করোনা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১৩ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ও প্রায় ৭০ হাজার,মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু মিছিল ও পৃথিবীজোড়া আতঙ্ক মানবজাতির কাছে যে চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করেছে তার তুলনা মেলা ভার। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে বহু মানুষের স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে স্থানান্তর, প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ক্ষতি ও ধ্বংসের সাথে মহামারির সম্পর্ক আছে। ইউরোপ ও এশিয়ার বৃহৎ অংশে ঐতিহাসিক যুগে যেসব মহামারি হয়েছে তার বেশির ভাগ হয়েছে কোন না কোন যুদ্ধের আবহে।
হালের প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যথাক্রমে নিউমোনিয়া ও প্লেগের মহামারি আমরা জানি যা ১৯১৮ ও ১৯৪১ সালে যুদ্ধের প্রাণহানির চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খৃষ্টপূর্ব ৪৩০ সালের পেলোপলিনেশিয়ান যুদ্ধ, সাইপ্রিয়ান প্লেগ (খৃঃপূ ১৬৫), জাস্টিনিয়ান প্লেগ (৫২৭ খৃ), ব্লাক ডেথ প্লেগ (১৩৪৬), কোকোলিজলি মহামারি (১৫৪৫ খৃ), লণ্ডন প্লেগ (১৬৬৫), মার্সেইল প্লেগ (১৭২০)- সবগুলি মহামারি সারা বিশ্বে কমপক্ষে ৪০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। আর সবকটির সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের অন্তর্নিহিত যুযুৎসার ইতিহাসের। অনেকে মনে করেন যে, যুদ্ধ প্রকৃতির যে স্বাভাবিক বাস্তুগত বৈচিত্র্য থাকে তাকে নষ্ট করে, বহু মানুষ তাঁদের স্বাভাবিক বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করতে বাধ্য হন তার ফলে মহামারির আদর্শ পরিবেশ তৈরী হয়।
বর্তমান মহামারির প্রথম আক্রমণ শুরু হয়েছিল করোনা ১ দিয়ে যার মৃত্যুহার ছিল ১১% । সহস্রাব্দের প্রথম দশকে করোনা যে নতুন ভয়াবহ রূপে আবির্ভাব হল বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন মধ্যপ্রাচ্য শ্বাস-পীড়া (MERS)। আরেকটি একই রকম সাংঘাতিক সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ সবাই খুব চিন্তিত ছিলেন। তার নাম হল সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস।তার,মারণ ক্ষমতা এখনো একই রকম থাকলেও তার ব্যাপকতা এখন কম। তবু ফি বছর অন্ততঃ হাজার খানেক মানুষ এখনো এই রোগে মারা যান।
এই যে বিশ্বব্যাপী চরম আতঙ্ক ও উৎকন্ঠা তা আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। শেয়ার মার্কেট বড় পতনের সম্মুখীন হয়েছে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার তলানিতে ঠেকেছে, তেলের দাম কমতে কমতে প্রায় দু দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচুতে অবস্থান করছে। এমনকি, পৃথিবীব্যাপী নিরন্তর যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ চলছিল, কোন কোন জায়গায় তারও সাময়িক বিরতি হয়েছে। সৌদি আরব ও ইয়েমেন এতদিনে শান্তি চুক্তি সই করেছে। যুদ্ধ বিপনন যাদের পেশা তারাও একটু থমকে আছে। আন্তোনিও গুতেরেস সর্বশক্তি দিয়ে এই মহামারি ঠেকানোর জন্য বিশ্বব্যাপী সব যুদ্ধ ও গোষ্ঠী সংঘর্ষ অবসান চেয়েছেন। UNAID ২০০কোটি ডলারের বিশেষ সাহায্য ঘোষণা করেছে।
করোনা ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও মারণ ক্ষমতার সাথে যদি করোনার অন্য জ্ঞাতিগুষ্টির মারণ ক্ষমতার তুলনা হয় তাহলে বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। সার্স ও মার্সের মারণ ক্ষমতা কোভিড-১৯র চেয়ে বহুগুণ বেশি। আফ্রিকার গরীব দেশের অসুখ এবোলা সিয়েরা লিওন, গিনি লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল হয়ে খোদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র লণ্ডন, এমনকি আমেরিকা পৌঁছে গেছিল। তার আক্রমণ এখনো শেষ হয়নি। সেই এবোলার মারণ ক্ষমতাও করোনার চেয়ে বহুগুণ বেশি (মৃত্যুহার ৩৭ %)। এবোলা নিয়ে সব তথ্য পাওয়া না গেলেও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলি যে এই সংক্রমণে অর্থনৈতিক ভাবে পর্যুদস্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও আমেরিকা ও ইউরোপের গায়ে আঁচ তেমন লাগে নি। বিশ্বজোড়া গেল গেল রব তেমন শোনা যায় নি।
করোনা নিয়ে যে আতঙ্ক ও ত্রাস তার দুটি দিক আছে। প্রথমতঃ এই ভাইরাস ধনী ও নির্ধনকে সমানভাবে আক্রমণ করছে। ইরানের প্রথম সারির এক ডজন ধর্মীয় ও প্রশাসনের কর্তা ইতিমধ্যে মৃত। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী প্রথম দিকেই আক্রান্ত হন, তারপর একে একে এর শিকারের তালিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুবরাজ চার্লস, প্রধানমন্ত্রী জনসন আক্রান্ত হন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তড়িঘড়ি ভাইরাস পরীক্ষা করে নিজেকে ভাইরাস-মুক্ত বলে ঘোষণা করেন। করোনার সম্ভাব্য সাম্যবাদী আক্রমণের ছোবল থেকে কেউ মুক্ত নন। তাই ধনী দেশগুলি চরম আতঙ্কের শিকার। নইলে লাইবেরিয়া বা নাইজেরিয়ার দরিদ্র নিপীড়িত মানুষ যখন আক্রমণে কাবু ছিল তখন বৃহৎ পুঁজি ও তাদের তল্পিবাহক আন্তর্জাতিক কলমচিরা যোগনিদ্রায় ব্যস্ত ছিলেন।
করোনার আরেকটি দিক হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর সংক্রমণের ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হলেও (Base Reproductive number 2-3) এর মারণ ক্ষমতা (CFR) কম। করোনা সাধারণত একটু বয়স্কদের সহজেই কাবু করে ফেলে। বিশেষতঃ যারা অন্য কোন অসুখ যথা ডায়াবেটিস, শ্বাসজনিত পীড়া বা অন্য কোন মারাত্মক অসুখ যা প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এমন অসুখে ভুগছেন। শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে। প্রথম তিনটি দশকের অল্পবয়সী ও যুবাদের মধ্যে এর মারণ ক্ষমতা যেখানে মাত্র ০.২ % সেখানে ৬০বছর বা তার বেশিদের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৩৫গুণ বেশি। সারা পৃথিবী জোড়া ক্ষমতার চূড়ায় থাকা বৃদ্ধ নেতাদের জন্য এরচেয়ে ভয়াবহ আর কিই বা হতে পারে।
করোনার সাম্যবাদী আক্রমণ যেমন একদিকে সারা বিশ্বের আতঙ্ক তেমনি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের কঙ্কালসার চেহারাটাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে চলে এসেছে। বিশ্বে এক অক্ষের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে রাজনীতির জন্ম দিয়েছে তার ফলে সম্পদের অসম বন্টনের ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী হয়েছ । মাত্র একশো জনের মানুষের কাছে পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে । এর সবচেয়ে বিষময় ফল দেখা গেছে জনস্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগে।।
জনস্বাস্থ্য নিয়ে উন্নত বিশ্বের পরিকাঠামো, পরিকল্পনা ও খরচের একটি প্রতিবেদন ১৯৮৮ সালে বের হয়। Future of Public Health নামক এই সুবিখ্যাত ও বহুপঠিত রচনাটি তৈরী হয় National Academy of Sciences ও Institute of Medicine র উদ্যোগে। তাঁরা তখন মত প্রকাশ করেছিলেন যে উন্নত বিশ্বের জনস্বাস্থ্য হল “ভঙ্গুর”। ২০০২ সালে তাঁরা আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেন যে অবস্থার কোন পরিবর্তন তো হয় নি বরং তা আরো বিশৃঙ্খল হয়েছে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও এপিডেমিওলজিষ্টদের যে দল প্রস্তুত করা উচিত ছিল তা হয় নি। একবিংশ শতাব্দীর নতুন নতুন সমস্যা মোকাবিলা করার মত ক্ষমতা তার নেই। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে তাঁরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেন যে আমেরিকার প্রতি ১০০ জন জনস্বাস্থ্য কর্মীর ৪৫ জন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অবসর নেবেন ও তাঁদের বদলে অন্য কর্মী নিয়োগের কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই। শুধু তাই নয় Government Accountability Office বলে যে, “No state is fully prepared to respond to a major public health threat”। ফেডারেল সরকারের খরচ বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য বাজেটে বিপুল ঘাটতি নিয়ে তাঁরা সরব হন।
জনস্বাস্থ্যের এই হাল ও ইন্স্যুরেন্সে অতি নির্ভরতার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বয়স্ক, কম আয়ের মানুষ ও ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম দেওয়ার ক্ষমতা নেই এমন মানুষ। ফেডারেল বাজেটে স্বাস্থ্য বিনিয়োগ কমে গেছে প্রায় ১৩ – ১৭ %। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার যুদ্ধের খরচ যা প্রায় ৩২৮ বিলিয়ন ডলার। ফলে আমেরিকার জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো আরো দুর্বল করেছে। আমেরিকা যদিও উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরী করেছে ও অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে সফলতা অর্জন করেছে কিন্তু প্রতিরোধমূলক জনস্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগ কম করার ফলে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষ, অনিয়মিত কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, কোভিড-১৯-এ যাঁরা মারা যাচ্ছেন তাঁদের অনেকেই খরচের ভয়ে প্রথমদিকে হাসপাতালমুখী হননি।
বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদি সংস্থা ল্যাটিন আমেরিকার ১৩ টি দেশে একটি সমীক্ষা চালায়। তাদের সুদীর্ঘ রিপোর্টে যে বিষয়টি উঠে এসেছে যে সরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে দেশের বড় জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত মানের আধুনিক, সর্বজনগ্রাহ্য ও সমমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়। বেসরকারি পুঁজি কখনো সরকারী বিনিয়োগের পরিপূরক নয়। কারণ, পুঁজি খোঁজে মুনাফা আর উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো হল এমন একটি জীবনদায়ী ব্যবস্থা যা স্বাস্থ্য সূচকের ধনাত্মক পরিবর্তন করে। IMR, MMR ইত্যাদি সূচক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সূচক। এই সূচকের উন্নত মান জীবনযাত্রার উন্নতির সূচক। কেরালা এই সৃচকে যেমন দেশে এক নম্বর, তার মাথা পিছু আয় তেমনি সারা ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় বহুগুণ বেশি ও তার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে কত কার্যকরী তার বাস্তব জ্বলন্ত প্রমাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করে যে উন্নত জীবনযাত্রার জন্য সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ হল শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ। ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ, বিশেষত কিউবা এই ব্যাপারে সারা বিশ্বের কাছে একটি দারুণ ইতিবাচক উদাহরণ।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য বিনিয়োগ কি বিনোদন মূলক বিনিয়োগ কিম্বা স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের ভাবনা কি ধনী নির্ধন নির্বিশেষে একরকম? Murray (১৯৯৩) রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায় যে ধনীরা যে অসুখে ভোগেন ও যা স্বাস্থ্য বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে তা মূলতঃ স্বাস্থ্য বিনোদন। টাক মাথায় চুল গজানোর জন্য বা ভিটামিন বা যৌবন অটুট রাখার জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ ও গবেষণার পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেখা যায়। অথচ, গরীব দেশে শিশুদের প্রয়োজনীয় প্রোটিন ক্যালরি অপুষ্টি বা রক্তাল্পতা কমানোর ব্যবস্থা করা যায় না। ম্যালেরিয়া নির্মূল করা যায় না অথচ জীবনশৈলী ঘটিত অসুখের যথা মেদবাহুল্য নিয়ে মধ্যবিত্তের মাথাব্যথার শেষ নেই। গরিবের জন্য সরকার ইন্স্যুরেন্স-এর ব্যবস্থা করেছেন। আমেরিকায় পয়সা খরচ করে কিনতে পারলে হাসপাতালের দরজা খুলবে না হলে বিনা খরচে চিত্রগুপ্তের খাতায় নাম লেখাতে হবে। ঠিক সেই ঘটনাটাই এখন সেখানে ঘটছে। আমেরিকায় জীবনশৈলী ঘটিত অসুখের প্রাদুর্ভাব, দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অত্যধিক চিকিৎসা খরচ এই সবকিছুর মিলিত প্রভাবে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভবিষ্যতে আমেরিকা যদি করোনার নতুন আঁতুড় ঘর হয়ে ওঠে তাহলে তা খুব বিস্ময়কর হবে না। মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা কিন্তু সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে যদিও তার পেছনের দর্শনটি হল অতীব অন্তঃসারশূন্য,পলকা ও ভঙ্গুর।
করোনায় আমাদের দেশে মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত বেশি নয়, আক্রান্তের সংখ্যা ও এখনো মাত্রাছাড়া হয় নি। এ দেশের মূল সমস্যা হল, জনস্বাস্থ্য নিয়ে দেশ নেতা ও সাধারণ মানুষ সমানভাবে অজ্ঞ। নানারকম ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিচিত্র নারকীয় চিকিৎসা পদ্ধতি অবস্থা আরো জটিল করে তুলেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে স্বাস্থ্য বিনিয়োগ। এদেশে ভোট না এলে দেশের কর্তাদের জাতীয় কর্তব্য নিয়ে মাথা ব্যথা থাকে না। জনসংখ্যা যেমন একটা বড় সমস্যা তেমনি বড় সমস্যা হল সুস্পষ্ট স্বাস্থ্য নীতির অভাব। সংক্ষেপে কয়েকটি উল্খেযোগ্য বিষয়ে আলোচনা করা যায়।
স্বাস্থ্য বিনিয়োগঃ
সারা বিশ্বে জিডিপির নিরিখে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে কম। (শতকরা একভাগের কাছাকাছি।)। মোট খরচের ৮৫.৬% ভোক্তার নিজস্ব ব্যয় (out of pocket expense)
-বাজেটের মাত্র ৩৫ % অর্থ জনস্বাস্থ্যে খরচ হয়। দরকার ৮০ %
-দেশে প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যা পিছু ৭ জন চিকিৎসক ও ১৭ জন নার্স আছেন। দরকার ১৪ জন ডাক্তার ও ২৯ জন নার্স।
-নার্স ও ডাক্তারের অনুপাত আছে ০.৬ : ১। দরকার ৩ : ১
ডাক্তারদের মাত্র ২০ % গ্রামে আছেন। গ্রামীণ জনসংখ্যা ৭০ %।
দেশে যেসব রোগে মানুষ মারা যান আর যেসব রোগ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির আওতার বাইরে তার মধ্যে সুন্দর সাদৃশ্য আছে। ইন্স্যুরেন্স কভারেজ পেতে হলে রোগী যখন ইন্স্যুরেন্স করছেন তখন কোন দীর্গ্যস্থায়ী রোগে ভুগলে চলবে না। তার জন্য প্রিমিয়াম বেড়ে যাবে বা সুবিধা আদৌ পাবেন না। প্রধানমন্ত্রী যে যোজনা ঘোষনা করেছেন সেখানে মোট পাঁচ লক্ষ টাকার সুবিধা পাওয়া যাবে। দেশে পরিবারের গড় সাইজ .৪.৮ অর্থাৎ মাথা পিছু ১ লক্ষ টাকা। যেহেতু, সরকারী ব্যবস্থায় শয্যার আকাল (প্রতি ১০,০০০ মানুষ পিছু ৭ টি শয্যা আছে) তাই ঐ সামান্য টাকা দিয়ে যে চিকিৎসা সম্ভব হবে না তা সহজেই অনুমেয়।
এদেশে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ লোক টিবিতে ও সমসংখ্যক মারা যান স্রেফ না খেতে পেয়ে। জনসংখ্যার ৫৯ ভাগ রক্তাল্পতায় ভোগেন, ৩১ % বাচ্চা দুবেলা খেতে পায় না, আর মোট শিশু মৃত্যুর ৩২ ভাগ শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় মারা যায়। সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া এই তালিকা দেখলে সহজে অনুমান করা যায় যে সরকারি বিনিয়োগ কোন ক্ষেত্রে হওয়া দরকার। অথচ, সে বিনিয়োগের ধারেকাছেও না গিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের নিয়মকদের সুভাষিত শুনলে মনে হবে দেশ আক্ষরিক অর্থে ত্রেতা যুগে ফিরে যাচ্ছে। মানুষের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ধর্মীয় আচারের আড়ালে সরকার তার পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ, প্রতিরোধযোগ্য মারণ রোগের বেশিরভাগ গরীব মানুষের, কিছু কিছু পুষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অনেকগুলি জীবনশৈলী ঘটিত সমস্যা।
এমন নয় যে কোন একটি ব্যবস্থা রাতারাতি তৈরী হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য নীতি পরিচালনার দর্শনটি আগে স্থির করতে হবে। গগনচুম্বী অট্টালিকা নাকি গ্রামের মহল্লা ক্লিনিক কোনটা দরকার? প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নাকি যন্ত্রনির্ভর চিকিৎসা, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নাকি আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, wellness centre না PHC। দেশে টীকাকরণের সার্বিক হার কম। প্রতি বছর অন্ততঃ ১৫ % শিশুর টীকাকরণ হয় না। অনেকে একটা ডোজ নিয়ে বাকিগুলো নেন না। যে দেশে ১৩৭ কোটি মানুষের নাগরিকত্ব পরীক্ষা করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয় সে দেশে হাজার হাজার পরিকল্পিত টিকাকরণ কর্মসূচি শুধু ছুঁচ বা সিরিঞ্জ কিম্বা স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা না করার জন্য বাতিল হয়।
স্বাভাবিকভাবেই এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থা আমাদের বারোমাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন। করোনার মত মারণব্যাধি আটকানোর মত যেমন আমাদের পরিকাঠামো নেই তেমনি সঠিক স্বাস্থ্যাভ্যাসও গড়ে ওঠে নি। যে দেশে নেতারা দূর থেকে ভাষণ দিয়ে ভাষণের বিষয়বস্তুও ভুলে যান সে দেশে সবকিছুই সম্ভব। সঠিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্ভব করতে হলে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার দরকার। গত জনগণনায় দেখা গেছে যে পরিবারে মা অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছেন তাঁদের সন্তান সংখ্যা সীমিত ও তাঁদের শিশুমৃত্যুর হার কম। কেরালা এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ। উত্তরপ্রদেশ ও উড়িষ্যার মধ্যে তুলনা করলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়। উড়িষ্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি শূন্যের কাছে। পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর অবস্থাও অনেকটা একরকম। অথচ বিহার ও উত্তরপ্রদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রথম সারিতে।ছোট পরিবারের সাথে শিক্ষা ও আয়ের সাযুজ্য আছে, ধর্ম বা জাতের নয়।
সুতরাং জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির সঠিক রূপায়্ণে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। শিক্ষা সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক WHO এই কথাটি উচ্চারণের পর পাঁচটি দশক অতিবাহিত হয়েছে। এ দেশের জনস্বাস্থ্যের হাল প্রতিবেশি অনেক দেশের তুলনায় খারাপ। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক মজবুত।
করোনা লক ডাউনে কেউ সরকারি নিষেধের তোয়াক্কা করছেন না। শাসকদলের নেতা বড় জমায়েত করবেন না বলে নিজেই মিছিল নিয়ে বেরোচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ পুজো করতে বেরিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতা সদলবলে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের উপর চড়াও হচ্ছেন। ধর্মীয় কুসংস্কার যে কত ভয়াবহ হতে পারে ওয়াহাবি জলসা ও সাম্প্রতিক তাবলীগের কাণ্ড তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাবলীগের সীমাহীন মূর্খামি, অন্ধবিশ্বাস ও কুশিক্ষার ফলে একযোগে প্রায় চোদ্দটি রাজ্যে ভোট পাঁচশোজন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। আলো জ্বালানো ও ঘন্টা বাজানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। পুজো পার্বণও চলছে। শুধু এদেশে নয়, এমনকি ব্রিটেনেও এই অবস্থা।
ল্যাটিন আমেরিকার থেকে ভারতের অনেক কিছু শেখার আছে। কিউবা, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা সংক্রমণ সংখ্যা ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে ও তাদের “response swift, serious and enduring” বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রশংসা করেছে। সিঙ্গাপুর ও জার্মানিও ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সেখানে সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যু বাড়ে নি। কেরালাও প্রমাণ করেছে যে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। অবরুদ্ধ মানুষের জন্য যথাযথ অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়ে আপৎকালীন ব্যবস্থাও সম্ভব। লক ডাউনের সাফল্য নির্ভর করছে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর উপযুক্ত বন্টনের উপর। রেশন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও মজুদ ৭.৫ কোটি টন খাদ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না দিলে লক ডাউনের সাফল্য আসবে না। অনেক উন্নত দেশ তাদের মোট জিডিপির ৩০ % করোনার আর্থিক প্যাকেজ হিসেবে খরচ করছে, ভারতে যা এই শতাংশের কাছাকাছি নয়। কোভিড লক ডাউন বন্ধ করে আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে হলে জনগণের মধ্যে এই রোগ কতটা ছড়িয়েছে তা জানতে হবে। তার জন্য,দরকার প্রচুর পরিমানে টেষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে এই টেষ্ট হয়েছে মাত্র ১৩০০ জনের যা প্রতি লক্ষে মাত্র ১.৩ । কেরালায় এই হার .২৭। লক ডাউন তোলার জন্য প্রচুর পরীক্ষা না করলে যে কোন রকম শিথিলতা অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য অবহেলিত থাকলে দেশ সুস্থ থাকবে না। দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অভিন্ন, সুষম, আধুনিক ও এক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতদিন না হবে ততদিন এক একটা মারণ ব্যাধি আসবে ও দেশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের সুস্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য চাই সব সাম্প্রদায়িক নিয়মের বদলে অভিন্ন আইন, সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বাজেটের বৃদ্ধি ও শ্রীনাথ রেড্ডি রিপোর্টের যথাযথ প্রয়োগ। যে দেশে গণতন্ত্র যত প্রসারিত সে দেশের মানুষ তত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় জনস্বাস্থ্য তত সুন্দরভাবে অনুসরণ করে। আইসল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দর্শন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। দেশের জন্য শুধু ছাপান্ন ইঞ্চির খাঁচা নয়, ছাপান্ন ইঞ্চির হৃদয় চাই।
তথ্যনির্ভর ও যুক্তিপূর্ণ অনবদ্য একটি বিশ্লেষণ।