হেডিংলিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনের সকালে ইংল্যান্ডের ২৭০ রান টপকাতে প্রায় একাই লড়াই দিচ্ছিলেন ল্যারি গোমস। নবম উইকেটের পতনের সময় অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর স্কোর তখন ৯৬ নট আউট। ড্রেসিং রুমে তখনো ব্যাট করতে নামা বাকি কেবল ম্যালকম মার্শালের, যিনি বোলার হিসেবেই বিখ্যাত, ব্যাটসম্যান হিসেবে নন। তার ওপরে ওই টেস্টের প্রথম দিনেই ক্রিস ব্রডের একটা শট হাত দিয়ে আটকাতে গিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে ডাবল ফ্র্যাকচার মার্শালের। ওটা “নন বোলিং আর্ম” হলেও ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছিলেন ১০ দিন বিশ্রামে থাকার।
কাজেই হতাশ মনেই গোমস প্রায় হাঁটা শুরু করেছিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে। সঙ্গে সেঞ্চুরি ফস্কে যাওয়ার আফসোস নিয়ে। ক্রিকেট একটা অদ্ভুত খেলা। একা একজন ব্যাট করতে পারে না। সঙ্গে পার্টনার লাগে।
হঠাৎ মাঠ ভর্তি দর্শক আর ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের মতো একই রকম অবাক চোখে গোমস দেখলেন, ড্রেসিং রুমের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আসছেন মার্শাল। বাম হাতটা প্লাস্টারে জড়ানো।
আক্ষরিক অর্থে এক হাতে ব্যাট করে আট আটটা বল খেলেছিলেন মার্শাল। তার মধ্যে একপিস বাউন্ডারিও। গোমস পেয়েছিলেন একখানা অমূল্য সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে।
পরে এক স্বাক্ষাৎকারে মার্শাল জানিয়েছিলেন যে তাঁর বন্ধু গোমসের এমন হিরোইক একটা সেঞ্চুরি হাতছাড়া হয়ে যাবে পার্টনারের অভাব থেকে সেই ভাবনায় ক্যাপ্টেন লয়েডের নির্দেশ অমান্য করেই তাঁর মাঠে নামা। ক্রিকেট খেলার ইতিহাসে অন্যতম হিরোইক ইনিংস হল মার্শালের সেই এক হাতে ব্যাট।
আমাদের অফিসে অবসর নিয়েছিলেন শঙ্কর মাইতি। GDA। লোকে যাঁদের গ্রূপ ডি বলে ডাকে। অবসর নেওয়ার আগেই এসে গিয়েছিল করোনার উপদ্রব। ওনাকে, আমাদের সকলের প্রিয় শঙ্করদাকে বলেছিলাম, বয়েস হয়েছে, কো-মর্বিডিটি আছে। এমন সময়টা ডিউটিতে আসা বিপজ্জনক। জমা ছুটি আছে অনেক। ছুটি নিন। আর কাজে আসতে হবে না।
শঙ্করদা শোনেননি সে কথা। টানা শেষ দু’মাস একই রকম নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেলেন। চাকরি জীবনের শেষ দু’মাস। বলেছিলেন, আপনারা সবাই কাজে থাকছেন, আমি কেন ঘর পালিয়ে যাবো। শংকরদার মতো অনেক জেনারেল ডিউটি এটেন্ডেন্ট আজ কোভিভ ওয়ার্ডে ডিউটি করছেন। এই মাত্র দেখে এলাম কয়েকজনকে। রুগীর প্রাণ বাঁচানো একটা টিম ওয়ার্ক চিকিৎসক যার নেতৃত্বে থাকেন। কিন্তু সফল অভিযানে প্রত্যেকেরই রোল আছে, গুরুত্বপূর্ণ রোল।
গোমসের সেঞ্চুরি হয়েছিল তাঁর পার্টনারের সেই অকুতোভয় ছোট্ট ইনিংসের জন্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা শেষমেশ জিতে ছিল।
করোনা নিয়ে লড়াই কদিন হবে জানা নেই। কিন্তু আমার পার্টনার শঙ্করদার সেই দুমাসের ছোট্ট ইনিংসটা সারা জীবন ভুলতে পারবো না। পার্টনারশিপ ছাড়া ক্রিকেট খেলা যায় না, টেস্ট জেতা যায় না, সেঞ্চুরি হয় না। জীবনের ছোট বড় কোনো যুদ্ধই জেতা যায় না।
শঙ্করদা কোনোকালেই ঠিক “জো হুজুর” টাইপের ছিলেন না। বিনয়ের সাথে তর্ক জুড়তেন প্রচুর। শেষ অবাধ্যতাটা মনে রাখবো না। লয়েড মনে রাখেন নি। ম্যালকম মার্শালরা একটু অবাধ্য একগুঁয়ে জেদি হন। আর সে জন্যই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা রাখতেন। আজ আপনি যখন এই লেখাটা পড়ছেন শঙ্করদার অনেক উত্তরাধিকারী কোভিভ ওয়ার্ডে অক্লান্ত ডিউটি করছেন পিপিই পরে ঘেমে নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঠেলছেন। সবার নামও জানিনা।
সেদিন সেঞ্চুরির পরে গোমস ব্যাট তুলেছিলেন তাঁর পার্টনারকে কৃতজ্ঞতা জানাতে, তাঁর হিরোইজমকে শ্রদ্ধা জানাতে। ব্যাট আমরাও তুলবো শঙ্করদা আপনার উদ্দেশ্যে। যুদ্ধটা জিতে ফিরি একবার। ভালো থাকবেন। আমাদের, নন্দীগ্রাম স্বাস্থ্য জেলার প্রত্যেক GDA ওয়ার্ড বয়, ওয়ার্ড গার্ল – সবার একসাথে লড়াইকে মনে রাখবো। মার্শাল না থাকলে গোমস একা সেদিন সেঞ্চুরি করতে পারতেন না, ক্রিকেট একটা টিম গেম। আমাদের কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইটাও তাই, টিমগেম।
৯৬ তে আটকে আছি শঙ্করদা। ৯৬ টা দিন কোভিভ কেস শূন্য। সেঞ্চুরি হতে চারটে দিন। হেডিংলির ড্রেসিং রুম থেকে প্লাস্টার বাঁধা হাতে কালোকুলো চওড়া হাসিমুখে কে যেন তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। ম্যাচটা জিততে হবে তো ?
(গত বছরের লেখা)