বেশিরভাগ মানুষই আসলে একটা মুখোশের আড়ালে বাস করেন। মুখ দেখে, কাজ দেখে যেমন মনে হয়, মানুষটি মোটেই তেমন নন। অন্য কোথাও জন্মালে, পরিস্থিতি অন্যরকম হলে তিনি অন্য মানুষ হতেন। যিনি রান্নাঘরে দিনগত পাপক্ষয় করছেন আর শাশুড়ির গালমন্দ শুনছেন সুযোগ পেলে হয়তো জাতীয় স্তরে একশ মিটার দৌড়তেন।
আমি খুপরিজীবী চিকিৎসক। কর্পোরেট হাসপাতালে নয়, নিজস্ব ছোট্ট খুপরিতে বসে ঘামতে ঘামতে সারাদিন রোগী দেখি। আসলে রোগী নয়, মানুষ দেখি। কত রঙের মানুষ, কত বিচিত্র সমস্যা, কতো আশ্চর্য অনুভূতি। আমি যদি লেখক হতাম, তাহলে এসব নিয়ে গল্প লিখে বিখ্যাত হয়ে যেতাম- এমন কী নামের শেষে একটা ‘শ্রী’-ও এতদিনে জুড়ে যেত হয়তো।
সমস্যা হলো আমি লেখক নই। আবার যারা লেখক তাঁরা কখনো এইসব ঘটনার সাক্ষী হবেন না। তাহলে এসব কে লিখে রাখবে? এতো সব আশ্চর্য ঘটনাকে তো হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে আমিই লিখছি। ‘না- লেখকের’ এই ধৃষ্টতা ক্ষমা ঘেন্না করে দেবেন।
এক মহিলা মাঝে মাঝেই খুপরিতে আসেন। প্রতি দু-তিন সপ্তাহে একবার। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো সমস্যা নেই এবং সমস্যা প্রত্যেকবারই পালটে যায়।
মহিলার মূল সমস্যা আবর্তিত হয় পেটকে কেন্দ্র করে। পেট ফুলে থাকে, ব্যথা ব্যথা করে, ঢেকুর ওঠে না, পায়খানা মনোমত হয় না। তার সাথে বুকে চাপ চাপ ভাব। ঘুম আসে না।
সবচেয়ে মুশকিল হলো একটা সমস্যা ঠিক হলে আরেকটা সমস্যা শুরু হয়। টুকটাক পরীক্ষা করা হলো। সবই স্বাভাবিক। বুঝতে পারছিলাম মহিলার সমস্যা দেহে নয়, আসল সমস্যা রয়েছে মনে। ভদ্রমহিলা মানসিক অবসাদ ও উত্তেজনায় ভুগছেন।
ততদিনে ওনার ঠিকুজি কুলুজী সব জেনে ফেলেছি। ওনার বয়স পঁয়ত্রিশ। স্বামী কাপড়ের ব্যবসায়ী। বিধাননগর আর কলকাতায় মোট তিনটি কাপড়ের দোকান আছে।
তবে মহিলার সাথে তাঁর স্বামীর তেমন ভাব ভালোবাসা নেই। যেটুকু সময় স্বামী বাড়িতে থাকেন, মহিলা ভয়ে তটস্থ থাকেন। পান থেকে চুন খসলে স্বামী গালিগালাজ করেন।
মহিলার একটাই কাজ। সারাদিন তাঁর স্বামী আর দুই যমজ ছেলের খেয়াল রাখা। সময় মতো খাবার দাবার যোগান দেওয়া। তাঁদের জামা- কাপড় পরিষ্কার রাখা, ঘরদোর সাফ করা… ইত্যাদি।
বাবার দেখাদেখি দুই ছেলেও ইদানীং মার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করেছে। খাবার পছন্দ না হলে খাবার সমেত থালা ছুড়ে ফেলে দেয়। জামা কাপড় ইস্ত্রি করা না থাকলে মাকে গালি গালাজও করে।
সব শুনে বললাম- চিকিৎসা তো আপনার স্বামী আর দুই ছেলের বেশি প্রয়োজন। ওদের ডাক্তার দেখাতে বলুন।
-আমি বলব? আমার কথা শোনে নাকি কেউ? আমি হচ্ছি বাড়ির বিনা মাইনের কাজের লোক। কাজের লোক তবু মাসে দু’চারদিন ছুটি নেয়। আমার সে উপায়ও নেই।
-একদিন সঙ্গে করে আপনার স্বামীকে আনবেন তো… কথা বলে দেখবো।
-আমার সঙ্গে আসবে… তাহলেই হয়েছে। আসার জন্য বলতে গেলেই আমার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে দেবেন। জানেন ডাক্তারবাবু, আমার আর বাড়িতে এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় কোথাও চলে যাই। অনেক দূরে। কিন্তু যাবই বা কোথায়? এভাবে বাঁচার থেকে মরে যাওয়া ভাল।
বললাম- আজ কী সমস্যা? পেটের সমস্যা কমেনি?
-মিথ্যা কথা বলব না। সেটা কমেছে। কিন্তু আরেকটা নতুন সমস্যা শুরু হয়েছে। ঘাড়ের পেছনে জ্বালা শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি জ্বালা হচ্ছে বিকালে। মনে হচ্ছে ঐ জায়গায় যেন কেউ লঙ্কা বাটা লাগিয়ে দিয়েছে।
ভদ্রমহিলা মনের জ্বালা যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারছেন না সেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে শরীরের নানা রকম সমস্যা হিসাবে। ডাক্তারি পরিভাষায় বলে সোমাটোফর্ম ডিজঅর্ডার। বললাম- আপনার যা সমস্যা সে জন্য আপনাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিৎ। আমার কাছে তো অনেকবার এলেন। আমি একজনের কাছে পাঠাচ্ছি- একবার দেখিয়ে আসুন।
ভদ্রমহিলা বললেন- আমি কোথাও যাব না। আপনি যা পারেন করুন। আপনি চেনা জানা হয়ে গেছেন- আপনার উপর বেশ একটা বিশ্বাস চলে এসেছে। এই তো আপনি আমার এতদিনের পেটের সমস্যাটা দিব্যি সারিয়ে দিলেন। অচেনা জায়গায় কেন যাব। তাছাড়া যে কোনো অচেনা জায়গায় গেলেই আমার বুক ধড়ফড় হয়। পেট গোলায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম- ঠিক আছে। তাহলে ওষুধ খান। এক মাস বাদে আসবেন।
উনি বললেন- একমাস নয়, আমি পনেরো দিন বাদেই আসব। আসলে আপনার এখানে আসলে তবু বাড়ির বাইরে একটু বেরোনো হয়। দুটো মন খুলে কথা বলা যায়। আপনার এখানে যে ঘণ্টা খানেক লাইনে অপেক্ষা করি- কী চমৎকার লাগে। কতো লোকজনের গল্প শুনি।
ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করতে যে কারো ভালো লাগে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আধঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হলেই সকলেই দেখি কেমন তিতি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে লাইন নিয়ে গণ্ডগোল শুরু করেন। তবে আপাতত এনাকে বিদায় জানানো দরকার। কারণ এর পরের রোগী ইতিমধ্যেই দরজা দিয়ে বার দুয়েক উঁকি মেরেছেন।
দু-সপ্তাহের আগেই ভদ্রমহিলা এলেন। তবে এবার সজ্ঞানে নয়। অজ্ঞান হয়ে। সঙ্গে এই প্রথমবার তার স্বামী এসেছেন। তিনি এসে বললেন- ডাক্তারবাবু, রোগী এনেছি। আপনারই পেশেন্ট। কিছুতেই গাড়ি থেকে নামাতে পারছি না।
অগত্যা খুপরি থেকে বেরলাম। গাড়ির দরজা খুলে দেখি, সেই মহিলা। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। হাত পা গুলো টানটান। কনভার্শান ডিজঅর্ডার। নিশ্চিত ভাবে বাড়িতে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, যেটা মহিলা আর সহ্য করতে পারেনি। সেই সমস্যার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তাঁর অবচেতন মন, এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
ভদ্রমহিলার স্বামী বললেন- কী হয়েছে? স্ট্রোক? ভর্তি করতে হবে? বাঁচার সম্ভাবনা কতোটা?
বললাম- খুব ভয়ের কিছু নেই মনে হচ্ছে। একটু দেখতে হবে।
ভদ্রমহিলার স্বামী আর একজন মহিলা ধরাধরি করে ওনাকে চেম্বারের পাশের একটি ঘরে শোয়ালেন। প্রেশার, নাড়ির গতি সবই ঠিক আছে। গৌড়কে দুটো ইনজেকশন দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি রোগী দেখায় মন দিলাম।
মিনিট পনেরো বাদে দেখি ভদ্রমহিলার স্বামী দরজা দিয়ে উঁকি মারছেন। বললাম- কিছু বলবেন?
উনি বললেন- ইয়ে… ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। উঠে বসেছে। মোটামুটি স্বাভাবিক। ওকে কি বাড়ি নিয়ে যাব?
আমি বললাম- দাঁড়ান, একবার দেখে নি।
মহিলা উঠে বসেছেন ঠিকই- কিন্তু চোখের দৃষ্টি কেমন ফ্যালফ্যালে। তিন চারবার জিজ্ঞাস করার পর একটা কথার জবাব দিচ্ছেন। ওনার স্বামীকেই জিজ্ঞাসা করলাম- বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে? কোনো ঝগড়া ঝাটি?
মহিলার স্বামী রেগে মেগে জবাব দিলেন- ঝগড়া কেন হবে? কোন্ অভাব রেখেছি ওর। গত মাসেই সাতভরি হার বানিয়ে দিয়েছি। গরম লাগছিল বলে দু সপ্তাহ আগেই ঘরে এসি লাগিয়ে দিয়েছি। শুধু শুধু আমাকে বেইজ্জতি করার চেষ্টা।
মহিলাকে দেখে দুটো ওষুধ লিখে বাড়ি নিয়ে যেতে বললাম। ওনার স্বামীকে বললাম- দয়া করে ওনাকে একবার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবেন। ওনাকেও অনেকবার বলেছি। উনি গা করেন নি। আমার যতদূর মনে হয়েছে, ওনার সমস্যার মূল জায়গা ওনার শরীরে নয়, মনে।
মহিলার স্বামী আমার কথায় সহমত হলেন। বললেন- আপনি একেবারে ঠিক জায়গায় ধরেছেন। ওর মাথায় গণ্ডগোল আছে। তাহলে বুঝুন, আমি কী যন্ত্রণায় আছি। পাগলের সাথে দিনের পর দিন ঘর করছি। অন্য কেউ হলে এতদিনে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিত।
বোঝাতে যাচ্ছিলাম, মানসিক সমস্যা আর পাগল দুটো মোটেই এক নয়। এক্ষেত্রে রোগীর যেমন সুচিকিৎসা দরকার তেমনি পরিবারের সদস্যদের বন্ধুর মতো পাশে থাকার দরকার। কিন্তু ওনার স্বামীর অত সব শোনার ধৈর্য নেই। তিনি একরকম টানতে টানতে স্ত্রীকে গাড়িতে তুললেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এই রোগ মুক্তির জন্য প্রিয়জনের যে সহানুভূতি দরকার, সেটা এই মহিলা পাবেন না। ফলে ওনার রোগ কমবে না। বরঞ্চ আস্তে আস্তে বাড়বে।
দিন কয়েক পরেই মহিলা এসে হাজির। বললেন- সেদিন কিছু বলতে পারিনি ডাক্তারবাবু, উনি সাথে ছিলেন। আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।
-মানে? আবার কী হলো?
-আমার স্বামী অন্য মহিলার সাথে রাত কাটাচ্ছেন। আগেই সন্দেহ হয়েছিল। মোবাইল রেখে স্নানে ঢুকেছিলেন, হোয়াটসঅ্যাপের ম্যাসেজ দেখে স্পষ্ট হলো। কী নোংরা ম্যাসেজ, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। স্বামীকে চেপে ধরতেই কোথায় লোকানোর চেষ্টা করবেন, তার বদলে বললেন, বেশ করেছেন। তাঁর টাকায় সংসার চলে। তিনি যা ইচ্ছা তাই করবেন। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। দুই ছেলে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে চলে এসেছিল। উনি ছেলেদের সামনেই আমাকে চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে বুকে লাথি মারতে শুরু করেন। তারপর আর কিছু মনে নেই। পাঁজরে এখনও প্রচণ্ড ব্যথা।
আমি বললাম- এতসব হলো, আপনি চুপচাপ মেনে নেবেন। আপনি থানায় গিয়ে এফআইআর করুন। লোকাল কাউন্সিলারকে সব জানান। আইন কিন্তু মেয়েদের পক্ষে। আপনি অভিযোগ করলে পুলিশ আপনার বরকে জেলে ঢুকিয়ে দেবে।
মহিলা শিউরে উঠলেন। বললেন- তারপর জেল থেকে বেরিয়ে উনি আমাকে খুনই করে ফেলবেন।
কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম- তাহলে আর এসব নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। ব্যথার ওষুধ লিখে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে ওষুধ খান। মলম লাগান।
কয়েকদিন পর ভদ্রমহিলা আবার এলেন। এবারো অজ্ঞান অবস্থায়। সঙ্গে দুটি ষোলো সতেরো বছরের ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম- এমন কী করে হলো?
একটি ছেলে জানালো- কাল রাতে বাবাকে পুলিশে তুলে নিয়ে গেছে। তার পর থেকেই মা ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।
মনটা একটু ভালো হলো। যাক, মহিলাকে যতটা ভীতু ভেবেছিলাম, উনি ততটা ভীতু নন। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে পুলিশের কাছে গেছেন। তবে মহিলার জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারলাম, ঘটনা আমি যেরকম ভাবছিলাম, মোটেই সেরকম নয়।
মহিলার স্বামী গ্রেফতার হয়েছেন অন্য এক মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে। মহিলার স্বামী নাকি মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সাথে দিনের পর দিন সহবাস করেছেন। তিনি ওই মহিলাকে বলেছিলেন, স্ত্রীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে বিয়ে করবেন।
বলতে বলতে মহিলা কাঁদতে আরম্ভ করলেন। আমার বেশ বিরক্তিই লাগল। বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান বোধ থাকলে কেউ এমন স্বামীর জন্য চোখের জল ফেলে না।
তারপর মাস চারেক চলে গেছে, মহিলা আর আসেন না। বৈশাখ মাসের ঠা ঠা রোদের দুপুরে রেল লাইন পার হচ্ছি এক মহিলা – ‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু’ করে ডাকলেন। দেখি সেই মহিলাই।
জিজ্ঞাস করলাম- কেমন আছেন? আপনাদের সমস্যা মিটেছে? স্বামী ছাড়া পেয়েছেন?
ভদ্রমহিলা বললেন- না, এখনও পাননি। তবে ছাড়া পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আপনি কাল বসবেন তো? কাল আপনার কাছে যাব।
-কেন? আপনার কী আবার সমস্যা হচ্ছে?
-না না। আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি ঠিক আছি। ব্যবসার সব কিছু দেখতে হচ্ছে। নিঃশ্বাস ফেলারই সময় পাচ্ছি না। অন্য একটা ব্যাপারে আপনার মতামত দরকার।
পরেরদিন দুপুরে মহিলা খুপরিতে এসে হাজির। সেদিন বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্র। লোকজন বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন। রোগীর চাপ একেবারেই নেই। যে কজন আসছেন, সকলেরই এমারজেন্সি।
ফাঁকা চেম্বার দেখে মহিলা বললেন- ভালই হয়েছে। আপনার সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল। সেটা বিস্তারিত বলতে পারব।
-বলুন।
-যে মহিলা আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কেস করেছিল, সে কেস তুলে নিতে চায়। কিন্তু সে টাকা দাবী করেছে। দশ লক্ষ টাকা। স্বামীর সাথে আমার সব যৌথ একাউন্ট। উনি গ্রেফতার হওয়ার আগে কিছুই জানতাম না। কিন্তু গত চারমাসে ব্যবসার জন্য আমাকে সবই জানতে হয়েছে। ছেলেরা এখনও স্কুলে পড়ে। কাকেই বা ভরসা করব। কাজেই আমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে। দশ লাখ টাকা সব কটা ব্যাংকের সেভিংস একাউন্ট মেলালেই হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো টাকাটা দেওয়া উচিৎ হবে কিনা? আপনার কী মনে হয়?
আমি বললাম- আমি কী বলব। এটা তো সম্পূর্ণ আপনাদের ব্যাপার।
মহিলা বললেন- এই চারমাসে আমি অনেক পালটে গেছি ডাক্তারবাবু। প্রথম দিকে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। এই ব্যবসা কী করে সামলাব। দুই ছেলের পড়াশুনো কি করে চালিয়ে যাব। তারপর সাহস করে মাঠে নামার পর আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেছে। তিনটে কাপড়ের দোকান দিব্যি সামলাচ্ছি। ওখানকার কর্মচারীরা বলছেন আমি নাকি আমার স্বামীর চাইতে আরো ভালো চালাচ্ছি। এমনকি ছেলেরাও আজকাল আমাকে সমঝে চলে। উঁচু গলায় কথা বলতে সাহস পায় না। তারাও বুঝতে পেরেছে মার জন্যই তাদের উপর এ যাত্রা ঝড় ঝাপটা এসে পড়েনি।
বললাম- তাহলে তো এখন নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারা উচিৎ। আমাকে শুধু মুধু শোনাচ্ছেন কেন?
-কাউকে তো শোনাতে হবে। এই যে আপনাকে শোনালাম, এই শোনাতে শোনাতেই আমার ডিসিশন নেওয়াটা সহজ হয়ে গেল। টাকাটা আমি দিয়ে দেব- তবে আর কয়েকদিন যাক।
মহিলা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় পেছন থেকে ভালো করে লক্ষ করলাম। সত্যিই ওনার চলাফেরা একেবারে পালটে গেছে। আগের সেই দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই। একেবারে অন্য মানুষ। হ্যাঁ, এই প্রথমবার ওনাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে মনে হল। গৃহপালিত জন্তুর কোনো লক্ষণ যেখানে অনুপস্থিত।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হলে এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা যেত। কীভাবে পরিবেশ- পরিবারের প্রভাব একজন মানুষের জীবনের উপর প্রভাব ফেলে তাই নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যেত। কিন্তু আমি জেনারেল ফিজিশিয়ন। সর্দিকাশি, পেটে ব্যথা, সুগার প্রেশারের রোগী দেখে দিনগত পাপক্ষয় করি। পড়াশুনো প্রায় করিনা। ‘এম ডি’ করার সময় যেটুকু শিখেছিলাম তাও প্রায় ভুলতে বসেছি। এমন কী বিভিন্ন জার্নালে কীভাবে প্রবন্ধ লিখতে হয়, সেসবও ভুলে মেরে দিয়েছি। আমি আজকাল আর চিন্তা ভাবনা প্রায় করিনা। কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া সারাদিনের রোগী দেখা শেষ করতে পারলেই খুশি। কাজেই ওই মহিলার কথা আমার মাথা থেকে বেরোতে বেশি সময় লাগল না।
এইভাবে আস্ত একটা ঋতু চলে গেল। একদিন খুপরিতে ঢুকেছি, পার্থ বলল- ডাক্তারবাবু, ওই যে এক মহিলা আপনার কাছে আসতেন না, কলকাতায় তিনটে কাপড়ের দোকান আছে- ওনার স্বামী কাল রাতে মারা গেছেন।
দেখলাম অনেকেই খবরটা জানে। উনি কালই জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই আনন্দে সন্ধ্যায় কিছু বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে মদের পার্টি বসিয়েছিলেন। রাত বারোটা অবধি তাঁদের মদ্যপান চলে। তারপর ইয়ার দোস্তরা চলে যাওয়ার পর তিনি সেই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে তার স্ত্রী তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করেন।
এতদিন পরে ওই মহিলার কথা আবার মনে হল। বছর খানেক আগে এমন ঘটনা ঘটলে নিশ্চিত ভাবে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে হতো। ঘটনার অভিঘাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর অবচেতন মন কনভার্সন রিয়াকশানের আশ্রয় নিত। কিন্তু আজ বেশ জানি তাঁর চেতন মন- অবচেতন মনের থেকে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এক ভয়ের আড়ালে এই চেতন মন লুকিয়ে ছিল। একবার যখন ভয় কাটিয়ে উঠেছেন, কোনো ভাবেই তিনি অবচেতন মনের আজ্ঞায় আর চলবেন না।
ঘটনাটা অদ্ভুততও লাগল। মহিলার স্বামীর কোনো রোগ ছিলো বলে তো আগে শুনিনি। তিনি কীভাবে হঠাত করে মারা গেলেন? তাও ঠিক যেদিন জেল থেকে ছাড়া পেলেন!!
তবে আমি বিশেষ মাথাও ঘামালাম না। আমি সর্দি জ্বরের- প্রেশার সুগারের ডাক্তার… জাহাজের খবর নিয়ে আমার লাভ নেই।
দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিল। কয়েকমাস পরে ওই মহিলা এসে আবার গণ্ডগোল পাকিয়ে দিলেন। মধ্যমগ্রামে একটা দোকান খুলছেন। সেই উপলক্ষে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। ওনার চেহারা একেবারে পালটে গেছে। চোখের তলায় কালি উধাও। আত্মবিশ্বাসে ঝলমল করছেন। একটা মানুষকে এভাবে পালটে যেতে দেখে কেমন আশ্চর্য লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম না কোনটা সত্যিকারের মুখ আর কোনটা মুখোশ।
বললাম- নিশ্চয়ই যাব। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
-করুন?
-আপনার হাজব্যান্ডের কী আগে থেকে কোনো হার্টের সমস্যা ছিল? মানে যেভাবে হঠাত করে?
মহিলা হাসলেন- না ছিলনা, কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
-সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ অবশ্য হতেই পারে। আগে থেকে কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে… আচ্ছা ওনার বংশে কী কারো এরকম…?
-দয়া করে এই নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না। উনি মারা গিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করে গেছেন। জানেন, মৃতদেহ দেখার পর আমি প্রচণ্ড কেঁদেছি। তেমন ভাবে আমি আগে কোনো দিনও কাঁদিনি। আপনি কী ভাবছেন- আমি লোককে দেখানোর জন্য কেঁদেছি। একেবারেই তা নয় ডাক্তারবাবু- আমি ভেতর থেকে কেঁদেছি। স্বাধীনতার আনন্দে যে এতো তীব্র কান্না পায় আগে তা বুঝিনি।