করোনা ছোঁয়াচে, করোনাতঙ্ক তার চেয়েও বেশি ছোঁয়াচে। এক পরিবারের চারজন এসেছেন। বাবা, মা এবং তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে।
বাবা, মায়ের বয়স চল্লিশের মধ্যে। ছেলের ষোলো বছর। মেয়েটি একেবারেই ছোটো। বয়স আটের নীচে।
মায়ের প্রথম সমস্যা শুরু হয়েছে। আজ সকাল থেকেই একটু একটু গলা ব্যথা করছিল। ভদ্রমহিলা ফেসবুক থেকে জেনেছেন মধ্যমগ্রামের কারবেলায় নাকি করোনা রোগী পাওয়া গেছে। ভদ্রমহিলার বাড়িও কারবেলায়। খবরটা শোনার পর থেকেই ওনার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে আর বুকে ব্যথা। তাঁর কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর স্বামী ও পুত্রেরও গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। একমাত্র ছোটো মেয়েটিই স্বাভাবিক আছে।
চিকেন পক্সের রোগী দেখছিলাম। তাঁরও একই জিজ্ঞাস্য, করোনা হয়নি তো। তাঁকে একটা জোরদার ধমক লাগাতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাইরে হইচই।
বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম, মা আর ছেলে চোখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। বাবা হাউমাউ করে কাঁদছেন। আর ঝাঁকড়া চুলের ছোটো মেয়েটি বড় বড় চোখ করে সকলের কাণ্ড কারখানা দেখছে।
স্টেরিলিটির ১০৮ করে তিনজনকে ভেতরে এনে শোয়ানো হল। মানসিক রোগের চিকিৎসক নই। কিন্তু এই কদিনে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন আর প্যানিক অ্যাটাকের এতো কেস দেখছি যে মোটামুটি মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি।
বাকি রোগীরাও চেম্বারের দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। মহামারীর ভয়ের চাইতেও কৌতূহলের জোর বেশি। ধমক দিয়ে তাঁদের বাইরে পাঠানো হল। মহিলার মাস্ক খুললাম। দাঁতে দাঁত আটকে আছে। তাঁর ফাঁক দিয়ে একটা ‘মুখের ভেতর গলে যাওয়া’ ট্যাবলেট চালান করলাম।
ভদ্রলোক হাহাকার করে বললেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। ছেলে, মেয়ে দুটোর কি হবে?
আমি বললাম, দয়া করে শান্ত হোন। আপনি অবুঝ হলে ওরা আরও ঘাবড়ে যাবে।
প্যানিক অ্যাটাকের একটা বৈশিষ্ট্য হল ডাক্তারবাবু সামনে থাকলে, সে যতই আমার মতো নিধিরাম সর্দার ডাক্তারই হোক না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। ওষুধ-পত্র লিখে সাগর দত্ত হাসপাতালের সাইক্রিয়াট্রি আউটডোরে রেফার করে ওনাদের বাড়িতে পাঠালাম। ভদ্রলোক বৌবাজারে সোনার কাজ করতেন। এমনিতেই সোনার কাজের বাজার খারাপ। তাঁর উপর লক-ডাউনের ফলে কাজ পুরোপুরি বন্ধ।
কাজ হারানোর ভয়ে অনেকের মধ্যে সাইকোসিসও দেখা যাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে একজন রঙের কাজটাজ করতেন। কালকে তাঁর ছেলে নিয়ে এসেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই পাগলামি করছেন। সারাক্ষণ বিড়বিড় করছেন। এই হাসছেন, এই কাঁদছেন।
আবার আরেকজন রোগীর বাড়ির লোকের অবস্থা করুন। লক ডাউনের শুরু থেকেই ভদ্রমহিলা বাড়াবাড়ি রকমের সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন। তার ঠেলায় বাড়ির লোকের জীবন ওষ্ঠাগত। বয়স্ক মহিলার ধারণা বাড়ির লোকেরা তাঁর ক্ষতি করতে চায়। এমনকি কোনও ওষুধও খেতে চাইছেন না। বউমা ওষুধ খাওয়াতে এলে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন ওষুধ খাবেন কিনা।
হাত ধোয়ার বাতিক অনেকের মধ্যেই ওবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে অনেকেরই হাতে ঘা হয়ে গেছে। তবু তাঁরা হাত ধুয়েই চলেছেন।
কবে যে এই ভয়ংকর দিনগুলোর শেষ হবে কেউ জানেনা। অনেক ঘরেই জমানো টাকা পয়সা শেষের দিকে। লক-ডাউন আরও বাড়তে পারে এই আতঙ্ক তাঁদের অস্থির করে দিচ্ছে। আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আত্মহত্যার করার কথাও চিন্তা ভাবনা করছেন।
একদিন নিশ্চিত ভাবেই এই মহামারীর প্রকোপ কেটে যাবে। হয়তো মহামারী পরবর্তী পৃথিবীটা আগের চাইতে আরেকটু ভালো হবে। সেদিনের জন্য আমাদের বেঁচে থাকতেই হবে। শুধু সুস্থ শরীরে নয়, সুস্থ মনেও। করোনার দিনগুলো আমাদের যে করেই হোক কাটিয়ে দিতে হবে। কাটিয়ে দিতে হবে প্রিয়জনদের মুখ চেয়ে। কাটিয়ে দিতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে।