গত ১৭ই এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় ডা. শ্যামল চক্রবর্তী স্যারের একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় “হারিয়ে যাচ্ছে ডাক্তারি চোখ”- লেখাটার বিষয়বস্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও ভীষণভাবে সত্যি, সেই নিয়েই দু-চারটে কথা।
ডাক্তারি চোখ সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছে, তার চেয়েও দুশ্চিন্তার কথা, এই ধারা বজায় থাকলে চর্চার অভাবে এই জ্ঞানের ধারা পরবর্তী প্রজন্ম অবদি পৌছাবেই না। ক্লিনিক্যাল ‘আই’ এর জায়গা হয়তো নিয়ে নেবে ‘এআই’ অর্থাৎ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থা এলো কেন! ক্লিনিক্সের চর্চায় অনীহা কি ছাত্রদের নাকি শিক্ষকদের তরফে- এই নিয়ে নিরর্থক পারস্পরিক দোষারোপ করা যায়, তাতে লাভ বিশেষ হওয়ার নেই। বরং নিজ নিজ ক্ষেত্রে আত্মসমালোচনা করা যেতে পারে। ডাক্তারি বিষয়টা বহুমাত্রিক- তাই এই আলোচনাও ডাক্তার, রোগী ও সর্বোপরি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক পটভূমিকায় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
একজন নবীন ডাক্তারের কাছে ক্লিনিক্স শেখা কতটা জরুরি? এর উত্তর দু’প্রকারের। এক, ক্লিনিক্স একান্তই আবশ্যিক- যদি রোগীর চিকিৎসাই ডাক্তারির মূলমন্ত্র হয়। দুই, না শিখলেও চলে- ক্লিনিক্সে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি না থাকলে সাধারণ প্র্যাকটিস করা যায়না এমনটা তো নয়, স্নাতকোত্তর পড়াশোনার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ক্লিনিকাল আই পরখ করা হয়, এমনটাও নয়। ক্লিনিক্সের চর্চা একটা সাধনা বলা যায়, অনেকটা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চার মতো- সেটা ছাড়াও জনপ্রিয় গান গাওয়া যায়, সে গানের গভীরতা নাই থাকুক!
তাহলে এই ডাক্তারি চোখ নিয়ে এত মাতামাতি কেন! এত প্রযুক্তি, এত পরীক্ষানিরীক্ষা, এত গাইডলাইন বেরিয়ে যাওয়ার পরও ক্লিনিক্সের চর্বিতচর্বন কেন? এই বিষয়ে Douglas Bader-র একটা কথা উল্লেখ্য- “Rules are for the obedience of fools and the guidance of wise men”। ডাক্তারিতে আধুনিকতাও অনেকটা তাই। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি রোগীর কথা শুনে, পর্যবেক্ষণ করে সামান্য পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসার দিকনির্দেশ করতে পারেন- ডাক্তারি চোখটি না থাকলে হাজার রিপোর্টের ভিড়েও হদিশ খুঁজে পাওয়া যায়না।
এই হলো ডাক্তারের দৃষ্টিকোণ। একজন গড়পড়তা রোগী কি ক্লিনিক্সে বিশ্বাসী? ডাক্তারবাবু রোগীকে একটু নেড়েচেড়ে দেখলে তাঁরা খুশি হন বটে, কিন্তু হাতেগরম রিপোর্ট অনেকেরই দাবি। আজকাল প্রথম ভিসিটেই প্যাকেজে রিপোর্ট বানিয়ে আনছেন অনেকে- সেই অবান্তর অসংখ্য পরীক্ষার রিপোর্টে মোটা হরফের নম্বরগুলোকে সাধারণ হরফে নিয়ে আসাটাই তাঁদের জীবনের মূলমন্ত্র, সেটার প্রয়োজন থাক আর না-ই থাক! সামান্য ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি, কারো সামান্য ইউরিক অ্যাসিড বেশি, কারো থাইরয়েড রিপোর্টে সামান্য গণ্ডগোল- ঔষধ চাই। একজন না দিলে অন্য ডাক্তারের কাছে ছোটেন। যেখানে মানুষেরা রোগের থেকে রিপোর্টের চিকিৎসায় বেশি বিশ্বাসী, সেখানে ক্লিনিক্সের আলোচনা ভস্মে ঘৃতাহুতির সামিল।
তার সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বাস্থ্যকে পণ্য বানিয়ে দেওয়া। রোগী আর ডাক্তারের মাঝে আদালতের নিয়মিত আনাগোনা স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকরণকে ত্বরান্বিত করেছে। শুধু নিজের ডাক্তারি বিদ্যার ভিত্তিতে চিকিৎসা করতে যে কোন চিকিৎসকই দ্বিতীয়বার ভাববেন। আজকাল সব রোগের পাতার পর পাতা গাইডলাইন বেরোচ্ছে- ডাক্তারের নিজস্বতা বা মুন্সিয়ানা দেখানোর জায়গাটা ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে।
এর জন্য রোগী যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আচ্ছা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি ডাক্তারি চোখের বিকাশ চায়? অনেক দূরের প্রশ্ন, আদৌ কি ডাক্তারিবিদ্যার সামগ্রিক মানোন্নয়ন চায়? সঠিক উত্তর জানিনা, তবে কয়েকটা পর্যবেক্ষণ বেশ হতাশাজনক। আমাদের দেশে রোগীর নিরিখে ডাক্তারের অনুপাত উদ্বেগজনক সেটা জানা, কিন্তু এই অনুপাতকে ভদ্রস্থ দেখানোর জন্য যেনতেনপ্রকারেণ ডাক্তারি স্নাতকদের সংখ্যা বাড়ানো কোন দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে না। ডাক্তারি শিক্ষায় পরিকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে কারো বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে মনেও হয়না।
আবার এই নব্য ডাক্তারেরাই যখন পাশ করে বেরোবে, তাদের আউটডোরের জনস্রোতের সামনে ঠেলে দেওয়া হবে। সেই স্রোতের সামনে শুধু চোখ কেন, নাক-কান-জিভ-ত্বক সব ইন্দ্রিয়ই কার্যক্ষমতা হারায়। দিনের শেষে হাসপাতালে রোগী চিকিৎসার পরিসংখ্যানটাই বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখায়। কিন্তু সেই চিকিৎসায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই না থাকে ক্লিনিক্সের ছোঁয়া, না থাকে গাইডলাইনের।
পরিশেষে সেই বন্দির কথা মনে পড়ে, যার কারাগারের বাইরে চাবি আর রুটি পড়েছিল- সে খিদের জ্বালায় রুটিটাই তুলে নেয়। সে মুক্তি চায়নি, চেয়েছিল খাদ্য- মুক্তি পেলে খাদ্যের হদিশ ঠিক মিলতো। সেরকমই মানুষ চিকিৎসা চেয়েছে, স্বাস্থ্যের অধিকার চায়নি- যেদিন মানুষ সেটা চাইতে শিখবে, সেদিন সুচিকিৎসার অভাব হবেনা। সেই জগতে হয়তো ক্লিনিক্সেরও পুনরুত্থান হবে।