সারা পৃথিবী আজ স্তব্ধ। কোভিড-১৯ আক্রমণের ভীতি আজ গ্রাস করেছে আমাদের সবাইকে। এই সময় আমরা নিজেদের রক্ষা করতে যেমন চিন্তিত, তার থেকেও বেশি চিন্তিত, বাড়ির ছোটদের কিভাবে বাঁচানো যায় এই মারণ ইনফেকশনের হাত থেকে। যেহেতু এই রোগ আমাদের সবার কাছেই খুব অচেনা ও নতুন তাই এই সম্পর্কে গবেষণার সুযোগ খুব কম। সারা পৃথিবী জুড়ে ছোটদের এই রোগ নিয়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা বড়ই অল্প। তবুও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত অল্পকিছু গবেষণাপত্রের তথ্যের উপর ভিত্তি করে শিশুদের ওপর এই রোগের প্রভাব সম্পর্কে যেটুকু জানা গেছে সেটাই আলোচনা করা যাক।
একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সমস্ত কোভিড-১৯ আক্রান্তের মধ্যে ৫% মাত্র শিশু। এই ভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশুই থাকে লক্ষণহীন। হালকা লক্ষণ দেখা যায় এমন শিশুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। খুব ভারী ধরনের রোগ লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ শিশু। মৃত্যুর ঘটনা ভীষণ নগণ্য, এক শতাংশেরও অনেক কম। যেখানে বড়দের মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় এক থেকে দুই শতাংশ পর্যন্ত।
রোগের উপসর্গ
আর পাঁচটা সাধারণ সর্দি কাশির মতোই এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা ও জ্বর, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা,বমি পায়খানা ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভোগে। একটি বিশেষ স্টাডিতে দেখা গেছে পুরুষ শিশুর আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কিন্তু একটু বেশি মহিলাদের তুলনায়।
কিভাবে ভাইরাসটির ঢোকে শিশুদের শরীরে ?
শিশুদের ইনফেকশন সাধারণত দু’ভাবে হতে দেখা যায়। প্রথমত কোন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ থেকে রোগ ছড়াতে পারে। অথবা কোভিড-১৯ হচ্ছে এমন জায়গায় ঘুরে আসার পরও এই রোগ সংক্রমণ হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে হাঁচি, কাশির মধ্যে দিয়ে নির্গত থুতুর ড্রপলেট অথবা হাতের মাধ্যম দিয়ে কোন সারফেস থেকে আসা ভাইরাস চোখ, নাক,মুখ দিয়ে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে যায়।
শিশুদের থেকে কি ভাবে রোগ ছড়াতে পারে?
একটা বড় অংশের (প্রায় ২৮ শতাংশের)যেহেতু লক্ষণ সেভাবে কিছু থাকে না, বাড়ির অন্যদের কাছে তারা সুস্থ হিসাবেই বিবেচিত হয় ।পরিবারের অন্য সদস্য, বিশেষত বয়স্কদের মধ্যে তারা রোগ সংক্রমিত করতে থাকে। তা ছাড়াও এরা বেশিরভাগটাই যেহেতু হ্যান্ড হাইজিন আর কাফ এটিকেট মানার উর্দ্ধে,তাই অল্প লক্ষণযুক্ত শিশুরাও হাঁচি কাশি ও হাতের মাধ্যমে অন্যদের রোগ সংক্রমিত করতে পারে। আর একটা জিনিস যেটা না বললেই না– সম্প্রতি চীন থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে দেখা গেছে শতকরা ২৯ শতাংশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুর মলের নমুনায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। তার অর্থ এটাই যে মলের মাধ্যমেও এরা রোগজীবাণু ছড়াতে পারে।
কিভাবে শিশুদের দ্বারা রোগ ছড়ানো কমবে?
কোন কোভিড রোগীর ত্রিসীমানায় না যাওয়া। শিশুদের মধ্যে ফ্লুর লক্ষণ দেখা দিলে পরিবারের সব সদস্যের কাছে তাকে না যেতে দেওয়া। বিশেষ করে বাড়ির বয়স্কদের থেকে এদের দূরে রাখা। আর বয়স্ক মানুষদের দিয়ে পায়খানার পর শৌচ করতে না দেওয়া। অন্য যিনিই করছেন, তাঁর উচিত শৌচের পরে খুব ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া আর অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যাবহার করা। যিনি পরিষ্কার করবেন তাঁর হাতে কোন আংটি না থাকাই শ্রেয়। এর ফলে হাত ঠিক করে পরিষ্কার করা যায় না, ভাইরাস হাতে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা থেকে যেতে পারে আর ছড়িয়ে যেতে পারে।
ছোটদের খাবারের মধ্যে সুষম ভাবে প্রোটিন,শাকসব্জি আর পানীয় জল ঠিক করে থাকলে, ভাল করে ঘুমোলে আর অযথা দুশ্চিন্তা না করলে ইমিউনিটি ঠিক থাকবে আর তা শিশুটিকে নভেল করোনা ভাইরাসের সাথে লড়াই করার শক্তি জোগাবে।
কেন শিশুদের মধ্যে রোগটির তীব্রতা কম হয়?
বড়দের চেয়ে ছোটদের এই রোগের তীব্রতা অনেকাংশেই কম। সম্প্রতি Pediatrics নামের এক আন্তর্জতিক মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে আমরা জানতে পারি কিছুতথ্য। তবে এই যুক্তি গুলি লেখকের ধারণা মাত্র।
১) ছোটদের মধ্যে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত এন্টিবডির পরিমাণ বেশি থাকে। অনেক সময় নভেল করোনা ভাইরাস নয় কিন্তু করোনা ভাইরাসের অন্যান্য স্ট্রেইন দিয়ে আগে ইনফেকশন হওয়ার কারণে এই ইমিউনিটি আসতে পারে, কিন্তু তার কোন জোরালো প্রমাণ নেই।
২) করোনা ভাইরাসের তীব্রতা অনেকাংশেই নির্ভর করে ইমিউনোলজিক্যাল রিয়্যাকশানের উপরে। ছোটদের ইমিউনিটি সিস্টেম এত ভাল তৈরি না হওয়ার কারণে, এদের ইমিউনোলজিকাল রিয়্যাকশানও কম হয় আর রোগের তীব্রতাও কম হয়।
৩) কোভিড-১৯ ভাইরাস যে রিসেপ্টর দিয়ে কাজ করে ,ছোটদের মধ্যে কোনো কারণে সেই বাঁধনটা খুব শক্ত হয় না তাই এদের এত খারাপ ভাবে ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা সুস্থ হয়ে ২ সপ্তাহের মধ্যে বাড়ি চলে যায়, এক-দুটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া।
তবে একবছরের মধ্যে আক্রান্ত হাওয়া বাচ্চাদের রোগের তীব্রতা আর আগের থেকে অসুস্থ শিশু যেমন আ্যস্থমা, কেমোথেরাপি চলছে এমন শিশু বা নেফ্রটিক সিনড্রোমে বেশি ডোজে চলা স্টেরয়েড খাওয়া শিশুদের মধ্যে কিন্তু রোগের তীব্রতা আর আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও অনেক বেশি অন্য সুস্থ শিশুদের তুলনায়।