‘সিং ভেঙে বাছুরের দলে’-র উল্টোটা কি হয় আপনাদের কারোর জানা আছে? ওই সেইদিন চেম্বারে নিজের অবস্থানটা ঠিক তেমনি মনে হচ্ছিল।
এক ঠাকুমা বড়ছেলের ঘরের নাতিকে নিয়ে দেখাতে এসেছিলেন। ছোট ছেলের ঘরের নাতির সাথে বয়সের পার্থক্য মাত্র ১৫ দিনের। ছোটটার বয়স এখন তিনমাস। বছর খানেক বাদে বাড়ির লোকজনের কি হাল ওরা করবে সহজেই অনুমেয়।
বড় নাতিকে দেখিয়ে একরাশ কুণ্ঠা ভরে ঠাকুমা বললেন, ডাক্তারবাবু জানি আপনি কৌটোর দুধ দিতে মানা করেন ৬ মাসের নিচে বাচ্চাদের, কিন্তু ছোট নাতিটার জন্যে একটা দুধ লিখে দিলে খুব ভাল হয়।
-কেন, কি হল?
-ওর মার খুব জ্বর। পাঁচ দিন হয়ে গেল। ১০৩-১০৪ করে জ্বর আসছে। দুবার অমুক বাবুকে দেখানো হয়ে গেছে। অ্যান্টিবায়টিকও তো দিয়েছেন। রক্ত পরীক্ষাও তো করলেন। বললেন কিছু তেমন নেই রিপোর্টে। এখন করোনা টেস্ট করতে বলছেন। সেই শুনে মা ভয় পেয়ে গেছে আর বলছে দুধ খাওয়ালে বাচ্চারও যদি হয়ে যায়!
-মায়ের ওই রোগ হয়েছে কে বললো? জ্বর ছাড়া আর কি কষ্ট আছে?
-খুব মাথা যন্ত্রণা বলছে।
-সর্দি, কাশি, হাঁছি এসব কিছু আছে?
-না, ডাক্তারবাবু।
গত ৯ বছর ধরে জীবনের বেশি সময়ই কেটেছে ফুটফুটে শিশুদের রোগ আর কষ্টের কথা শুনে। সুযোগ পেলে অপেক্ষাকৃত সুস্থ, সদ্য দাঁত ফোটাগুলোকে কাতুকুতু দিয়ে তাদের ওই নির্মল হাসি দেখার সুযোগ পুরোদস্তুর নিয়েছি। পাকা পাকা কথা বলা গিন্নি বুড়িদের হেয়ার ব্যান্ড বা জামার ফুলটা নিয়ে খুনসুটি তো উপরি পাওনা হিসাবে ছিলই। এই সব করতে করতে এখন বড় মানুষদের রোগ নিয়ে অদ্ভুত একটা আড়ষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। মন থেকেও আর ভাল লাগেনা ঠিক। জ্ঞানও সীমিত।
পুঁচকে দুধের শিশুটা মার দুধ খেতে পাবেনা?
অদ্ভুত একটা সেন্টিমেন্ট কাজ করলো। এখনও আমার মনে হয় ওই পুঁচকেগুলোর ওটা একটা খুব বড়ো অধিকারের জায়গা। এই অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে গিয়ে বিভিন্ন স্তরে অনেক গলাবাজিও করতে হয়েছে, তবুও আমি আজও বিশ্বাস করি এটি একটি শিশুর সুস্থ দেহ আর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বড় হয়ে ওঠার অত্যাবশ্যক উপাদান।
ওই শিশুটির কথা ভেবে সব আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে ভেতর থেকে মাটিকে সুস্থ করে তোলার এক অদ্ভুত অনুপ্রেরণা কাজ করতে থাকে। শিশু চিকিৎসক হয়ে নিজের পরিমিতি বোধ, একরাশ দোনা-মোনাকে সাথে নিয়েই একটু ভাবলাম ওনার রোগটা নিয়ে। ওই ভদ্রমহিলাকে বললাম ঘরে গিয়ে ওনারা কেউ যেন রোগিণীর গোপন জায়গাগুলো একটু খেয়াল করেন। বিশেষত শরীরের খাঁজ আর ভাঁজগুলো। একটা ছোটো ক্ষত, ছেঁকার মত কোনো দাগ পেলে যেন আমায় মোবাইলে ছবি তুলে দেখিয়ে যান।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ওই রোগিণীর স্বামী হন্ত দন্ত হয়ে স্মার্টফোন নিয়ে ছুটে আসেন।
বললেন ডান দিকের বগলের নিচের দিকে, যেখানে ব্লাউজের হাতাটা শেষ হয় ঠিক সেই জায়গায় একটা এমন কিছু পেয়েছেন।
মেডিসিনের লোকেরা যখন ডায়াগনোসিসের খুব কাছাকাছি চলে আসে তখন ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত গুরগুরে আনন্দ কাজ করে। মেডিসিনের প্রেমে যাঁরা পড়েন তাঁদের প্রেমের উৎসমূল কিন্তু এই আনন্দ। আসলে এটা রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার হয়ত আগাম বার্তা। আমারও তেমনি একটা অনুভূতি হতে থাকলো। গত ৩-৪ বছরের গোটা ৫০ স্ক্রাব টাইফাস চিকিৎসা করার সুবাদে কেমন যেন মনে হল এটা স্ক্রাব। ট্রিটমেন্ট শুরু করে পাঠাই রক্ত পরীক্ষা করতে। দুদিন পরে রিপোর্ট লোকজনকে অনুরোধ করে হোয়াটসআপ-এ পাঠাতে বলি। আমার সন্দেহই ঠিক হয়। ততদিনে রোগিনী সুস্থ। উনি আর ওনার বাড়ির লোককে তখনও এই রোগ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ওনারা এটাতেই খুশি যে ওনার কোভিড হয়নি।
রোগটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে যখন বলি কোভিডে মাত্র ৩-৪ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয় আর এই রোগের সঠিক ওষুধ না পড়লে ১০০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়। শুনে ওনাদের চোখে মুখে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া দেখেছিলাম।
যাওয়ার আগে আমার ফিজ দিতে খুবই জোরাজোরি করছিলেন। বললাম আপনি তো আমার রোগীই না। আমার ওই পুঁচকে রোগীর মুখে মার দুধ বন্ধ না হওয়ার যে খুশি দেখতে পাচ্ছি, ওটাই তো আমার সব চেয়ে বড় ফিজ।।
মরাল অফ দা স্টোরি
১) সব জ্বরই করোনা নয়।
২) জ্বরের সাথে এমন ধূপের ছেঁকার মত কোন দাগ দেখলে ডাক্তার বাবুর পরামর্শ নিন।
৩) স্ক্রাব টাইফাস শুরু হয়ে গেছে। সময় মত চিকিৎসা শুরু হলে বাড়িতে থেকেই সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়।
ভীষণ ভাবে উপকৃত হলাম পড়ে।
Excellent
Thank you