আজ সকাল সাড়ে সাতটার পর হঠাৎ করেই আমাদের হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ভিড় জমে গেল। সাধারণত এই সময় এক দুজন করে রুগী আসে। আমাদের একজন হাউস স্টাফ বসে তাদের কথা শুনে, কাউকে ভর্তি করে বা বড় ডাক্তারদের কাছে পাঠায়।
আমি রাতের ডিউটি সেরে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, পরের ডাক্তার এলেই বাড়ী রওনা দেব। এমন সময় একজন কর্মী এসে বলল, স্যার, ইমারজেন্সিতে খুব ভিড় জমে গেছে। বেরিয়ে গিয়ে দেখি, হাউস স্টাফের সামনে কুড়ি বাইশ জন লোক দাঁড়িয়ে গেছে। এবার আমরা দুজনেই এক এক করে রোগীর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি, কুড়ি জনের মধ্যে দু তিন জন নতুন রুগী। বাকি সতের আঠারো জনই, আউটডোর -এর কাগজ দেখাচ্ছে। তারা দূর দূর থেকে এসেছে। এসে শুনছে, “আজ ছুটি”, আউট ডোর খুলবে না। আমাদেরই অনুরোধ করছে, কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে। সত্যি কথা বলতে কি, নিজেকেই অপরাধী আর অসহায় লাগছিল।
এই যে লোকগুলি একটা বড় হাসপাতালের আউটডোরে দেখাতে আসে, এদের কেউ কেউ হয়তো তিন মাস, ছয় মাস এমনকি এক বছর ধরে আসছে যাচ্ছে। আর যাদের অপারেশনের দরকার, তারা হয়তো বার চারেকের চেষ্টায়, সবকটা পরীক্ষা করিয়ে, আজ ভর্তির আশায় এসেছে। আরও কত রকমের সমস্যা, যেগুলি আউটডোরে বসে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষক চিকিৎসকেরাই দেখেন। এই সকল রুগীদের জন্য আমাদের মত ডাক্তার দু’ একজন হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে বসে, “সোমবার আসুন” বলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না।
একজন রুগীর কাগপত্রগুলো দেখে বুঝলাম, তাকে সম্ভবত আমার থেকেও বেশী অভিজ্ঞ কোন ডাক্তাবাবু কয়েকবার দেখেছেন। কাকদ্বীপ থেকে কলকাতায় পাঠিয়েছেন, হার্টের কিছু আধুনিক পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আজ হার্টের আউটডোর বন্ধ, আর একদিন আসতে হবে, এই মর্মান্তিক সংবাদটি শুনতে এই রুগীর বাড়ীর লোকের কেমন লাগছে, বুঝতেই পারছিলাম। আমার পাশে বসে আমাদের হাউসস্টাফ এই কথা যখন বলছে, তখন আমি সম্ভবত একজন হাতের প্লাস্টার কাটাতে আসা রুগীর বাড়ীর লোকের সাথে কথা বলছিলাম।
আমাদের সামনে তখনো দশ -পনের জন লোক দাঁড়িয়ে ধাক্কা ধাক্কি করছে। তাদের পিছনে একটি বাচ্চাকে মায়ের কোলে বসে, চিৎকার করে কাঁদতে দেখলাম। এই বাচ্চার দু’ হাতেই বড় বড় ফোস্কা পড়ে আছে, পোড়া রুগী, দশ ফুট দূরের থেকেই দেখতে পাচ্ছি। চিৎকার করে , বাচ্চার বাড়ীর লোককে সামনে আসতে বললাম। বাচ্চাকে নাম লিখে, টিকিট দিয়ে, সার্জিক্যাল বিভাগে পাঠানোর সময় আমার মন পড়ে আছে, সেই কাকদ্বীপ থেকে আসা হার্টের রুগীর দিকে। অন্য বাড়ীর পাঁচ তলায় অবস্থিত হার্টের বিভাগে, ওদের ইমার্জেন্সী দেখার জন্য একজন থাকেন; হাউস স্টাফকে বললাম, একে একটা ইমার্জেন্সী টিকিট দিয়ে একবার পাঁচ তলায় পাঠাও। আমাদের হিসেবে যাকে ইমার্জেন্সী বলে, এই রুগী এরকম নয়, না বোঝার কোন কারণ নেই। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, অনেক সময় , ঐ রকম চার তলা পাঁচ তলায় বসে থাকা, আমার থেকে তিরিশ পঁয়তিরিশ বছরের ছোট ডাক্তারও ফোনে, কিংবা নেমে এসে রীতিমত ধমক দেওয়ার চেষ্টা করে, কেন এসব রুগীকে পাঠিয়েছি, জানতে চায়!
এই হল একটা ছুটির দিনে সকাল সাড়ে সাতটার পর মিনিট চল্লিশের সামান্য একটু অংশ। আমার পরে ডিউটিতে এলেন যে লেডি ডাক্তার, তিনি তিন মাস পর অবসর নেবেন; অর্থাৎ তাঁর বয়স চৌষট্টি বছর নয় মাস। আমি জানি, ছুটির দিনে বেলা প্রায় একটা দেড়টা পর্যন্ত আউটডোরে দেখাতে আসা রুগীদের চার আনাও যদি একবার করে ইমারজেন্সি ঘুরে যায়, ঐ ম্যাডাম আর এক হাউস স্টাফ তাদের প্রত্যেকের সাথে আধ মিনিট করে কথা বললেও, মাঝে মাঝেই তিরিশ চল্লিশ জনের ভিড় জমে যাবে।
প্রতি রবিবার সকালে, এর অর্ধেক ভিড় জমে। এই কুড়ি থেকে তিরিশ জনের সাথে কম করে দু’জন করে বাড়ীর লোক থাকেই। অর্থাৎ সব সময় পঞ্চাশ থেকে সত্তর জন লোকের জমায়েত। এর মধ্যেও অতি সংকটজনক রুগী থাকে। সামনে ভিড় করে থাকা পঞ্চাশ জনকে পেরিয়ে, ডাক্তারের কাছে গিয়ে, আমার রুগীকে একটু দেখুন বলবার আগেই অনেক সময় রুগী মারাই যায়।
এসব কিন্তু রুগী বা রোগ নিয়ে কথা। এর বাইরে কত বিচিত্র রকমের কাজ ঐ হাসপতালের ইমারজেন্সির ডাক্তারদের করতে হয়, লিখতে গেলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে। আমার প্রয়াত বন্ধু ডা ভোলানাথ রায় এসব কাজকে বলতেন, পঞ্চায়েতী কাজ।
ছুটির দিনে হাসপাতালের আপিস বন্ধ থাকে, তাই পঞ্চায়েতী কাজ আরও বেড়ে যায়। বারো মাস , তিনশ পঁয়ষট্টি দিন, মারামারি করে সরকারী হাসপাতালের কাগজ নিতে আসা লোকের অভাব হয় না। চিকিৎসার দরকার নেই, রিপোর্টটা লিখে দিন, আগে থানায় যাই; এমন লোকই বেশী। যে যে ছুটির আগের সন্ধ্যায় মদের দোকানে লম্বা লাইন পড়ে, সেই সেই ছুটিতে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে পঞ্চায়েতী কাজও বেড়ে যায়।
এত কিছু একটা ছুটির দিন নিয়ে লিখছি কেন? আর হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও কি ছুটি থাকে না?
ছুটি আসলে হাসপাতালে থাকেই না প্রায়। দুর্গা পূজার মহাষ্টমী, বড়দিন, ঈদ এরকম মোট সাত কি আট দিন হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ থাকে। বাকি সরকারি ছুটির দিনে হাসপাতালের আপিস বন্ধ থাকে, অর্থাৎ ডাক্তারকে পঞ্চায়েতী বেশী করতে হয়। “ডাক্তার তো সরকারের পয়সায় তৈরী, লাখ লাখ টাকা রোজগার করে, মাঝে মাঝে বেশী কাজ করতে হলে করবে”। এই তো শতকরা নিরানব্বই জন লোকের বক্তব্য।
আমি কিন্তু ছুটি থাকলে ডাক্তারদের কি কি অসুবিধা হয় সেকথা লিখতে বসিনি। আমি টেবিলের উলটো দিক বা জানালার বাইরে থেকে লোকগুলি কি ভাবে, কি অবস্থায় পড়ে, বা কি রকম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।
আমি নিজে হাসপাতালে কাজ করি, তাই হাসপাতালের খবরটা ভালো জানি। কিন্তু ছুটি থাকলে সাধারণ জনগনের ঠিক কতোটা সুবিধা হয় আর অসুবিধাই বা কতোটা সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।
সরকারি আপিস আর স্কুল কলেজ ছুটি থাকলে কার কি সুবিধা অসুবিধা হয়? পূজার ছুটি বললে আমরা দুর্গা পূজার ছুটিই বুঝি। খেয়াল করে দেখেছেন কি, সরকারী আপিসে পূজার ছুটি আসছে আসছে করেই কতোদিন আগে থেকেই কাজ কর্ম সব আটকে থাকে? তারপর মহালয়া থেকেই দুর্গা পূজা শুরু হওয়ার মত, সরকারী ভাবেই পূজার ছুটি ক্রমশ বাড়ছে আর বাড়ছে। পূজার ছুটি বাদেও সরকারী আপিসগুলিতে বছরে বাহান্নটা রবিবার ছাড়াও আরও কতগুলি ছুটির দিন থাকে, গুনে দেখেছেন?
রবিবার সকাল বা যে কোন সরকারী ছুটির দিনে শহরতলীর রেল গাড়ীতে চেপে দেখেছেন কোনদিন? রেলের ঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী রবিবার আর সরকারী ছুটির দিন অনেক শহরতলীর লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকে। আমি গত কুড়ি বছর ধরে শহরতলীর লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করছি। একটা ট্রেন বাতিল থাকলেই পরের ট্রেনে ওঠাই মুস্কিল।
ছুটির দরকার সবার আছে। ডাক্তার, পুলিশ, বাস ট্রেনের ড্রাইভার কন্ডাকটর, এরা সবাই যদি আপনার মত ছুটির দিনে কাজে না যায়, কি অবস্থাটা হবে কখনো ভেবে দেখেছেন?
দিন দিন কর্মীর সংখ্যা কমছে, জনসংখ্যা বাড়ছে। কয়েক বছর ধরে নতুন জিনিস দেখা যাচ্ছে। অতি সামান্য প্রথা বা পূজা পার্বণেও ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে মহাত্মা, মহানায়কের কোন অভাব কোনদিন ছিল না। নতুন একটা ঝোঁক দেখা যাচ্ছে; ঐ সব মহান মানুষগুলির জন্মদিনে তাঁদের সম্মান দেখাতে ছুটি ঘোষণা।
কোন মহান মানুষ, কাজ না করে শুধু ছুটি উপভোগ করে দেশের উন্নতি হয়, এমন কথা বলে গেছেন কি?