– এরকম ফোলার রোগ কবে থেকে?
– সে আজ পেরায় তিন বচ্ছর
– কতবার ফুলেছে এর মধ্যে?
– উ কুনো ঠিক নাই। বছরে এক-দু’বার যখন তখন ফুলে যায়
– কোথায় চিকিৎসা করাতে?
– এউ হসপিটালে বাবু। গরীব মানুষ, আর কথায় যাব?
– তা এবার কী হ’ল? এবার হাসপাতালে না এসে কোথায় ছিলে?
– কী আর বলব বল.. লকডাউনে আসতে পারিনি। মোদের উখানে একজন বলল কোবরাজি দেখাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ ছ’মাস কোবরাজি খাবাইছিলি। ইবার যেন অত্যাধিক ফুলেইছ্যে
– তা কী ওষুধ দেখি?
বুড়ি তেল চিটচিটে কৌটো থেকে কালো কালো কিছু জড়িবুটি বের করে দেখালো। আজ ছ’মাস বাচ্চাটা টানা এগুলো খেয়ে গেছে। গাল ফুলে টইটম্বুর, চামড়া ফেটে লাল টুসটুসে, গায়ে অবাঞ্ছিত লোম, রক্তচাপ বেড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, জড়িবুটির মধ্যে ভরে দেওয়া হয়েছে স্টেরয়েড। পেচ্ছাব দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়ার এই রোগে স্টেরয়েডটাই আধুনিক-চিকিৎসা কিন্তু তার নির্দিষ্ট মাত্রা ও সময়কাল আছে। দেওয়ার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। স্টেরয়েড আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি ভয়ংকর সুন্দর অস্ত্র। সঠিকভাবে ব্যবহার হ’লে স্টেরয়েড আশীর্বাদ। আবার সেটাই ভুল হাতে পড়লে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া স্টেরয়েড ব্যবহার মানে বানরের হাতে তলোয়ার তুলে দেওয়া। অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার সুযোগে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসেছে সর্বরোগহর জড়িবুটি। অজান্তে যার মাশুল গুনছে ছ’বছরের মেয়েটা।
****
হাসিনা খাতুনের থ্যালাসেমিয়া। পিলে বেড়ে গিয়ে পেট ঢাউস হয়ে ফুলেছে। দেড় মাস ছাড়া রক্ত নিতে হয়। প্রতিবার রক্তের জন্য ছোটাছুটি। সহজে রক্ত পাওয়া যায় না। ডোনার জোগাড় করা আরেক ঝামেলা। ডাক্তার বলেছে এবার পিলে কেটে বাদ দিতে হবে। অপারেশনের কথা শুনলেই বুক কাঁপে।
এলাকার নামকরা হোমিওপ্যাথের শরণাপন্ন হ’ল হাসিনার বাবা। আসার পর বুঝতে পারলো এতদিন কিচ্ছু চিকিৎসা হয় নি। শুধু রক্ত কমে গেলে রক্ত দেওয়া হয়েছে। হোমিওপ্যাথিতে রোগের গোড়া থেকে নির্মূল করা হয়। পেঁয়াজ-রসুন বন্ধ হ’ল। দিনে তিনবার করে ওষুধ খেতে হয়। দু’বার ঝাঁঝালো ফোঁটা, একবার চিনির গোল্লা। বারবার ছুঁচ ফোটানো, রক্ত দেওয়া এসবের ঝামেলা নেই। মিষ্টি গোল্লা পেয়ে হাসিনাও খুব খুশি।
কিন্তু সুখের সময় বেশিদিন থাকলো না। বাচ্চাটা কেমন যেন নেতিয়ে আসছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন প্রবল শ্বাসকষ্ট। হাসিনার বাবা দৌড়ে হোমিওপ্যাথের চেম্বারে এসে শুনলো, ইমার্জেন্সিতে হোমিওপ্যাথি কাজ করে না। অগত্যা সেই পুরোনো হাসপাতালে তড়িঘড়ি করে আসতে হ’ল।
তারপর বাকিটা আমাদের পাঁচ-ছ ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের গল্প। হোমিওপ্যাথিতে গোড়া থেকে রোগ নির্মূলের কল্যাণে হিমোগ্লোবিন তিনে নেমে এসেছে। হৃৎযন্ত্র প্রায় জবাব দিয়েছে। বুকে, পেটে জল। আইসিইউতে পাঠিয়ে অনেক টানাহিঁচড়ে করার পর আপাতত এ যাত্রা বাঁচানো গেছে! হাসিনার বাবা ঠিক করেছে অপারেশনটা এবার করিয়েই নেবে।
****
– আচ্ছা, তোমরা কোন যুগে বাস করো বলো তো?
– কী করব ডাক্তারবাবু.. সবাই যেমন বলল..
– সবাই বলেছে বলে তুমি বাচ্চাকে ওই হসপিটাল থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে চলে গেলে?
– সেইটাই মোদের ভুল হয়েইছ্যে
– তোমাকে ওই হাসপাতালে বলেছিলো তো, বাচ্চার মাথায় ইনফেকশন হয়েছে? সারতে সময় লাগবে?
– সব বলছল। কী আর বলি তমাকে.. মোদের কপালের দোষ
– বেচারা কপালকে আর দোষ দিয়ে কী হবে? তা বলে বাচ্চাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করে গুনিনের কাছে ঝাড়াতে গেলে? সব নজরদোষ না? জানো, চিকিৎসা না করে বাচ্চার মাথায় কতটা ক্ষতি হয়েছে?
– তমরা একটু চেষ্টা কর্যে দেখ। মোরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। বুঝতে পারিনি..
– মাথায় জল জমে গেছে। পুরো ঠিক হবে কিনা বলা মুশকিল
– তাইলে কী হবে ডাক্তারবাবু?
– সেটা তোমার গুনিনকে জিজ্ঞেস করবে যাও
****
কর্মক্লান্ত দিনের শেষে মেঝেতে ভাতের থালা নিয়ে থেবড়ে বসি। টিভিটা অন করি। অমৃত বিজয়সার খেলেই ডায়াবেটিস ভ্যানিশ.. হরলিক্স মানেই টলার-স্ট্রংগার-শার্পার.. কমপ্লানে ফুল দাদা.. চোখের ছানি সারানোর ম্যাজিক ড্রপ.. ধনকুবের কিংবা হনুমান চালিশা যন্ত্র.. টাকা পাঠালেই হোম ডেলিভারি। চমৎকার ব্যবস্থা!
এসবের মাঝে নীরস তথ্যের মতো আজ এরাজ্যের আরও তিন চিকিৎসক করোনা সংক্রমণে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
ভালো লেখা।