(কমরেড শংকর গুহ নিয়োগীর ৩২ তম শহীদ দিবস উপলক্ষে ফেসবুকে লিখিত স্মৃতিচারণ।)
শেষ যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। হঠাৎ করে যদি তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে সংগঠনের হাল ধরবে কারা? পাঁচজন শ্রমিক নেতা, একজন যুব নেতা আর তিনজন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ছিলাম আমিও। আরো অনেক কথার সঙ্গে এই নয়জনকে নিয়ে সাময়িক এক কেন্দ্রীয় নির্ণায়ক সমিতি তৈরি করার প্রস্তাব দিয়ে গেছিলেন তিনি গোপনে রেকর্ড করা এক মাইক্রো ক্যাসেটে।
অথচ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ আততায়ীর গুলিতে তাঁর হত্যার পর তিন বছরও হয়নি, দুটুকরো হলো তাঁর তৈরি করা সংগঠন।
আমি আমি আমার নেতা, আমার শিক্ষক শংকর গুহ নিয়োগীর ও তাঁর সংগঠন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার কথা বলছি। বেঁচে থাকলে এ বছর ১৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর বয়স হতো ৮০ বছর। মারা গিয়েছিলেন ৪৯ বছর বয়সে।
যে সময়টা বেঁচে ছিলেন ভাবনায় কাজে কর্মে ছিলেন অভিনব ও অনন্য।
জলপাইগুড়ির এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সুপারিশের সুযোগ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবেন না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যান ভিলাইয়ে। খাদ্য আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাঁর বড় হওয়া, স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সক্রিয় কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সদস্য। শংকর ভিলাই ইস্পাত কারখানায় শ্রমিকের কাজ করার পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতে লাগলেন। অন্যদিকে গ্র্যাজুয়েশনের পড়াশোনা, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়াশোনা। ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করলেন।
এরমধ্যে সিপিআই ভেঙে সিপিআইএম হয়েছে, নিয়োগী নতুন দলের ঘনিষ্ঠ। ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানের পর সে দলের সংস্রাব ছেড়ে নতুন আন্দোলনের সমর্থনে। এই সময়টায়ই ভিলাই ইস্পাত কারখানা প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল নিয়োগীর নেতৃত্বে। নবগঠিত দল সি পি আই এমএল-এ অল্প কিছুদিন ছিলেন, গণসংগঠন ও গণ আন্দোলন পরিহার করতে না চাওয়ায় বহিষ্কৃত হন তিনি। তারপর ছত্তিশগড়ের গ্রামে খনিতে আত্মগোপন করে মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করে চলা। শংকর আসলে সেই সময়কার নাম, আসল নামটা ধীরেশ।
এমার্জেন্সির সময় জেলে বন্দি ছিলেন ছাড়া পান ৭৭-এ। আর একই সময়ে দল্লী রাজহরার ঠিকাদারি লোহা খনি শ্রমিকরা করে তোলে এক নতুন ইউনিয়ন ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ। শ্রমিকরা সংগঠনের নেতৃত্ব সঁপে দিয়েছিল নিয়োগীর হাতে।
১৯৭৭ থেকে তাঁর শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ে অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ইউনিয়ন শ্রমিকের কাজের সময়টুকুর সমস্যাগুলো দেখবে—মজুরি, বোনাস। চার্জশিটের জবাব, ইত্যাদি। কারখানায় বা খনিতে শ্রমিক কাজ করেন আট ঘন্টা। দিনের বাকি ১৬ ঘণ্টার দায়িত্ব ইউনিয়নের নয়—এমনটাই ছিল ধারণা।
নিয়োগী বললেন শ্রমিক জীবনের পুরোটাই শ্রমিক ইউনিয়নের বিষয় হবে—ট্রেড ইউনিয়নের প্রথাগত কাজকর্ম ছাড়াও, শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, স্বাস্থ্য , বাসস্থান, মহিলাদের শোষণ মুক্তি, নেশা বন্দী, অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্ক, জাতীয়তা প্রশ্ন—সবকিছুই ইউনিয়নের কর্মসূচিতে অন্তর্গত হলো।
আজ তাঁর নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলন বা নির্মাণ কাজের কথা বলব না। শুধু বলবো সংগ্রাম তিনি ছিলেন এক দক্ষ সেনাপতি। তিনি জানতেন কোন কোন দাবি করলে কিছু দাবি ছিনিয়ে আনা যায়, আন্দোলনরত শক্তির সঙ্গে কিভাবে মিত্রদের যুক্ত করা যায়, কিভাবে শত্রুপক্ষের ফাটলকে ব্যবহার করা যায়।
যে আন্দোলন চলাকালীন তিনি শহীদ হন তা ছিল ভিলাই শ্রমিক আন্দোলন। একদিকে ভিলাই ইস্পাত কারখানা আর রেল লাইনের অপরদিকে শতাধিক এন্সেলিয়ারি কারখানা–ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানা, কেমিক্যাল কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, মদ তৈরির কারখানা। একই সময় শ্রম দিতে হয় এই কারখানাগুলোর শ্রমিকদের, একই বাজার থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে হয়, অথচ এদের বেতন ভিলাই ইস্পাত কারখানার শ্রমিকদের মোটামুটি ছয় ভাগের এক ভাগ। সংগঠিত হওয়ার অর্থাৎ ইউনিয়ন তৈরির অধিকার নেই এই শ্রমিকদের। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতৃত্বে এরকম ৩০ টি কারখানা শ্রমিকরা স্থায়ী শিল্পে স্থায়ী চাকরী, বেঁচে থাকার উপযোগী বেতন এবং সংগঠিত হওয়ার অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেন। এই সংগ্রামের কথা পরে কখনো বলবো।
শুরুতে বলেছিলাম আমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের কথা। কেন্দ্রীয় নির্ণায়ক সমিতির দায়িত্ব ছিল সংগঠনকে চালানো, ভিলাই শ্রমিক আন্দোলনকে বিজয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া। কতটা করতে পেরেছিলাম আমরা?
সমিতি গঠনের অল্প সময়ে পরেই অন্য স্বর শোনা গেল। বলা হতে লাগলো নতুন আর্থিক নীতি, নতুন শিল্পনীতির তুফান এসেছে। ঝড়ের মধ্যে যেমন প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখা যায় না তেমনি এই তুফানের মধ্যে গণ আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের তাই নাকি মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করে কারখানায় ঢুকতে হবে, প্রয়োজনে অন্য ইউনিয়নের সদস্য হয়েও। কেন্দ্রীয় নির্ণায়ক সমিতিতে দুই লাইনের সংগ্রাম শুরু হল—শ্রেণী সংগ্রাম বনাম শ্রেণী সমঝোতা। তারপরে সাংগঠনের গণতন্ত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলো, বলা হতে লাগলো সংগঠনে যারা এগিয়ে থাকা তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। দুই লাইনের লড়াইয়ে যোগ হলো অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয়তা বনাম কেবল কেন্দ্রীয়তা। এই সময়কার বিস্তারিত বিবরণ পাবেন আমার প্রকাশিত স্মৃতিচারণে।
তারপর ১৯৯৪ এর মাঝামাঝি দল্লী খনিকে মেশিনিকরণের জন্য ইউনিয়ন ম্যানেজমেন্টের হাতে ছেড়ে দেওয়ার যে সমঝোতা করে তার বিরোধিতা করায় আমার বহিষ্কার, সঙ্গে আরো একজন কেন্দ্রীয় সমিতি সদস্য। আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে আসে শ্রমিকদের একটা অংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। চেষ্টা করি। সফল হইনি।
ছাত্র সংগঠনে দ্বিতীয় সারির সংগঠক ছিলাম, শ্রমিক আন্দোলন বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগঠক ছিলাম না, চেষ্টা করেও তাই ব্যর্থ হওয়া আর ১৯৯৫-এর শুরুতে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে স্বাস্থ্য আন্দোলন নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করা।
১৯৮৬ ডিসেম্বরে শহীদ হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলাম। সংগঠনের কাজ নিয়োগী আমাকে প্রথম দেন মাস পাঁচেক বাদে। তেসরা জুন ১৯৮৭ দিল্লি রাজহরা গুলি কান্ডের ১০ বছর পূর্তি, দশম শহিদ দিবস। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল অনুষ্ঠানে গায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও সুরেশ বিশ্বাসকে নিয়ে যাওয়ার। হেমাঙ্গ বিশ্বাস যেতে খুব আগ্রহী হলেও তাঁর গানের দলের সদস্যদের তৈরি করতে পারেননি। সুরেশদা রাজি হয়েছিলেন, তাঁকে নিয়ে গেছিল জ্যোতির্ময় সমাজদার।
১৯৮৭ তে ডা আশীষ কুমার কুন্ডু ফিরে এলেন, কয়েক মাস বাদে ডা বিনায়ক সেন কাযের জায়গা বদলালেন। আস্তে আস্তে আমার উপর কাজের দায়িত্ব বাড়তে থেকে ছিল। শ্রমিকদের নিয়ে স্টাডি সার্কেল চালানো, প্রকাশনা, বাইরের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রক্ষা, মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করা, বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে ম্যানেজারের কাজ করা ইত্যাদি। সেই সব কাজ সাধ্যমত করেছি, পারলাম না তাঁর দেওয়া শেষ দায়িত্বটা পালন করতে, সে কাজের যোগ্য ছিলাম না।
কিন্তু কিছুই কি করা যায়নি? পশ্চিমবঙ্গে এসে কানোরিয়া শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শহীদ হাসপাতালে অনুসরণে শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের গঠন, বেলিয়াতোড়, বাউরিইয়া, বাইনান, বারাসাত, জলপাইগুড়ি, মাথাভাঙ্গা, চন্ডিপুর, নৈহাটি… যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার কেন্দ্র, স্বাস্থ্যের অধিকারের প্রচার কেন্দ্র। সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি, ২০১৭ থেকে চিকিৎসক আন্দোলনে অংশ নেওয়া, অসুখ-বিসুখ পত্রিকা, স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকা… সবই শংকর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বাধীন স্বাস্থ্য আন্দোলন থেকে শেখা।
যতদিন বেঁচে থাকবো সেই রাস্তাতেই চলবো।
লেখাটি ভালো লাগলো। কয়েকবার পড়লাম। এরকম আরো লিখুন আমাদের জন্য। লাল সেলাম জানাই।