এই পর্বের একটা চিঠি অরবিন্দের আমাকে লেখা। আমি তখন কলকাতায়। বাকি চিঠি আমার চঞ্চলাকে লেখা। অপরিবর্তিত। আজকের সংযোজন বন্ধনীর মধ্যে।
১১.১.৮২
একটা কাজে ইউনিয়ন অফিসে বসে লিখছি, পাশে শৈবাল, পবিত্র, তিমু বসে আছে।
(তিমু—তিমির মুখার্জী। আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত। তিমু শৈবালকে সাথে নিয়ে দল্লী রাজহরা আসে কয়েকদিনের জন্য।)
তিমু কাল ফিরে যাবে। তোর পাঠানো বিস্কুট আর অন্য খাবারগুলো খাচ্ছি।
শৈবালের চাকরীটা এখনও ঝুলে আছে। (ইউনিয়ন অফিস থেকে মাইল তিনেক দূরে একটা মিশনারী হাসপাতাল আছে—পুষ্পা হাসপাতাল। আমি যখন দল্লী রাজহরা যাই তখন ওদের কোন ডাক্তার ছিল না। তাই ওখানকার সিস্টাররা আমাকে মাঝে মাঝে ডেকে পাঠাতো রুগী দেখার জন্য। একদিন ওখানে একটা পাঞ্জাবী পরে গেছিলাম। পাঞ্জাবীটা একটু ছেঁড়া ছিল। সিস্টাররা আমাকে একটা নতুন পাঞ্জাবী কিনে দেয়।
পুষ্পা হাসপাতাল একজন স্থায়ী ডাক্তার খুঁজছিল। আমি আমার কলকাতার বন্ধুদের লিখে জানাই। সাথে সাথেই শৈবাল—ও তখন স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছিল, পড়াশোনা ছেড়ে চাকরী করতে দল্লী রাজহরা চলে আসে।)
১৫ই জানুয়ারী চাকরীটা হবে কিনা জানা যাবে। এখানে কদিন বেশ গরম যাচ্ছে। আজই হঠাৎ মেঘলা হয়ে গেছে। হাওয়া দিচ্ছে আর একটু একটু ঠান্ডা লাগছে।
এখানে tension অনেকটা কমে গেছে। নিয়োগী দু-তিন দিনের জন্য বাইরে গেছে, মুহল্লার কাজকর্ম এক হপ্তার জন্য পিছিয়ে গেছে। ম্যাগাজিনের কাজকর্ম একটূ পিছিয়ে গেল। (মিতান নামে একটা পত্রিকা আমরা প্রকাশ করা শুরু করি।) বিনায়কদা আগামীকাল ফিরবে বলে মনে হয়। ফেব্রুয়ারী মাসে আমি আর শৈবাল কলকাতা যাব ভাবছি—অবশ্য নিয়োগীর সাথে একটু কথা বলতে হবে—আর দেখতে হবে পবিত্র আর বিনয়কদা তখন থাকে কিনা। যদি যাই তাহলে সাত দিনের জন্য ধানবাদ যাব। সন্ধ্যে বেলা—ঘরে বসে লিখছি। তিমু গেছে বাজার করতে, ও ঠিক করেছে আজ ও খিচুড়ি বানাবে—জনক, সহদেব, আনসার আর পবিত্র খাবে। শৈবাল গেছে পুষ্পা হাসপাতালে একটা রোগী দেখতে।
(জনক—জনকলাল ঠাকুর, খাদানের শ্রমিক ছিল। ওর মাও খাদানে কাজ করতেন। আমি যখন যাই তখন জনক ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতা, ও পাঁচ বছরের জন্য মুক্তি মোর্চার তরফে বিধানসভার বিধায়ক ছিল।
সহদেব—সহদেব সাহু, একসময় খাদানে ট্রাক চালাত। আমি যখন যাই তখন ইউনিয়নের বড় নেতা—নিয়োগীর ডান হাত। কয়েক বছর পর ইউনিয়ন বিরোধী কাজ কর্মের জন্য ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়।)
সর্দি কাশি হচ্ছে, শরীরটা খারাপ। সিগারেটটা ছাড়া উচিত। কিন্তু এত ভালো লাগে খেতে।
১৭.১.৮১
শৈবাল পুষ্পা হাসপাতালে চাকরীটা পেয়ে গেছে, আমাদের সাথেই আছে। কাল কোয়ার্টারে চলে যাবে। মাঝে মাঝে আমাদের সাথে থাকবে। ও আজ ইউনিয়ন অফিসে এসেছে।
আজ আমার তত্ত্বাবধানে একটা মুহল্লায় লাইব্রেরী চালু হচ্ছে। মাত্র এগারোটা বই দিয়ে। মাত্র এই কটাই বই জোগাড় করা গেছে, তাতেই ছেলেদের কি উৎসাহ। বইয়ের মলাট দিচ্ছে, লিস্ট বানাচ্ছে, বাইরে লিখে দিয়েছে ‘পুস্তক কা ঘর’। একই সাথে ক্রেশ কাল থেকে চালু হচ্ছে—একটা ঘরে। বাইরে লেখা ‘বচ্চো কা ঘর’। দু তিন দিনের মধ্যে আরো কিছু কিছু বই কিনে আনব।
(দল্লী রাজহরায় শ্রমিক মুহল্লায় ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের বানানো একটা বড় ক্রেশ ছিল। চার পাঁচজন স্টাফ। কোনও কারণে কোন শ্রমিকই নিজেদের ছেলে মেয়েকে ওখানে রাখত না। তাই নিয়োগীর সাথে কথা বলে একটা experiment হিসেবে আমি এই ক্রেশ চালু করি।)
কাল ভিলাই যেতে হবে। ওখানে শহীদ মেলাটা সাতদিনের জন্য লাগানো হবে।
রাত সাড়ে আটটা—একটু আগে আমি আর শৈবাল বাইরে খেয়ে ফিরেছি, আজ সারাদিনই মুহল্লায় কাটিয়েছি। শৈবালও ছিল। ক্রেশ কাল চালু হবে নাস, কয়েকটা কাজ বাকি আছে। বৃহস্পতিবার একটা মিটিং করে শুক্রবার চালু করা হবে। আগামীকাল আমার ভিলাই যাওয়ার কথা। নিয়োগীর আজ দিল্লী থেকে ফেরার কথা। এখনো ফেরেনি। আজ না ফিরলে সমস্যা হবে। প্রচুর কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে। ১৫ ই জানুয়ারী ব্যাপারে এখনো কোন stand নেওয়া হয়নি।
১৮.১.৮২
নিয়োগী আজ ফিরেছে। ভিলাই আজ যাব কিনা এখনও জানি না।
২৬.১.৮২
ঘরে বসে লিখছি। ঘরে আরো দশজন ছেলে। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে। অতিথি, এটা একটা tourist spot হয়ে গেছে মনে হয়।
আজ একটু ক্লান্ত লাগছে। সকালবেলায় ইউনিয়ন অফিসে জনসভা ছিল। আমাদের ডিস্পেন্সারী উদ্বোধন হল। আমাকেই নারকেল ভেঙ্গে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে উদ্বোধন করতে হল। তারপর বিনায়কদা আর পবিত্রর সাথে তীব্র বিতর্কে বসেছিলাম, বেশ tensionএর বিতর্ক। আজ নিয়োগী জনসভায় ভাষণ দিতে বলেছিল। দিইনি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে দিলেই ভাল হত। ঘরে এতগুলো ছেলে। ঘর দোর নোংরা করে রেখেছে। সবমিলিয়ে সারাদিনের শেষে বেশ ক্লান্ত, আমার ক্রেশ চালু হয়ে গেছে। এখন কি করব বুঝতে পারছি না। বাচ্চাদের সামলানো কি আমাকে দিয়ে হয়? কেউ কাঁদে, কেউ ঘুমিয়ে পড়ে—এক বিশ্রী ব্যাপার। আজ বন্ধ ছিল। আগামীকাল আবার খুলবে। দেখা যাক কি হয়।
আগামীকাল বিনায়কদারা দশদিনের জন্য বেরিয়ে যাচ্ছে। এখন আমার বিরাট comfort শৈবাল। প্রায় রাত্রেই চলে যাই শৈবালের কোয়ার্টারে।
৫.৩.১৯৮২
অরবিন্দ—আমাকে, ইংরেজী থেকে অনুবাদ
আশীষ, হোলির মিষ্টি গন্ধ হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে একটু নিঃসঙ্গ লাগছে। পবিত্র তিনদিন আগে বর্ধমান চলে গেল—একটা টেলিফোন পেয়ে। ওর বাবা খুব অসুস্থ।
লক আউট চলছে। তবে আলাপ আলোচনা, pressurisationও চলছে। আর মনে হচ্ছে দুই তিন দিনের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে যাবে।
ক্রেশ চলছে। তবে সন্ধ্যেবেলার ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে না, আমি না থাকলে খুব কম বাচ্চাই আসে।
দিল্লী থেকে অমিত এসছিল দশ দিনের জন্য। ও কিছু মজদূরের সাথে study circle-এর মত করলো।
আমার খুব তাড়াতাড়ি একটা drilling machine আর একটা drilling machine কিনব।
প্রথমে আমরা হাসপাতালের জন্য গ্রীল তৈরী করব। তারপর অন্যান্য কাজ।
আমরা অপেক্ষা করে আছি কবে তুমি আর চঞ্চলা ফিরে আসবে।
(অরবিন্দ—অরবিন্দ গুপ্তা। আই আই টি কানপুরের স্নাতক electrical engineering-এ। অত্যন্ত ধনী পরিবারের ছেলে। বলতো আমি তোমাদের মতো পেটিবুর্জোয়া নই। আমি বুর্জোয়া পরিবারের ছেলে। কিভাবে রাজহরায় এসে উপস্থিত হয়েছিল মনে নেই। তবে আমাদের মতই মুহল্লায় ডাল ভাত খেয়ে দিব্বি খোস মেজাজে থাকত।
ও আমাকে ক্রেশে সাহায্য করত। বাচ্চাদের টুকরো টাকরা রাস্তায় পড়ে থাকা জিনিস দিয়ে খেলনা বানাতো, পরে ওর match box tipper truck খুব প্রশংসিত হয়।
ও ইউনিয়নের কোঅপারেটিভ গ্যারেজ তৈরী করার মূল দায়িত্বে ছিল।
আজ অরবিন্দ খুব নামকরা লোক। বাচ্চাদের সামান্য জিনিষ দিয়ে খেলনা বানানোর প্রক্রিয়ার জন্য অনেক award পেয়েছে, ওর অনেক বইও প্রকাশিত হয়েছে।)
(চলবে)
খুব ভাল লাগছে পড়তে।