২য় পর্বের পর…………
দলবল নিয়ে গেটে বাইরে অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল প্রবীর। রবি গাড়ি থেকে নামতেই রাজারহাট থানার পুলিশ তাকে হাতকড়া পরালো। তার গাড়ির গ্লাভসবক্স সার্চ করে একটা লাইসেন্স বিহীন পিস্তলও পাওয়া যায়।
‘কি চার্জে আমাকে গ্রেফতার করছেন?’
‘মূলতঃ ব্যাঙ্ক জালিয়াতির চার্জে। তাছাড়া বেআইনি অস্ত্র রাখা, সাইবার ক্রাইম, র্যানসম, ব্ল্যাকমেলিং- এগুলোও সময়মত আসবে।’
লোকাল পুলিশ অফিসার বললেন। ‘আপাততঃ থানায় চলুন।’
আর একটুও সময় নষ্ট না করে অসীমকে ফোনে ধরল প্রবীর।
‘পল্লব ব্যানার্জীকে এখুনি অ্যারেষ্ট কর।’
পূর্বপরিকল্পনামত অসীম চ্যাটার্জী আগে থেকেই ফোর্স নিয়ে প্রাইমাস বিল্ডিংয়ে পল্লবের অফিসের নীচে অপেক্ষা করছিল।
‘এ কি! আমাকে অ্যারেষ্ট করছেন কেন? আমার ল্যাপটপই তো হ্যাক হয়েছে।’
‘পর্ণোগ্রাফিক ভিডিও তোলা ও তা নিয়ে ব্যবসা করার অপরাধে। আপনার কম্পিউটার আনলক করে ফেলেছি আমরা।’
অমৃতা ব্যানার্জীর বারো লাখ টাকা উদ্ধার হয় নি। সে টাকা বিদেশের একটা ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করা হয়েছে। কবে তা উদ্ধার করা যাবে বলা খুব মুশকিল।
পরদিন, অরূপদের ফ্ল্যাটে বসে চা খেতে খেতে গুলতানি চলছে।
অরূপ বলল, ‘তোমরা দুজনেই তো এই কেস সমাধান করে ফেললে! ফাটাফাটি।’
‘না না, অসীম, শ্যামল, তনভীর- এরাও ছিল। অবশ্য লিলি অনেক রিস্ক নিয়েছে।’
‘কিরকম?’ অরূপ ভীষণ কৌতুহলী।
‘ওর মুখেই শোন।’ প্রবীর প্রশ্নটা বিদিশার দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
‘টাকাটা ফেরানো যাবে না?’
‘চেষ্টা চলছে। দেখা যাক।’
‘পুরো গল্পটা এখনো আমার ঠিক মাথায় ঢোকে নি। বলতো আর একবার।’ অরূপ রীতিমত উত্তেজিত।
প্রবীর চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, ‘পল্লবকে দিয়েই শুরু করি। তার বিজ্ঞাপন এজেন্সির ব্যবসা। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে তার ব্যবসা এখন আর ভালো চলে না। এটা আমরা জেনেছি। তাহলে সে সেক্টর ফাইভে এতবড় অফিস চালায় কি করে? আর চালায় কেন?
তাহলে হয়ত তলায় তলায় তার অন্য ব্যবসা আছে! কি সে ব্যবসা? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে আসা মডেলদের প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে ঝাড়খন্ড, আসাম, সিকিমের কম পরিচিত আউটডোর লোকেশনে নিয়ে গিয়ে পর্ণগ্রাফিক ভিডিওর শ্যুটিং করে। তারপর সেগুলো ভালো দামে বিক্রি করে। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে, এদের মধ্যে কিছু কিছু অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েও আছে। ডার্ক ওয়েবে ওগুলো বিক্রি হয়।
‘ডার্ক ওয়েব’ হল ইন্টারনেটের এমন একটা অংশ যেটা আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে ট্র্যাক করা যায় না। তাই ডার্ক ওয়েব হল যত রাজ্যের সাইবার অপরাধীদের আখড়া।
অমৃতা তার স্বামীর এইসব কুকীর্তি কিছুটা আন্দাজ করে, কিন্তু পুরোটা জানে না। পল্লব তাকে একেবারেই সময় দেয় না। মাঝে মাঝেই আউটডোরের নামে উধাও হয়ে যায়। হতাশ অমৃতা এদিকে সিরিয়াল করতে করতে হ্যান্ডসাম ফটোগ্রাফার রবির প্রেমের জালে ফেঁসে যায়।
বি এ রবির আসল নাম বিলাল আজিজ রবি। সে ও তার দাদা সলিল আদতে বাংলাদেশের লোক। সলিলের পুরো নাম এইচ এ সলিল বা হায়দার আজিজ সলিল। তার সিঙ্গাপুরে হোটেলের ব্যবসা। মোটা টাকা ও উঁচুমহলে যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সে ভাইকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করে এবং ফ্ল্যাট কিনে দেয়।
নতুন উপনগরীর উচ্চবিত্ত আবাসনে কেউ কারো খোঁজ রাখে না। ফ্ল্যাটটাও দশতলায়, কোনার দিকে। নিরিবিলিতে সিনেমা, সিরিয়ালের নায়িকাদের নিয়ে আসে রবি। কেউকেটা লোকদেরও মনোরঞ্জন করে।
পল্লব যখন আউটডোরে যায় অমৃতা তখন রবির ফ্ল্যাটে রাতে থেকে যায়। শ্যুটিং নিয়ে মাতোয়ারা পল্লব এসব ঘূণাক্ষরেও জানতে পারে না।
অমৃতা তার অফিসিয়াল সিমকার্ড টা আইফোন থেকে খুলে অন্য একটা সিম ফোনে ভরে রাজারহাটের ফ্ল্যাটে আসে। সেই কারনে আর সম্ভাব্য গতিবিধির সাথে আমাদের মোবাইল ট্র্যাকিং এর রেজাল্ট মিলছিল না।
অমৃতার কাজকর্ম নিয়ে সন্দেহ হতে আমি লিলিকে অসীমের সাথে শ্যুটিংয়ের ফ্লোরে পাঠাই। ওরা সেখানে একষ্ট্রার রোলে কাজ জোগাড় করে ফেলে!’
‘হা হা হা। তাহলে চাইলে ফিল্মেও কাজ করতে পারতাম!’ বিদিশা বলে।
‘নাঃ, তুই যা করছিস তাই করে যা।’
‘অবশ্যই।’ বিদিশা আশ্বস্ত করে সবাইকে। তারপর বর্ণনা দেয়, ‘ওখানে গিয়ে দেখি অমৃতার সাথে সবসময় ঘুরছে যে লোকটা সে হল ওই সিরিয়ালের ফটোগ্রাফার রবি। অন্যদের থেকে কানাঘুষোয় শুনি তার সাথে অমৃতার সম্পর্ক আছে। তখন আমি আগ বাড়িয়ে লোকটার সাথে কয়েকবার কথা বলি। সে তখন উৎসুক হয়ে বলে, আমার নাকি হিরোইন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য তার জন্য আমাকে একটা আকর্ষণীয় প্রোফাইল বানাতে হবে। সে নিজেই আমাকে সেটা বানিয়ে দেবে। শ্যুটিং হবে তার রাজারহাটের ফ্ল্যাটে। সেখানকার ঠিকানা দেয় আমাকে।’
‘অ্যাঁ, বল কি?’ অরূপ রীতিমতো আতঙ্কিত।
তখন প্রবীর বলে, ‘অমৃতার ফোনটার ফরেনসিক টেষ্ট করে আমরা তার গোপন সিমকার্ড-এর নম্বরটা পেয়ে যাই। তার টাওয়ার লোকেশন লিলির জোগাড় করা রবির ফ্ল্যাটের ঠিকানার সঙ্গে মিলে যায়। তারপর আমরা ওখানে হানা দিই।
সিনেমা-সিরিয়ালের ফটোগ্রাফির রোজগারে রবি তার এত ঠাটবাট বজায় রাখতে পারছিল না। সে আরো বড় খেলোয়াড়। তাই টাকা জোগাড়ের অন্য ধান্দা দেখে।
৬ই জুলাই রাতে অমৃতা তার ফ্ল্যাটে ছিল। সে ঘুমিয়ে পড়লে তার পার্সে রাখা ডেবিট কার্ডের নম্বর, সিভিভি নম্বর রবি জোগাড় করে। তারপর তার জালিয়াতির সাকরেদরা সেই রাতেই বারো লাখ টাকা অমৃতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে ফেলে। অফিসিয়াল সিমটা ফোন থেকে খুলে রাখার ফলে সকালের আগে অমৃতা সেটা টের পায় না। রবিকে সে সন্দেহও করে নি। সাতই জুলাই টাকা খোয়া যাওয়ার ব্যপারটা বুঝতে পেরেই সে সাইবার ক্রাইম সেকশনে আসে। তদন্ত শুরু হয়। খোজখবর শুরু করতে কেসটা বেশ গোলমেলে মনে হয় আমাদের।
পল্লবের কাজকর্মের কথা সম্ভবতঃ রবিকে বলে থাকবে অমৃতা। সুযোগ বুঝে রবি পরের সপ্তাহেই আরো বড় দাঁও মারার প্ল্যান করে। অমৃতা ঘুমিয়ে পড়ার পর তার ফোন থেকে পল্লবকে সে একটা র্যানসমওয়্যার-এর লিঙ্ক পাঠায়। পল্লব না বুঝে স্ত্রীর পাঠানো ইমেলের লিঙ্ক ক্লিক করতেই হ্যাকাররা তার কম্পিউটারের দখল নেয়।’
‘র্যানসমওয়্যার কি?’
‘এটা এক ধরণের ভাইরাস যেটা অন্যের কম্পিউটারে প্ল্যান্ট করে দূর থেকে সেই কম্পিউটারের দখল নেওয়া যায়। আসল মালিক সেই কমপিউটার আর খুলতে পারে না। তারপর গুরুত্বপূর্ণ ডেটা, ছবি, ভিডিও এসব নষ্ট করে দেবে বা ইন্টারনেটে বিক্রি করে বা ছড়িয়ে দেবে এই ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে, এমনকি মুক্তিপণ পর্যন্ত দাবী করে। ডিপ ওয়েব দিয়ে এটা করা যায়। তাই এদের হাতেনাতে ধরা খুব কঠিন।
পল্লবের কাছে এক লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবী করা হয়েছিল। শ্যামল অসাধারণ কাজ করে ল্যাপটপটা আনলক করেছে। কিন্তু আমাদের ধারণা, ওর হাই রেজোলিউশন ভিডিওগুলো ইতিমধ্যেই ডার্ক ওয়েবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’
‘তাহলে তো এটা চোরের উপরে বাটপাড়ি।’ অরূপ বলে।
‘একদম তাই।’
(শেষ)