মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। আর আমার দৌড় ঘোলা থেকে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত। এই আট দশ কিলোমিটারের মধ্যেই দিন চলে যায়, মাস চলে যায়, বছর চলে যায়।
মাঝে মাঝে পুজো পার্বণ এলে চেনা রাস্তাগুলোও অচেনা অচেনা মনে হয়। রাস্তায় কতো আলো। মা বাবার হাত ধরে নতুন জামা কাপড় পরে খোকা খুকুরা বেরিয়েছে। তাদের মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি- স্কুটারের গতিবেগ কমে যায়। মনে হয় রাস্তার ধারে স্কুটার থামিয়ে একটু দাঁড়াই। সবার সঙ্গে মিশে যাই।
কিন্তু উপায় নেই। পরের খুপরিতে ভিড় জমতে শুরু করেছে। আবার স্কুটারের স্পিড বাড়ে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়। চশমার কাঁচ ক্রমশ ঝাপসা হয়। আমি স্কুটার সাইড করে চশমার কাঁচ মুছি। রেনকোট বের করতে ইচ্ছে করে না।
খুপরিতে ঢুকে পড়লে আবার সেই একঘেয়ে জীবন। যে জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই। লাইন নিয়ে রোগীদের মধ্যে ঝগড়া, রোগীদের সাথে পার্থর ঝগড়া- এই সব শুনতে শুনতে আমি ঘাড় গুঁজে রোগী দেখে যাই।
খুপরির দরজা দিয়ে একটি ফুটফুটে ছেলে উঁকি মারে। তাঁর ইংরেজি প্রেমী মা বাচ্চাটিকে বকা দেন, ‘নো নো, রাতুল। ডোন্ট ডু দিস। ডোন্ট ডু দুষ্টুমি। ইউ নো ইউ আর এ ভেরি নটি বয়।‘
আমি হাতছানি দিয়ে বাচ্চাটিকে ডাকি। বাচ্চাটি জিভ ভ্যাংচায়। সামনের বয়স্ক মহিলা বলে চলেন, ‘বড় আশা করে এয়েচি বাপ আমার। সেই হিঙ্গলগঞ্জ থেকে এয়েচি। আমারে সারায়ে দাও। আমাদের গ্রামের এক জনারে তুমি সারায়ে দিয়াছিলে। তারও হাঁটু ব্যথা ছিল। সেও হাঁটতে পারত না একেবারে। সেই তো আমারে বলল।‘
বয়স্ক মহিলা পুটলি থেকে কিছু কাগজ পত্র বের করেন। সবই সরকারি হাসপাতালের কাগজ পত্র। একটা হাঁটুর এক্সরে বের হয়। হাসপাতালের প্রাগৈতিহাসিক এক্স রে। সেইটাই দেখি। ফিমারের শেষ প্রান্ত টিবিয়ার ঘাড়ে চেপে বসেছে। টোটাল নি রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া ঠিক হওয়া অসম্ভব।‘
কুণ্ঠিত ভাবে বলি, ‘ঠাকুমা, আমি তো হাড়ের ডাক্তার নই। তুমি বরঞ্চ একজন ভালো হাড়ের ডাক্তার দেখাও।‘
বয়স্ক মহিলা বলেন, ‘ও সব বড়ো ডাক্তার দেখানোর মতো আমার পয়সা নাই। আমি একেবারে ভিখারি। তুমি আমারে যে করে হোক একটু চলার মতো করে দাও। নইলে আমার খাওয়াও জুটবে না।‘
আমি আর কিছু বলতে পারি না। বেচারা ওই পা নিয়ে একা একা এতো কষ্ট করে এতদূর এসেছেন। কোন ভোরে বেরিয়েছেন কে জানে? কী করে আবার ফিরবেন সেটা ভাবতেও আতঙ্ক হয়। আমি মাথা নিচু করে ওষুধ লিখি। সারাতে না পারি, অন্তত ভরসাটুকু তো দিতে পারি।
বয়স্ক মহিলা চলে যাওয়ার পর একটা অপরাধ বোধ শুরু হয়। রোগী দেখতে আর ভালো লাগে না। সেই এক বিপন্নতা, সেই এক দুঃখের গল্প। কিন্তু না দেখেও উপায় নেই। এখনও অনেকে অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করতে করতে অনেকেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। যন্ত্রের মতো রোগী দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। আমি তো স্বেচ্ছাতেই এরকম জীবন বেছে নিয়েছি। এখন হা হুতাশ করে লাভ নেই।
পার্থর গলার আওয়াজ শোনা যায়। রোগীর বাড়ির লোকের সাথে ঝগড়া চলছে। পার্থ বলছে, ‘নাম না লেখা থাকলে আর ডাক্তারবাবু দেখবেন না। এখনও নাম লেখা অনেক পেশেন্ট দেখা বাকি। আমি নাম লিখে রাখছি। আপনি কাল আসুন।‘
রোগীর বাড়ির লোক বলছেন, ‘আমার রোগীর ভয়ানক এমারজেন্সি। কালকের আগে কিছু যদি হয়ে যায় আপনি দায়িত্ব নেবেন?’
পার্থ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী আশ্চর্য, আমি দায়িত্ব নেব কেন? আপনি অন্য কোথাও দেখান। হাসপাতালে দেখিয়ে নিন। নাম না লিখে সবাই যদি এসে বলতে শুরু করেন, সবার পেশেন্ট এমারজেন্সি, তাহলে আমরা সামলাবো কী করে? হয়েছেটা কী আপনার পেশেন্টের?’
একজন তরুণী তাঁর মাকে ধরে ধরে খুপরিতে ঢোকেন। সামনের চেয়ারে বসেই বলেন, ‘আর পারছি না ডাক্তারবাবু। আপনি কিছু একটা করুন।‘
আমি আর কী করব। চির অসুস্থ বয়স্ক মহিলাকে দেখি। সুগার, প্রেশার, হার্ট, কিডনি যার কোনো কিছুই ঠিকঠাক নেই।
তরুণী বলেন, ‘অনেক জায়গায় দেখিয়েছি ডাক্তারবাবু, মা তবু দিন দিন খারাপ হয়ে চলেছে। আপনার কাছেই শেষ এলাম। এরপরও যদি উন্নতি না হয়, আর ডাক্তার দেখাবো না। যা হয় হবে। এভাবে মাকে নিয়ে পড়ে থাকলে আমাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।‘
আমি বলি, ‘বাপের বাড়িতে আর কেউ নেই?’
‘থাকলে কী আর এই অবস্থা হয়। মা ফোন করে, কাঁদে। আমি বেথুয়াডহরি থেকে বারবার ছুটে আসি। কতবার আসা যায় আপনিই বলুন। এই শেষবার, আপনি যা ভালো বোঝেন করুন।‘
আমি ভরসা দিতে চাই… পারিনা। আমি আর কারও ভরসা হয়ে উঠতে পারিনা। যতো দিন যাচ্ছে আস্তে আস্তে আমি নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি।