(এক)
শিল্প সমৃদ্ধ পশ্চিম বর্ধমান জেলা সদরের এক কলোনিতে বাস করে সুশান্ত (নাম পরিবর্তিত)। ওষুধের দোকানে কাজ করে তার দিন গুজরান।সেই সুশান্তের লালারস পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ বেরিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের সৌজন্যে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে গেল সর্বত্র। চ্যানেল বিস্ফোরণের যুগে সমস্ত খবরই যেহেতু `ব্রেকিং নিউজ `তাই উত্তেজনায় গোটা শহর টানটান। সুশান্তর নাম ঠিকুজি জেনে গেলাম আমরা সব্বাই। যথারীতি সরকারি নিয়ম মেনে তাকে পাঠানো হল কোভিড হাসপাতালে, পরিবারের লোকদের নিভৃত বাসে। তারপর ডাক্তারি শাস্ত্রানুসারে চিকিৎসা ও পুনরায় পরীক্ষার পর সুশান্ত এবার করোনা নেগেটিভ। সে বাড়ি ফিরল।এতোগেল অসুস্থ মানুষের সুস্থ হওয়ার গল্প। এবার শোনাই সুস্থ মানুষদের গল্প। সুশান্তর পাড়া প্রতিবেশীরা করোনার সময় যে সচেতনতার পরিচয় রেখেছেন সেটা না জানলে গল্পটা শেষ হবে না। সুশান্তর পাড়ার কিছু মানুষ অন্য পাড়ায় জল আনতে গেলে তাদের বলে দেওয়া হয়েছে জল দেওয়া যাবে না। সুশান্তর সঙ্গে তার নিজের পাড়ার লোকেরা কথা বলছেন না, এমন কি পরিচিতরাও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। যেন করোনা আক্রান্ত সুশান্ত এক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছেন। দু-এক জন্য সবজান্তা করোনা বিশেষজ্ঞ (হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়) আবার মন্তব্য করেছেন, দ্যাখ পয়সা দিয়ে রিপোর্ট পাল্টে নিয়ে আসে নি তো!
এই শহরেরই উত্তর প্রান্তে রয়েছে এক ইস্পাত কারখানা। রজত (নাম পরিবর্তিত) সেই কারখানার কনট্র্যাকটার, শ খানেক শ্রমিক তার ফার্মে কাজ করে। সংখ্যার বিচারে এর মধ্যে ৮০ জন ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু ও ২০ জন মুসলমান। দীর্ঘ দিন ধরে এই শ্রমিকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের সময়েও সেখানে সরকারি নির্দেশ মেনে ৫০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কাজ হয়েছে। কিন্তু দু-এক দিন ধরে রজত লক্ষ্য করছে যে তার লোক দের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা গুঞ্জন। কাজের গতিও মন্থর। শ্রমিক দরদী ও সংবেদনশীল রজত খোঁজ খবর নিতে শুরু করলে এক শ্রমিক বললেন, সাব,উনলোককো কাম মে মত বুলাইয়ে,আপ কো তো মালুম হ্যায় কি মহল্লা মে পুরা করোনা ফেয়ল গিয়া(ওদের কে আর কাজে ডাকবেন না,জানেন তো মহল্লায় সর্বত্র করোনা ছড়িয়ে গেছে)। জেনে রাখা ভালো এ শহরে মুসলমান প্রধান অঞ্চল গুলো মহল্লা নামে পরিচিত। কিন্তু কোন তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেল পুরো মহল্লায় করোনা ছড়িয়ে গেছে? খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেল নয়,এ খবর জানা যাচ্ছে সোসাল মিডিয়া পরিবেশিত মিথ্যার বেসাতিতে। ফটোশপে তৈরি ছবি ও বক্তব্যে ছড়িয়ে পড়ছে যে কারা প্রকৃত পরিচয়ে করোনা বাহক।
এখানকার এক তথাকথিত শিক্ষিত পাড়ায় থাকে পেশায় শিক্ষক সুব্রত। তাদের পাড়ায় এখনো ঘটা করে রবীন্দ্র -নজরুল -সুকান্ত জয়ন্তী পালিত হয়, বেশ কিছু মানুষ লাইব্রেরিতে বই পড়তে আসেন।দ্বিতীয় দফার লকডাউনের সময় সকালবেলায় বাজার করতে বেড়িয়ে সুব্রত দেখল রাস্তায় ইতিউতি জটলা।অনেকেই উত্তেজিত, ক্ষুব্ধ। করোনার হাত থেকে বাঁচতে কি করা উচিত তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেটা বোঝা গেল তা হল পাড়াকে বাঁচাতে সবার আগে মহল্লার দিক থেকে আসা ঠেলাওয়ালা দের কাছ থেকে সবজি ও ফল কেনা বন্ধ করতে হবে কারণ টিভিতে না কি দেখিয়েছে ফল ও সবজির মধ্যে দিয়ে করোনা ছড়াচ্ছে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। যদিও অর্থনীতির চাপে ও ঠেলার মাল তুলনামূলক সস্তা হওয়ার ফলে সে বয়কট বেশিদিন চলে নি।তাদের আবার পাড়ায় ফল বিক্রি করতে দেখে বয়কট পোগ্রামের এক পান্ডার খেদোক্তি, – হিন্দুরা আজও নিজেদের ভালো বুঝতে শিখলো না।
(দুই)
প্রিয় বন্ধুরা,অনুগ্রহ করে পশ্চিম বর্ধমান জেলার এক শিল্প শহরের উপরিউক্ত ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ভেবে স্বস্তি তে থাকবেন না। যারা আমরা ভাবি যে পশ্চিমবঙ্গ এক অসাম্প্রদায়িক, বিঞ্জান মনস্ক,জাত-পাত মুক্ত প্রগতিশীল রাজ্য,তারা নেহাৎ ই ভাবের ঘরে চুরি করছি। গণেশের দুধ খাওয়া থেকে শুরু করে চুনি কোটাল,তিনবছর আগের রামনবমীর ঘটনা থেকে পক্ষ কাল আগে তেলেনিপাড়ার দাঙ্গা — আমরা যখনই সুযোগ পেয়েছি আমাদের চরিত্র প্রমান করে ছেড়েছি।মাত্রাগত পার্থক্য থাকলেও দেশের আর দশটা রাজ্যের মত এ রাজ্যেও করোনার আবহে তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও যুক্তি হীনতার নরক গুলজার চলছে। মিডিয়ায় এই সর্বময় জমানায় করোনা যেন আরো বেশি করে আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঘৃণা ও নির্বুদ্ধিতার বিষবাষ্প কে বাইরে এনে ফেলেছে।
লেখার শুরুতে উল্লেখিত সুশান্তের সঙ্গে তার পাড়া প্রতিবেশীদের ব্যবহার নিছক বিভ্রান্তি জনিত নয়,একই সঙ্গে আতঙ্কের যা আমজনতার মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে চিকিৎসক কূল ‘সামাজিক দূরত্ব ‘ ( social distancing) কথাটি ব্যবহার করছেন। অথচ বাস্তবে আমরা রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে চাইছি শারীরিক দূরত্ব। সামাজিক দূরত্ব আমাদের মত জাতপাতের নিগড়ে বেঁধে থাকা একটা তীব্র বর্ণবৈষম্য বাদী শব্দবন্ধ,একথাটা জোরের সঙ্গে বলার সাহস দেখালাম না আমরা কেউই। এই কঠিন সময়ে দরকার ছিল সামাজিক ঐক্য, আর পরিস্থিতি হল কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হল টিভি চ্যানেলে কিছু চিকিৎসকের নানান ধরনের নিদান যা সোমবার একরকম তো মঙ্গলবার ঠিক তার উল্টো। করোনার মতো সংবেদনশীল বিষয়কে নিয়ে বস্তুত পক্ষে গণমাধ্যমে এক আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হল,সঙ্গে থাকল গণ হিস্টিরিয়া। তাই দেখলাম এক নাটুকে রাষ্ট্র নায়কের কথায় যে জনগণ থালা বাজিয়ে (কোথাও কোথাও ডিজে বাজানো হয়)চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্য কর্মীদের সন্মান জানায়,তারাই আবার পরের দিন করোনা ছড়িয়ে যাবে এই আশঙ্কায় তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবার হুমকি দেয়।
এ ক্ষেত্রে দায় আমাদের সবার। সঠিক তথ্য না থাকলে সচেতনতা তৈরি করা যায় না। সত্য অর্ধসত্য ও মিথ্যার ককটেলে করোনা আজ এক দানবে পরিনত যা আমাদের সামাজিক স্থিতি কেই নষ্ট করে দিচ্ছে। এ রাজ্যে অন্তত ২৫ টি জায়গায় সরকার কোয়ান্টারিন সেন্টার তৈরি করতে পারে নি এলাকার মানুষের প্রতিরোধের কারণে অথচ করোনা চিকিৎসায় নিভৃতবাস যে অপরিহার্য তা গোটা দুনিয়া জুড়ে স্বীকৃত। অপরিকল্পিত লকডাউন, অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও করোনা সমাজজীবনে যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে তা নিয়ে আমরা কেউই মুখ খুলতে রাজী নই।
(তিন)
এই করোনা অতিমারীর সময় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করা গেলে, আক্রান্ত মানুষদের একে অপরের শত্রু প্রতিপন্ন করতে পারলে ক্ষমতাসীনরা অনেক নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। অপরিকল্পিত লকডাউনের ব্যর্থতা,পরিযায়ী দের মৃত্যু মিছিল, বিপন্ন অর্থনীতি, কঙ্কালসার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেশের পরিচালক প্রতি যে সব অপ্রিয় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, তার থেকে নিস্তার পেতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে কল্পিত গণশত্রু নির্মাণ। কর্পোরেট মিডিয়া শাসকের স্বার্থে সেই শত্রুকে নির্মাণ করতে সাহায্য করে। করোনার ক্ষেত্রে সেই সুযোগটা নিয়ে আসে নিজামুদ্দিনের ঘটনা। শুরু হয়ে যায় একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে খলনায়ক প্রতিপন্ন করার কাজ। আমরা সবাই নিজামুদ্দিনের ঘটনাকে অনভিপ্রেত এবং তার উদ্যোক্তা এবং অনুমতি দানকারী কর্তৃপক্ষকে অবিবেচক মনে করি।কিন্তু সেই একই যুক্তিবোধ কি একথা দাবি করে না যে ঐ সময় তিরুপতি সহ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে যে ধর্মীয় জমায়েত হয়েছিল তাও একই ভাবে সমালোচনার যোগ্য। এদেশে যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে তখন আমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদি ও ট্রাম্পের জনসভায় লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি কি গুজরাটের করোনা সংক্রমণের অন্যতম কারণ হতে পারে __ শুধু এটুকু প্রশ্ন রাখার সাহস অাজ আমরা হারিয়েছি। ডাক্তারিশাস্ত্রের যাবতীয় নৈতিকতা কে ধুয়েমুছে দিয়ে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় কে সংক্রমণ এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের পরিচয় গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পক্ষ থেকে অথচ টিভি চ্যানেলে উপস্থিত ডাক্তার বাবুরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন না, বরং নীরবতা অবলম্বন করছেন __ এ দৃশ্যও আমাদের দেখতে হচ্ছে। এই সময় রাজনীতি নয়__ এই ধাপ্পাবাজিতে ভুলে আমরা চুপ করে থেকেছি, আর আইটি সেল,কর্পোরেট মিডিয়া তাদের লক্ষ্য পূরণে সর্বশক্তি ব্যয় করছে। তাই উত্তরপ্রদেশে ক্যামেরার সামনে জনপ্রতিনিধি মুসলমান সবজি বিক্রেতা কে মেরে ভাগিয়ে দেবার হুমকি দেয়, আর এ রাজ্যে ভদ্র ও সংস্কৃতিমনস্করা ঠেলাওয়ালা কে বয়কটের পরিকল্পনা করেন।অতিশয়োক্তি ভাববেন না,তেলেনিপাড়ার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাস্তায় নামলে তাদের করোনা – করোনা বলে বিদ্রুপ করছে একদল মানুষ।
করোনা আজ আর শুধু একটা রোগ নয়,আমাদের সমাজের মধ্যে গেঁড়ে বসে গভীরতর অসুখ গুলির প্রতিচ্ছবিও বটে। করোনা আজ সমাজ জীবনে অবিশ্বাস ও সন্দেহের জন্ম দিতে পেরেছে। তাই শুধু রোগ প্রতিরোধ নয়,একই সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক ভাবে লড়াইটা শুরু করা। নাহলে আরো মূল্য চোকানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
এই সময়ে অত্যন্ত জরুরী বিষয় । ভালো লেখা।
——–অনিন্দ্য
অতন্ত সঠিক কথা, সুন্দর ভাবে বলা হয়েছে। যেকোন সংবেদনশীল মানুষকে ভাবাতে পারবে এই লেখা ।
মুসলমান বিদ্বেষ এর শিকড় চরম গভীরে বলেই এত সহজে বর্ণহিন্দুদের স্বাভাবিক যুক্তিবোধ ভুলিয়ে দেওয়া যায়।
লেখক খুব স্পষ্টভাবে পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন।
আরো লিখুন আপনি।