একেবারে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের রায়। মামলা উঠেছে মাননীয় বিচারপতি জাস্টিস অভয় এস ওকা এবং মাননীয় বিচারপতি জাস্টিস উজ্জ্বল ভূঞ্যার ডিভিশন বেঞ্চে। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ? অভিযোগ জনৈক শিব শংকর আগরওয়ালের বিরুদ্ধে। কী অভিযোগ? অভিযোগ হলো প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়া গাছ কেটে ফেলার। এই অবসরে অভিযোগ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে নেওয়া যাক্ । শিব শংকর আগরওয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি গতবছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে সংরক্ষিত তাজ ট্রাপিজিয়াম নামাঙ্কিত এলাকা থেকে এক রাতের মধ্যে ৪৫৪ টি গাছ কেটে ফেলেছেন বিণা অনুমতিতে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে। ভাবা যায়! ৪৫৪ টি গাছ !
এই আইনি বিতণ্ডায় বরিষ্ঠ আইনজীবী ADN Rao আদালত বন্ধু বা amicus curiae হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন বিচারের কাজে প্রয়োজনীয় তথ্য বিচারপতিদের সামনে উপস্থাপন করতে। ঘটনার অনুপুঙ্খ খুঁটিনাটি যাচাইয়ের পর তিনি এই গর্হিত কাজ সম্পর্কে তাঁর মতামত পেশ করেন। এ্যাডভোকেট রাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান – “শিব শংকর আগরওয়াল অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন। এমন অপরাধের কঠোরতম শাস্তি হওয়া উচিত যাতে দেশের মানুষের কাছে একটা বলিষ্ঠ বার্তা পাঠানো সম্ভব হয়।”
সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছেন যে কোনো বৈধ অনুমোদন ছাড়া একসাথে রাতারাতি এতো বিপুলসংখ্যক গাছ কেটে ফেলা একজন মানুষ খুনের থেকেও বড়ো ও নৃশংস অপরাধ। আদালত বন্ধুর পরামর্শ অনুসারে শিব শংকর আগরওয়ালের বিরুদ্ধে গাছপিছু একলক্ষ টাকা জরিমানা ধার্য করেছেন উচ্চতম ন্যায়ালয়ের খণ্ডপীঠের বিচারকদ্বয়।
গতকাল ২৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট খুব কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পরিবেশ নিয়ে কাজকর্ম করছেন এমন মানুষজন খানিকটা স্বস্তি বোধ করছেন। তাঁরা মনে করছেন যে এরফলে অবৈধভাবে গাছ কেটে ফেলার সাথে যুক্ত মানুষদের কাছে একটা কঠোর বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলো। এমন কঠোর রায় দেবার পরে হয়তো অবৈধভাবে গাছ কাটার আগে মানুষ একবার অন্তত ভাববে। এমন একটা সাবধানবাণী উচ্চারণ করাটা যে অত্যন্ত জরুরি ছিল তা স্বীকার করেছেন সবাই। এই রায়ের মধ্য দিয়ে একটা আইনি ‘বেঞ্চ মার্ক’ স্থাপন করা সম্ভব হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পরিবেশ কর্মী সহ সাধারণ মানুষ।
কী বলেছে ডিভিশন বেঞ্চ তার রায়ে? “ পরিবেশ সংক্রান্ত মামলায় অপরাধীদের প্রতি কোনোরকম দয়া দাক্ষিণ্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এমন কাজ একজন মানুষকে হত্যা করার থেকেও জঘন্য অপরাধ । ৪৫৪ টি গাছকে এভাবে কেটে ফেলার জন্য পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। আগামী ১০০ বছরের মধ্যেও তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। ২০১৫ সালেই এমন কাজ নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ বলে সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানানো হয়েছিলো। প্রণীত হয়েছিলো আইনের অনুশাসন।তারপরেও পরিস্থিতির সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি।এমনটা সত্যিই দুঃখজনক। এই আদালত ‘দ্যা সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড কমিটি’র ( CEC ) রিপোর্টকে যথাযথভাবে মান্যতা দিয়েই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
প্রবীণ আইনজীবী এ্যাডভোকেট মুকুল রোহাতগী মূল অপরাধী শিব শংকর আগরওয়ালের পক্ষে আদালতে সওয়াল করতে উঠে মহামান্য আদালতের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন যে তাঁর মক্কেল এমন কাজের জন্য দুঃখিত ও অনুতপ্ত। এই গাছগুলো সোশ্যাল ফরেস্ট্রি প্রকল্পের আওতায় লাগানো হয়েছিল।তাই তাঁর আর্থিক জরিমানা কম করা হোক। ঐ তাজ ট্রাপিজিয়াম নামাঙ্কিত জমির পরিবর্তে তাঁকে আশপাশের এলাকায় সমসংখ্যক গাছ লাগানোর অনুমতি দেওয়া হোক।
কোর্ট অবশ্য এই আবেদনে কর্ণপাত করেননি । বরং সোশ্যাল ফরেস্ট্রির বহুমুখী ধারণাকে এমন ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করার অপচেষ্টায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে ঐ বিপুল আর্থিক জরিমানা বহাল রেখেছেন এবং আশপাশের এলাকায় গাছ লাগানোর কথা বলেছেন। বিচারপতিরা হতবাক – এভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উপেক্ষা করা এক অপরাধমূলক প্রবণতা। এই অনিয়মকে যে কোনও মূল্যে রুখতে হবে। আদালত প্রসঙ্গে এখানেই ইতি টানবো । একটু নজর ফেরাবো ভারতের বৃক্ষ ঐতিহ্যের দিকে।
এক গৃহত্যাগী রাজপুত্রের কথা বলি। তরাইয়ের এক বৃক্ষ তলে তাঁর জন্মের পর তাঁর মা তাঁকে ঘিরে থাকা বৃক্ষরাজির উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বললেন – “হে বনদেবতা,হে মঙ্গলময় বৃক্ষ তরু,গুল্মরাজি আপনাদের প্রণাম। আপনারা আশীর্বাদ করুন, আমাদের সন্তান যেন উচ্চশির বৃক্ষের মতো মাথা উঁচিয়ে সারাজীবন কাটাতে পারে। তাঁর ছায়ায় যেন জগতের আপামর মানুষ শান্তি স্বস্তি সুখ অনুভব করে।”মানুষের দৈনন্দিন যাপন ও অন্তর্লীন জীবনবোধের সঙ্গে বৃক্ষ তথা গাছের সম্পর্ক, বিশেষত এই দেশে, সুপ্রাচীন। ভারতের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেও এমন সম্পৃক্ততার অজস্র প্রমাণ লক্ষ করা যায়। ভারতীয় মননে বৃক্ষ আদৃত হয়েছে শক্তি ও পরাক্রমের অনন্য প্রতীক হিসেবে। ধরিত্রীর বুকে হেঁটে চলে বেড়ানো অন্যান্য জীবনের
তুলনায় ধরিত্রী পৃষ্ঠে গাছের আস্থান ভঙ্গিমা সততই অনবদ্য। বসুন্ধরার নমনীয় মৃৎ আবরণীর ওপর সটান ঋজু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে গাছেরা। আর এভাবেই একটি গাছের মাধ্যমে ধরিত্রী গর্ভ, ধরিত্রী পৃষ্ঠ ও ঊর্দ্ধ নভোমন্ডলের মধ্যে এক অতুলনীয় সংযোগ স্থাপিত হয়। যে সংযোগ এক ঐশী সম্পর্কের আধার হিসেবে মান্যতা পেয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্যও যে তেমনই – জড় জাগতিক জীবনের মোহ মায়াকে হেলায় তুচ্ছ করে মন ও কর্মকে ঊর্দ্ধে বিকশিত করা । তাই সেদিন লুম্বিনীর নিবিড় বনচ্ছায়ায় মায়াদেবী যখন পুত্রের ভাবী জীবনকে আভাসিত করেন মনের একান্তে, তখনই বুঝি সন্তানের আগামীর কর্মজীবনের ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মায়ের আকুল আকুতি তথাগত বুদ্ধের জীবনপঞ্জিতে অমলিন আখর হয়ে খোদিত হয়ে যায়। গাছ, প্রকৃতি, বুদ্ধত্ব সব একাকার হয়ে যায় তথাগতর অনন্ত জীবনে।
গাছপালা লতাগুল্মের ঘন নিবিড় আশ্রয়েই একদা বিকশিত হয়েছে প্রাচীন ভারতের আশ্রমিক জীবন। গুরুর ঐকান্তিক সাহচর্যেই একদা তপোবনচ্ছায়ায় তিলেতিলে বিকশিত হয়েছে এদেশের ধী, প্রজ্ঞা, জ্ঞান। “ আরণ্যকদের সাধনা থেকে ভারতবর্ষ সভ্যতার যে প্রৈতি ( energy ) লাভ করেছিল সেটা নাকি বাইরের সংঘাত থেকে ঘটে নি, নানা প্রয়োজনের প্রতিযোগিতা থেকে জাগে নি , এইজন্যে সেই শক্তিটা প্রধানত বহিরভিমুখী হয় নি। সে ধ্যানের দ্বারা বিশ্বের গভীরতার মধ্যে প্রবেশ করেছে …. ঐশ্বর্যের উপকরণেই… ভারতবর্ষ আপনার সভ্যতার পরিচয় দেয়নি।”
জাগতিক সমৃদ্ধির উৎকট অভিপ্রদর্শনে ব্যস্ত হতে গিয়েই আজ আমরা বিপথগামী হয়েছি, কৃত্রিমতার খোলসে মুড়ে ফেলতে চাইছি সব কিছুকে। এতে যে শূন্যতার পরিসর যে ক্রমশই বাড়ছে তা বোধহয় বুঝেও না বোঝার ভাণ করে চলেছি সবাই। তাই আজ প্রাত্যহিক জীবনের দিনলিপি ভরা থাকে হনন, ধর্ষণ, লুন্ঠন আর বাহুবলীদের প্রমত্ত আস্ফালনের নিকৃষ্ট ভাষ্যে। একরাতের মধ্যে ৪৫৪ টি অমিত সম্ভাবনার স্মারককে নিকেষ করে দিয়ে জনৈক আগরওয়ালের মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা জাগেনা।এমনই এক নির্দয়, নিষ্ঠুর, নিরাভরণ পরিবেশে আমরা আমাদের উত্তর প্রজন্মকে ক্যারিয়ারের সুলুক সন্ধান দিতে সদাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার নামে। “ বিরাট প্রকৃতির মাঝখানে যেখানে যার স্বাভাবিক স্থান সেখানে তাকে স্থাপন করে দেখলে তার অত্যুগ্রতা থাকেনা ; সেইখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে এনে কেবলমাত্র মানুষের গণ্ডির মধ্যে সংকীর্ণ করে দেখলে তাকে ব্যাধির মতো অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং রক্তবর্ণ দেখতে হয় ।”
আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এখন সবকিছুই এভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
ঋণ স্বীকার
তপোবন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঋদ্ধি সাহিত্য পত্রিকার বুদ্ধ – কথা শীর্ষক ২০২৫ সংখ্যা।
টাইমস্ অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন।
ছবি প্রতিনিধিমূলক।
২৭ মার্চ,২০২৫
ঘটনাটি সংবাদ পত্রে পড়েছি আগে। বিচারপতির এই রায়ে আমার দু’টো কথা বলার আছে। গাছ যিনি কাটিয়েছেন তিনি স্বাভাবিকভাবেই মূল অভিযুক্ত একজন খুনিও বটে। কিন্তু উনি তো আর নিজে গাছগুলো কাটেননি। তিনি “সুপারি কিলার” দিয়ে গাছগুলো কাটিয়েছেন। সুতরাং মানুষ খুনের ঘটনার মতোন, এক্ষেত্রেও সুপারি কিলারকেও মানে যারা গাছ কেটেছে তাদেরকেও শাস্তি দেওয়া উচিৎ এবং যারা যারা এই গাছ খুনে সঙ্গ দিয়েছে প্রত্যেকের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। তাহলেই টাকার জন্যে এমন বেআইনি ভাবে গাছ কাটার লোকও একবার ভাববে গাছ কাটার আগে।
খুব সম্ভবত যন্ত্রচালিত করাতের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।না হলে এতো বিপুল সংখ্যক গাছ একরাতের মধ্যে কেটে ফেলা সত্যিই অসম্ভব। যাঁরা পেটের দায়ে এই গাছ কাটার কাজ করেছে তাঁরা নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। আগরওয়ালা মশাইরা চিরকাল এমনটাই করে এসেছে। এবার এই কাণ্ডে ধরা পড়েছেন। এ দেশে আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব সমানতালে চলছে। দুঃখটা এখানেই। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
সাতসকালেই লেখাটি পড়ে ফেললাম। শুরুর ভয়াবহতা অনেকটাই প্রশমিত হলো ভগবান তথাগতর কথা শুনে
সুপ্রিম কোর্ট সক্রিয় হয়ে এমন অন্যায়কারীকে শাস্তি দিয়েছে দেখে সামান্য স্বস্তি বোধ করছি। আরও লেখা চাই লেখকের কাছ থেকে।
তথাগত বুদ্ধর কথা, তাঁর বাণী এই অশান্ত সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তাঁকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আগরওয়ালের মতো মানুষেরাও এই চলতি সময়ের দান। দুঃখটা এখানেই।
আশাপ্রদ রায় ।পরিবেশের কথাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে, এটি শুনে ভালো লাগছে।
একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে বলি। এই মুকুল রোহতোগী কপিল সিব্বল রা অন্যায়ের স্বপক্ষে দাঁড়ান। জানি ভারতীয় সংবিধান সে অধিকার দিয়েছে। তবু খুব জানতে ইচ্ছে করে এদের এথিকটা কি ?বড় বড় ব্রেনের কি দায়বদ্ধতা থাকেনা?
আইনজীবীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এঁদের নৈতিকতা নিয়ে খামোখা সন্দিহান হয়েও কাজ হবেনা। এঁদের কাছে আইনের বিধিমালা সর্বশেষ কথা বলে। মুকুল রোহাতগী সাহেব একসময় ভারতের এটর্নি জেনারেল পদে আসীন ছিলেন। এটা তাঁর কাছে একটা লড়াই। ফেল করা ছাত্রকে পাশ করাতে পারলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, হয়তো এটাও অনেকটা তাই।
Unbelievable! How can a person be so merciless? Keeping the emergent situation in mind, harsher punishment has to be implemented. The greenery is getting destroyed in such manner. Mere monetary loss won’t stop these greedy people.
Thanks for your comments. My initial reaction was just like yours when I first read the article. We are really getting merciless. I agree with you that mere monetary punishment would certainly bring no change, but this will spread a strong message. l am worried that when this Shib Shankar would be replaced by another one !
Khub Bhalo laglo dada !
ভালো লাগার মতো কিছু বললাম কোথায়? সবটাইতো কঠিন কর্কশ রূঢ় বাস্তবতা। ও দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে?
I don’t think without the knowledge and association of police and administration so many (?) big trees can be eliminated overnight in any alien planet, but here in our planet, our strong and morally high police and administration system doesn’t support these criminal offenses so he could do it without their knowledge and got caught. Right? Anyways one individual got hammered by some kind of justice and that’s fair enough…
Good to see that justice prevailed…