“Only a crisis – actual or perceived – produces real change. When that crisis occurs, the actions that are taken depend on the ideas that are lying around. That, I believe, is our basic function: to develop alternatives to existing policies, to keep them alive and available until the politically impossible becomes politically inevitable.”
Milton Friedman (Capitalism and Freedom)
সরল অনুবাদে কথাটা দাঁড়ায়, সঙ্কট ছাড়া বদল আসে না। আর সঙ্কটকালে তেমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়, যে ধারণাগুলো আগে থেকেই পারিপার্শ্বিকে ছিল। আমাদের কর্তব্য, চালু নীতির বিপরীতে বিকল্প নীতির চর্চা, সেই চর্চা জারি রাখা – ততদিন অব্দি, যতক্ষণ না রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিকভাবে অনিবার্য হয়ে ওঠে।
অতএব এই অতিমারীর মৃত্যুমিছিলের মাঝে – হাসপাতালে শয্যাসঙ্কট, অক্সিজেনের অভাব, ওষুধ এবং টিকার অমিল বিভিন্ন ক্ষোভ-হাহাকার – এসবের মধ্যেই বিকল্প স্বাস্থ্যনীতির আলোচনা জারি রাখা আমাদের দায়িত্ব।
চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশ সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যের দাবি তুললেও সমাজের অধিকাংশ নাগরিক সেকথায় কান দেননি। ফ্রিডম্যান যেমন বলেছিলেন, সঙ্কটকালে রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাড়লেও, সেই সিদ্ধান্ত বাজারে চালু ধারণার ভিত্তিতেই নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য কিম্বা প্রতিটি নাগরিকের সুস্থতার দায় রাষ্ট্রের – এই ধারণাগুলো বাজারে চালু থাকতে পারেনি। কাজেই, অতিমারীর সঙ্কট ও অতিমারী-মোকাবিলায় বর্তমান মডেলের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্কট, কোনোটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবেই যথার্থ বিকল্প নীতির দাবি এখনও জোরগলায় ভেসে উঠছে না।
অথচ কোভিড অতিমারী বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালসার রূপটি বেআব্রু করে দিয়েছে। এই সঙ্কটের মতোই আগামীদিনেও স্বাস্থ্যসঙ্কট মোকাবিলায়, বা জনসাধারণের স্বাস্থ্যরক্ষায় এই ব্যবস্থার ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। আগামী কয়েকবছরে জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছানোর সম্ভাবনা আমাদের – এলোমেলো কিছু সিদ্ধান্তে পরিস্থিতি ঘেঁটে না গেলে, ২০৩০ সাল নাগাদ আর্থিক শক্তির বিচারে বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী হয়ে ওঠার কথাও ছিল। কিন্তু, উন্নত দেশের কথা ছেড়েই দিন, স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি, ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। জনসংখ্যার শতাংশের হিসেবে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের সংখ্যায় আমরা প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় খারাপ অবস্থায় তো বটেই, আফ্রিকার অনেক হতদরিদ্র দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি – অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যাতেও তাই। জনসংখ্যা বাড়লে অনাহার-অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়বে, অসুস্থতাও বাড়বে। যেহেতু স্বাস্থ্যখাতে অর্থবরাদ্দের হিসেবে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে নিচের সারির কিছু দেশের মধ্যে, আগামীদিনে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিকতর বিপর্যস্ত রূপ দেখতে পাওয়াও অনিবার্য।
অর্থনীতির বর্তমান মডেলে অবশ্য বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক অনাহারক্লিষ্ট শিশু নিয়ে বিশ্ব-অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে ওঠা যায়। ঠিক তেমনভাবেই স্বাস্থ্যসূচকে তলানিতে থাকা দেশের পক্ষেও স্বাস্থ্য পর্যটনের কেন্দ্রে উন্নীত হওয়া সম্ভব, মেট্রো শহরের পাঁচতারা হাসপাতালে বিশ্বমানের চিকিৎসার বন্দোবস্ত হওয়া সম্ভব। তেমনটাই হয়ে এসেছে এদেশে, আমরা মেনেও নিয়েছি নির্বিবাদে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা লাটে উঠলেও মাথা ঘামাইনি, কেননা পাঁচতারা হাসপাতাল উন্নত চিকিৎসা দিয়েছে। চিকিৎসার খরচ আকাশ ছুঁলেও আমরা মেনে নিয়েছি, কেননা নিজস্ব স্বাস্থ্যবিমার বন্দোবস্ত ছিল। আস্ত একখানা অতিমারিও কি এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ভ্রান্তি নিয়ে আমাদের ভাবাবে না?
দেশে একটা নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যপরিকাঠামো তৈরি করতে দরকার জিডিপির অন্তত পাঁচ শতাংশ। উন্নত দেশে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ তার চাইতে ঢের বেশী – কিন্তু পাঁচ শতাংশ না হলেই নয়। আমরা অত বড় স্বপ্ন দেখিনা – আপাতত জিডিপির আড়াই শতাংশই লক্ষ্য। সেটুকুও বা জুটছে কোথায়? মুখে অনেক কথা বললেও, গত কয়েক বছরে বরাদ্দটা এক থেকে সওয়া এক শতাংশের মধ্যে ঘুরছে – জল কিম্বা শৌচালয়ের বাজেট, এমনকি রেলে নারীসুরক্ষার খাতে বরাদ্দকেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের সাথে জুড়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবাজেটকে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে – তাতেও আড়াই শতাংশের ধারেকাছে পৌঁছানো যায়নি।
যেটুকু জুটছে, তারও সদ্ব্যবহার হচ্ছে তো? স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বরাদ্দ অর্থ কীভাবে খরচ হবে, সেক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ – এফিশিয়েন্সি এবং ইক্যুইটি – দুটি বিষয় সম্পর্কহীন, এমনও নয়।
সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশী মানুষকে কীভাবে সুস্থতার দিশা দেখানো যায়, এককথায় তা-ই স্বাস্থ্যব্যবস্থার এফিশিয়েন্সি। এদেশে বরাদ্দের সিংহভাগই বেরিয়ে যায় হাইটেক টার্শিয়ারি কেয়ারে। সরকারি হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপন যতখানি চমকপ্রদ, অপুষ্টিতে ভোগা গ্রামের মেয়েটির সাদা স্রাবের চিকিৎসা ততোটা নয় – কিন্তু প্রথমটির খরচায় দ্বিতীয় সমস্যায় ভোগা অনেক মানুষকে সারিয়ে তোলা সম্ভব – এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন যতজনের প্রয়োজন, তুলনায় বহুগুণ মানুষ সাদা স্রাবে ভোগেন। রাষ্ট্রকৃত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প নিয়েও আপত্তির জায়গাটা এখানেই। এক হাজার পরিবারকে পাঁচতারা হাসপাতালে পাঁচ লাখ টাকার চিকিৎসা দেওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো উপকৃত অবশ্যই হন – কিন্তু ওই পঞ্চাশ কোটি টাকা সরকারি স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় হলে উপকৃত হতে পারতেন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ। শুধুই চিকিৎসার কথা না ভেবে, জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেনটিভ হেলথ-এ উপযুক্ত অর্থ ব্যয় হলে এফিশয়েন্সি আরো বেশী – কেননা তাতে খরচ কম, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হতে পারেন অনেক বেশী মানুষ – গুরুতর অসুস্থ মানুষের সংখ্যা কমলে সরকারের পক্ষে চিকিৎসা দেওয়াও সহজও হয়, খরচও কমে।
দ্বিতীয় কথাটি ইক্যুইটি। সাম্য বা ইক্যুয়ালিটির থেকে অর্থটা একটু ভিন্ন। সবাই সমান চিকিৎসা পাবে বা স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পুরোটাই আর্থসামাজিক শ্রেণী নির্বিশেষে সমানভাবে ব্যয় হবে, তাকে ইক্যুইটি বলা যায় না। ইক্যুইটি-র অর্থ, যাঁদের প্রয়োজন বেশী, অর্থব্যয়ও হবে তাঁদের জন্য বেশী। গরীব মানুষের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা যেহেতু বেশী, ব্যয়ের সিংহভাগ তাঁদের জন্য হওয়ার কথা। কিন্তু, দেশের মডেল তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। আমাদের টার্শিয়ারি কেয়ারের উন্নতি প্রাইমারি কেয়ারের বিনিময়ে। গরীব মানুষ রক্তাল্পতা, কৃমি, জ্বর, পেটখারাপের চিকিৎসা হাতের নাগালে পেতে সমস্যায় পড়েন – কিন্তু বিনামূল্যে বাইপাস সার্জারির বন্দোবস্ত শহরে মজুত। রায়গঞ্জের ক্যানসার রোগিকে সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি নিতে কলকাতায় মাসদেড়েক থাকাখাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয় – চিকিৎসা বিনেপয়সায় মিললেও, যাতায়াত থাকাখাওয়ার জন্যে জমি বেচতে হয়।
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নড়বড়ে হওয়ায় দেশের গরীব মানুষের একটা বড় অংশ বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন – দারিদ্রসীমার উপরে থাকা কয়েকলক্ষ মানুষ স্রেফ চিকিৎসা করাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান, প্রতিবছর। দেশে চিকিৎসাখাতে যে মোট খরচ, তার দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিকরা নিজের পকেট থেকে করে থাকেন এবং এই খরচের অনেকটাই ওষুধ কেনার পিছনে। এরাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক রাজ্যের থেকে উন্নত হলেও, সামগ্রিক ছবিটা খুব অন্যরকম নয়। সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সায় ওষুধ, ন্যায্যমূল্যের দোকান অনেকখানি সুরাহা দিলেও পুরো সমাধান হয়নি। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প স্বল্পমেয়াদে কাজে এলেও, কোনো স্বাস্থ্যবিমাই দীর্ঘমেয়াদে সমাধান নয়। নির্দেশিকা মেনে চিকিৎসকরা ওষুধের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লিখলেও অধিকাংশ জায়গাতে জেনেরিক ওষুধ অমিল – দোকানদার জেনেরিক নাম অনুসারে নিজের পছন্দের ব্র্যান্ডের ওষুধ দিয়ে থাকেন – তাতে লাভ ক্রেতার চাইতে বিক্রেতারই বেশী।
ওষুধের প্রসঙ্গে আসি। বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে, এই মন্ত্রের চর্চায় কেন্দ্র ওষুধ তৈরির সরকারি কারখানাগুলো প্রায় লাটে তুলে দিয়েছেন। কাজেই, সরকারের হাতে ওষুধ তৈরির ক্ষমতা নেই। এখন ওষুধের দাম বেঁধে দিতে গেলে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিরা একজোটে বিরোধিতা করছেন, জরুরি ওষুধ তৈরি করবেন না বলে ব্ল্যাকমেইলও করছেন। সরকার প্রথমে দাম বাঁধছিলেন “কস্ট প্লাস” নীতিতে। অর্থাৎ ওষুধ তৈরির খরচ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ – মোট দাম কখনোই তৈরির খরচের দ্বিগুণ হতে পারবে না। ফার্মা লবির চাপে, এখন দাম বাঁধা হয় “মার্কেট অ্যাভারেজ” নীতিতে। সবকটি ব্র্যান্ডের দাম যোগ করে যে গড় দাম দাঁড়ায়, তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় সর্বোচ্চ মূল্য। অর্থাৎ চারটি কোম্পানি যদি একশো টাকায় একটি ওষুধ বিক্রি করে, এবং একটি কোম্পানি দাম হাঁকে এক হাজার – সরকার গড় দাম বাঁধবেন ১৪০০/৫, বা ২৮০ টাকার ভিত্তিতে। দাম কমার পরিবর্তে প্রথম চারটি কোম্পানির ওষুধের দাম বেড়ে যাবে তিনগুণ। এছাড়া হাজারো ঘোলা জল দুর্নীতি ইত্যাদি তো আছেই।
সবমিলিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি যে গুরুতর অসুস্থ, সে নিয়ে সংশয় না রাখাই ভালো। অসুস্থ হলে মানুষ আফসোস করেন, ইশশশ, যদি আগে আরেকটু নিয়ম মেনে চলতাম!! অতিমারীর সঙ্কটে বেআব্রু স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেখার পরেও কি আমরা এতটুকু ভাববো না? অতিমারী থামবে, কিন্তু বর্তমান মডেলের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্কট রয়েই যাবে। যেকথা দিয়ে শুরু করলাম, সঙ্কট বাদ দিয়ে বিকল্পের কথা কেউ ভাবে না। নিজেদের স্বার্থেই বিকল্প স্বাস্থ্যনীতির দাবিটা আমাদের তুলতে হবে এবং সে দাবি তোলার সময় এখনই। ডোনাল্ড লাইটের কথাগুলো মনে রাখলে লড়াইটা রাজনৈতিকও – “Medical care and health services are acts of political philosophy.”