আমার মেয়ে এখানেই জন্মেছে। এই ছোট্ট ঘরে বেড়ে উঠছে। গত কয়েক মাসে আকাশ দেখেনি। খোলা বাতাসে দাঁড়ায়নি। বেচারা। ওর মা বলে, আমিই কোভিড নিয়ে এসেছি। রাতে স্নান করে আর এসি চালিয়ে সেই ভাইরাসটিকে বাড়তে দিয়েছি। ঠিকই বলে হয়ত। কিন্তু তার জেরে এই বিচ্ছিরি গরমে রাতের স্নান বন্ধ। এসির প্লাগও সেই কবে থেকে খোলা।
রাতে আমরা তিনজন এক জায়গায় ঘুমোই। একটা সিলিং ফ্যান আর ছবিতে যে টেবিল পাখাটি দেখছেন এটা আমাদের ভরসা। মেয়ে আর আমি এই ছোট্ট পাখাটার কোলে মাথা রাখি। মাঝরাতে মেয়ে হঠাৎ করে উঠে পড়ে। বলে,– বাবা। মা তো ঘুমিয়ে গেছে। একটু এসিটা চালাবে। আমি ওকে আদর করে দিই। কিছু বলি না। কি বোঝে কি জানি। আবার শুয়ে পড়ে।
আসলে পরিস্থিতির চাপে আমরা সব কিছু মেনে নেই। মানিয়ে নেই। এই ধরুন না আমি। ছোটবেলা কাটল খাল-বিল নদীর সুন্দরবনে। তারপর নন্দীগ্রাম। তারপর খেজুরি। মেঠো পথ। গাছে ওঠা। পুকুরে স্নান। সাইকেল চালিয়ে কত কত দূরে চলে যাওয়া। মাথার ওপরে বিরাট বড় আকাশ। বৃষ্টি ভেজা। রোদে পোড়া। কাদার মধ্যে হাডুডু খেলা। আছাড় খেতে খেতে, ঠোক্কর খেতে খেতে সেই আমি কিনা এলাম এই ইট আর কংক্রিটের জঙ্গলে। এই যে এখন চুপটি করে একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে আটকে থাকা। কখনো মনে হচ্ছে কাশ্মীরের মেহবুবা মুফতি, ওমর আব্দুল্লাহকে গৃহবন্দী করে রাখার কথা। কখনো ভাবছি শ্রী অরবিন্দ আন্দামানে নির্জন সেলের মধ্যে থেকে কিভাবে ঋষি হয়ে উঠেছিলেন। খুব চেষ্টা করছি একাগ্রতা বাড়ানোর। কিন্তু হচ্ছে না। হয়ও না।
কাল রাতে কিংশুকদার পোস্ট পড়ছিলাম। প্রত্যেকটা বর্ণ সত্যি। লকডাউন কিছু পেশাকে স্রেফ শুইয়ে দিয়েছে। আমাদের রিপোর্টারির কাজকে তো প্রায় চুল্লীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। শেষবার রথের আগের দিন দুটো অ্যাসাইনমেন্টে গেছি। এক) চিৎপুরে যাত্রা পাড়ার দুর্দশা, দুই) কাঁকুড়গাছিতে এক চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের কীর্তি। যে নিজে ব্যাঙ্গালোরে বউকে খুন করে এসে শাশুড়িকে গুলি চালায় এবং পরে নিজে আত্মহত্যা করে। তারপর একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। অর্পনের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা। প্যারামাউন্টে কোল্ড কফি। ব্যাস।
আমরা যারা রাস্তাঘাটের রিপোর্টার, তাদের এরকম টানা বন্দি করে রাখা যে কি বীভৎস কষ্টের, বলে বোঝানো যাবে না। তবু ব্যক্তিগতভাবে লকডাউনের মধ্যেও আমি কিছু কিছু বাইরে যাওয়ার বরাত পেয়েছি। যেমন আমফানের সময় দীঘায় ছিলাম। এরপরে খেজুরি, মন্দারমনি, তাজপুর, শংকরপুর, সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ ইত্যাদি ইত্যাদি। এটুকুও যাদের জোটেনি ভাবছি তাদের কি অবস্থা। ও আরেকটা কথা বলতেই হবে। লকডাউনে বেশ কয়েকবার খাবার, শাড়ি, ত্রিপল প্রভৃতি নিয়ে খেজুরি গেছি। সকালে গিয়ে রাতে ফিরে এসেছি। মোটকথা ঘরে থাকিনি। মাস্ক পরে, স্যানিটাইজার নিয়ে, দূরত্ব রেখে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেই আমি কিনা এখন করোনার জন্য গৃহবন্দি।
আজ দুপুরে কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়ার সময় মেয়ের এই ছবি তুলেছি। বলার অপেক্ষা রাখে না ও পুরোপুরি স্বাভাবিক। আমি এবং মোমোও তাই। প্রত্যেকদিন অফিসের কপি লিখতে হয়। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ শুরু হয়েছে আগে থেকেই। এসবের মাঝে কিছু খবর বিষন্ন করে। টিভি দেখবো না, কাগজ পড়বো না বললে আমাদের তো চলে না। মর্গে থাকবো আর মড়ার গন্ধ শুঁকবোনা তা তো হয় না। আজ সকালে এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর এক বিধায়কের ছবি প্রথম পাতায়। দুজনেই মৃত। মনটা খচখচ করছে। এসবের মাঝে কাল মাধ্যমিকের রেজাল্ট। বহু বছর পরে আমি এই মেগা ইভেন্টের সাংবাদিক বৈঠকে থাকব না। যাক। কী আর করা যাবে। দুটো মোবাইল আছে। যতটা পারি খবর জোগাড় করে লিখব।