে তার বাড়ি আর সেই পাড়া সীল করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আশেপাশের মানুষ সন্দেহের চোখে, ঘৃণার চোখে, বিরক্তির চোখে দেখছে। কেউ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে আসলে তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। পরিবারের কোন সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া মুশকিল। আশেপাশের কোন ক্লাব অ্যাম্বুলেন্স দিতে রাজী নয়। এরপর কিছু ব্যবস্থা হলেও হাসপাতালে গিয়ে বেড পাওয়া যাবে কি না? বেসরকারী হাসপাতালে বেড পাওয়া গেলেও তার বিল মেটানো যাবে কি না? হাসপাতালে ভর্তি প্রিয়জনের খবর ঠিকমতো পাওয়া যাবে কিনা? সবকিছু ভেবে ভয়ানক দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মী, ব্যাঙ্ককর্মী, পরিবহনকর্মী, সাফাইকর্মী ও সকল জনপরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার কর্মীরা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন ঠিকই। কিন্ত্ত রোজই কোন সহকর্মীর আর তার পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। রোজ কোন না কোন মৃত্যুর খবরে মনের জোর একটু একটু করে কমে আসছে। নিজের বা পরিবারের কারোর হলে চিকিৎসা পাব তো? ভয়ানক মানসিক উদ্বেগ হচ্ছে।
প্রতিদিন ইলেকট্রনিক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক খবর দেখে দেখে মনে হতাশা আসছে। অ্যাম্বুলেন্স নেই, বেড নেই, ডাক্তার নেই, অক্সিজেন নেই, ভেন্টিলেটর নেই, মাস্ক নেই, পিপিই নেই, চাকরী নেই। কেন এত নেই নেই? রোজ চব্বিশ ঘন্টা এই দেখে মনে পাহাড় প্রমাণ ক্ষোভ তৈরী হচ্ছে।
এগুলোই এই সময়ে আমাদের প্রত্যেকের মনের কথা। এগুলোই আমরা প্রতিনিয়ত ভেবে চলেছি। রোজ লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা আক্রান্তের গ্রাফ বাড়ছে আর বাড়ছে আমাদের উপর তৈরী হওয়া প্রবল মানসিক চাপও। কতদিন এই চাপ মানুষ নিতে পারবে? এখন করোনায় মারা যাচ্ছে এরপরে হয়তো মানসিক অবসাদে।
করোনা মহামারী সারা পৃথিবীর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। তাবড় তাবড় ধনী দেশ তাদের সামান্য জনসংখ্যা আর উন্নত স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিয়ে এর দাপট সামলাতে পারছে না। এই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করা অত সহজ নয় যতটা সহজ সরকার বা পরিষেবা প্রদানকারীদের দিকে আঙুল তোলা। প্রতিদিন এই ভাইরাস সম্বন্ধে আমরা নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য আমরা পাচ্ছি। সেইমত যুদ্ধের রণকৌশল বদলাতে হচ্ছে। এটা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তাই এই সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে থাকাটা জরুরী। নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করার সময় এটা। যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকা, সঠিক ভাবে মাস্ক পড়া, ঠিক মতো হাত ধোওয়া, সারফেস পরিস্কার করা, ভিড়ে না যাওয়া, ভিড় তৈরীই না করা এগুলো সবই আমরা জানি কিন্তু নিজেদের কাছে নিজেরাই চুরি করে যাচ্ছি। আর তাই পরিস্থিতি আজ এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর হয়তো অল্পই সুযোগ আছে নিজেদের শোধরানোর।
মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার সময় এটা নয়, জনপরিষেবা কর্মীদের সাথে অসহযোগিতা করার সময় এটা নয়, নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি অর্থের জোর খাটিয়ে অকারণে হাসপাতাল বেড দখল করে রাখার সময় এটা নয়, অন্যের দিকে আঙুল তুলে নিজের দায়িত্বগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার সময় এটা নয়, দিনরাত নেতিবাচক খবর ছড়িয়ে মানুষকে আতঙ্কিত দুর্বল করে দেওয়ার সময় এটা নয়। কারণ এটা এমন একটা রোগ যেখানে আমি ভালো থাকতে পারব না যদি আমরা সবাই ভালো না থাকি।
আসুন সবাই সবাইকে সাধ্য মতো সাহায্য করি, পাশে দাঁড়াই, খোঁজ নিই। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার গল্প বলে একে অন্যকে ভরসা যোগাই। সবাই কিছু না কিছু দায়িত্ব পালন করি এই মহামারীর মোকাবিলায়। তবেই যদি এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়।
নইলে সেই ভয় গুলোই সত্যি হবে। যে ভয় এই মুহূর্তে পাচ্ছি। আমি, আপনি আর আমরা সবাই।