কোভিড ১৯-এর অন্যতম উপসর্গ হল কাশি। কাশি থেকে মুক্তি পেতে কাশির সিরাপের শরণাপন্ন হচ্ছেন অধিকাংশ রোগী। তাঁদের জন্যই এই রচনা…
কেন আমরা কাশি?
কাশি হলে বুঝতে হয় শরীর সমস্যায় পড়েছে, সম্ভবত সে সমস্যা শ্বাসনালীতে। শ্বাসনালীকে পরিষ্কার করার জন্য আমরা কাশি।
কাশির সময় কি হয়?
আমাদের নাক ও মুখের পেছনদিকটা এক, সেখান থেকে দুটো নালী আলাদা হয়ে যায় শ্বাসনালী ও খাদ্যনালী। খাবার খাওয়ার সময় যাতে শ্বাসনালীতে খাবার ঢুকে না যায় তাই শ্বাসনালীর শুরুতে একটা দরজা থাকে। কাশির সময় সেই দরজা বন্ধ হয়, ফলে বুকে ফুসফুসের ভেতরের চাপ বাড়ে। এই বাড়তি চাপে হঠাৎ দরজা খুলে গিয়ে ফুসফুসের বাতাস তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসে। তাড়াতাড়ি বাতাস বেরোনোর জন্য কাশির আওয়াজ হয়।
কফ বেরোয় কিভাবে?
কফ আসলে আমাদের শ্বাসনালীর রস। স্বাভাবিক অবস্থায় শ্বাসনালীকে ভিজে রাখা এর কাজ।
আমাদের শ্বাসনালীর ভেতরের আবরণী স্তম্ভ বা থামের আকারের কোষ দিয়ে তৈরী, আর সেই কোষগুলোর ওপরে আছে রোঁয়া বা সিলিয়া। এই রোঁয়ার ডগাগুলো ওপরে একটা জেল স্তর আছে। রোঁয়াগুলো এই জেল স্তরেই ধূলো আর জীবাণুগুলো আটকে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
শ্বাসনালীর রস ১০০ মিলিলিটারের বেশী হলে কফ হয়েছে বলে আমরা বুঝি। কফ হল কাশি হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপক, অর্থাৎ কফ থাকলে কাশি হয়।
কাশি কোনও রোগ নয়
কাশি কোনও রোগ নয়, অনেক রোগের একটা সাধারণ উপসর্গ হল কাশি। অনেক রোগে কাশি হয়, যেমন—
1. শ্বাসতন্ত্রের জীবাণুসংক্রমণ—নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ইত্যাদি।
2. শ্বাসতন্ত্রের এলার্জি—যেমন হাঁপানি।
3. শ্বাসতন্ত্রের ক্যান্সারে।
4. শ্বাসনালীতে ধোঁয়া, ধূলো ঢুকলে—ধূমপানে, ধূলিবহুল কর্ম পরিবেশে।
কাশি হলে কি করবেন?
1. প্রচুর পরিমাণে জল খান, এতে কফ পাতলা হবে, কফ বার করার চলন্ত সিঁড়ি ভালভাবে কাজ করতে পারবে।
2. গরম জলের ভাপ নিন। ভাপ শ্বাসনালীতে গিয়ে জলে পরিণত হবে, কফ পাতলা হবে।
3. শুকনো কাশিতে গলা খুসখুস করলে হাল্কা গরম জলে একটু নুন দিয়ে কুলকুচি করুন। মুখে সাধারণ যে কোন লজেন্স, লবঙ্গ বা আদা রাখলেও একটু আরাম পাওয়া যাবে।
কেশে কফ তুলতে না পারলে কি করবেন?
অনেক সময় খুব দুর্বল মানুষ বা বয়স্ক মানুষরা কেশে কফ তুলতে পারেন না। তখন
1. রোগীকে প্রচুর জল খেতে হবে।
2. কফ পাতলা করার জন্য গরম জলে ভাপ নিতে হবে।
3. তারপর রোগীকে খাটে উপুড় করে এমনভাবে শোয়াতে হবে যাতে তাঁর মাথা ও বুক খাটের বাইরে ঝুলে থাকে। এবার পিঠে হাল্কা হাল্কা চাপড় মারলে কফ বার করতে সাহায্য হবে।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
1. কাশির সঙ্গে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট হলে।
2. কফের সঙ্গে রক্ত পড়লে।
3. কাশতে কাশতে শরীর নীল হয়ে গেলে।
4. কথা বলতে কষ্ট হলে।
5. দুধের বাচ্চা দুধ টেনে খেতে না পারলে।
6. পনেরো দিনেরও বেশী কাশি হতে থাকলে।
কাশির সঙ্গে এসব উপসর্গ থাকলে ডাক্তার রক্তপরীক্ষা, কফ পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে, মান্টু পরীক্ষা, ইত্যাদি করে রোগ-নির্ণয় করতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রচুর যক্ষ্মা রোগী, তাই কোন রোগীর কাশি দু-তিন সপ্তাহের বেশী হলে, কফে রক্ত থাকলে কফ পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
বাজারে কাশির ওষুধ
ভারতের বাজারে প্রায় ৫০০ r moto bivinno ব্র্যান্ডের কাশির ওষুধ পাওয়া যায়, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে কাশির জন্য আলাদা করে কোনও ওষুধের দরকার নেই
কাশির ওষুধ বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় ছিল কেবল শুকনো কাশির দমক কমানোর জন্য Dextromethorphan, এই ওষুধটাও ২০০৩ সালে প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
কাশির সিরাপে কি থাকে?
বাজারে চালুর কাশির ওষুধগুলোতে নানান এলার্জির ওষুধ, কফকে বার করার ওষুধ, কফকে পাতলা করার ওষুধ, কাশির দমক কমানোর ওষুধ, হাঁপানির ওষুধ মেশানো থাকে।
• এলার্জির ওষুধ ক্লোরফেনিরামিন, ফেনিরামিন, সেটিরিজিন, ইত্যাদি এলার্জির ভালো ওষুধ। কিন্তু কাশিতে ব্যবহার করলে এরা কফকে আঠালো করে দেয়, কেশে সহজে কফ বার করা যায় না, ফুসফুসে কফ জমে গিয়ে বেশী ক্ষতি হয়। তবু এসব ওষুধ খেলে লোকে আরাম বোধ করেন, কেন না এগুলো খেলে ঝিমুনি আসে।
• কফকে বার করার ও কফকে পাতলা করার ওষুধ হিসেবে এমোনিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম সাইট্রেট, গুয়াফেনিসিন, ব্রোমহেক্সিন, এম্ব্রুক্সল, ইত্যাদি মেশানো হয়। বিখ্যাত ওষুধ-বিজ্ঞানীদের মতে এদের কার্যক্ষমতা জলের চেয়ে বেশী নয়।
• শুকনো কাশির দমক কমানোর ওষুধ হিসেবে কোডিন বা ডেক্সট্রোমেথরফান কার্যকর বটে, কিন্তু এগুলোতে নেশায় পড়ার ঝুঁকি থাকে।
• হাঁপানির ওষুধ টারবুটালিন বা সালবুটামল সংকুচিত শ্বাসনালীকে প্রসারিত করে। অনেক কোম্পানী কাশির ওষুধে এগুলোকে মেশায়, যেমন—গ্রিলিংটাস-বিএম, ভেন্টোরলিন এক্সপেক্টোরেন্ট।
একটা অবাস্তব ব্যাপার লক্ষ্য করুন, কাশির ওষুধে কফকে বার করার ও কফকে পাতলা করার ওষুধের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে কাশির দমক কমানোর ওষুধ—দুধরনের ওষুধের কাজ পরস্পরের বিপরীত। হাঁপানির ওষুধ শ্বাসনালীকে প্রসারিত করে, এলার্জির ওষুধ শ্বাসনালীকে শুকিয়ে দিয়ে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটায়।
ভারতে অনেকগুলো কাশির ওষুধই কিন্তু নিষিদ্ধ
ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ১৯৯১ সালে সালবুটামল বা অন্য শ্বাসনালী প্রসারকের সঙ্গে মস্তিষ্কে কাজ করে এমন কাশির দমক কমানোর ওষুধ ও এলার্জির ওষুধের মিশ্রণ নিষিদ্ধ করেছে।
১৯৯৯-এ নিষিদ্ধ হয়েছে মস্তিষ্কে কাজ করে এমন কাশির দমক কমানোর ওষুধের সঙ্গে এলার্জির ওষুধের মিশ্রণ।
একই বছর নিষিদ্ধ হয়েছে হাঁপানির কাশি কমানোর ওষুধ বলে চালু ওষুধে কাশির দমক কমানোর ওষুধ বা এলার্জির ওষুধের মিশ্রণ।
তাই কাশি হলে বাজার থেকে কাশির ওষুধ কিনে খেয়ে রোগ না বাড়িয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
খুব প্রয়োজনীয় ও উপযোগী লেখা। অনেক ধন্যবাদ।