রোজই বেরোতে হচ্ছে। আগে সোদপুরে স্কুটারে যেতে সময় লাগত কুড়ি মিনিট। এখন আট মিনিটেই পৌঁছে যাচ্ছি।
প্রথম প্রথম রোমাঞ্চ লাগত ফাঁকা রাস্তায় স্কুটার চালাতে। মনে হত অন্যরা যখন ঘরে দরজা জানলা বন্ধ করে এক অজানা শত্রুর ভয়ে কাঁপছে, আমি তখন সেই ভয়ঙ্কর শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ে নেমে পড়েছি। এই লড়াইয়ের সুযোগ অনেক চিকিৎসক সারাজীবনেও পায় না। আমি সেই সুযোগ পেয়েছি।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সেই রোমান্টিকতা বদলে যাচ্ছে। বড্ড একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে। কিসের যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কাদের জন্য যুদ্ধ?
প্রতিবেশী দেশের সাথে যুদ্ধ করার সময় এদেশের সৈনিকেরা সব রকম সুযোগ সুবিধা পান, আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র পান। দেশের মানুষের কাছে সম্মান পান।
আর আমরা হতভাগ্য চিকিৎসকেরা না পাচ্ছি অস্ত্র শস্ত্র। না পাচ্ছি সরকারি সহযোগিতা। বরঞ্চ প্রতি মুহূর্তে মাথার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা। সন্দেহ হলেও কাউকে সাথে সাথে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করা যাবে না। এমনকি কারো মৃত্যু হলে মৃত্যুর কারণ ঠিক করবে আলাদা একটি কমিটি।
আর দেশের অনেক মানুষ সম্মান প্রদর্শন তো দুরের কথা, মহামারীর সাথে যুদ্ধরত স্বাস্থ্যকর্মীদের পাড়া ছাড়া করতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
তাছাড়া শত্রু কি একটা! কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ক্রসিং’এ স্কুটার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যদিও রাস্তায় আর কোনও গাড়ি নেই, তবু সিগন্যালের রঙ লাল হয়ে আছে। একটি বাচ্চা ছেলে ডাকল, ‘বাবু এক কেজি চাল কিনে দেবে? ভাত খাবো।’ এর আগে অনেক ভিক্ষুক দেখেছি। অনেকে পয়সা না চেয়ে চা খাওয়াতে বলেছে, বিস্কুট কিনে দিতে বলেছে। কিন্তু এরকম ভাবে কেউ চাল চায়নি।
মহামারীকে ঠেকানোর জন্য আমরা লক ডাউনকে অস্ত্র করেছি। কিন্তু সেই অস্ত্রের সত্যিকারের ব্যবহার আমরা আদৌ জানি তো? বহু গরীব মানুষের চোখের জলে ভেজা এই লকডাউন আমরা আদৌ কাজে লাগাচ্ছি কি?
এসময়ে দরকার ছিল সন্দেহজনক রোগীদের প্রচুর টেস্ট করা এবং পজিটিভ রোগীদের আইসোলেটেড করা। টেস্টের সংখ্যা সমস্ত ভারতবর্ষে হতাশাজনক ভাবে কম। আর সবচেয়ে কম আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই।
এমন ভাবে চললে দ্বিতীয় দফা লকডাউনের শেষে ৩ই মে তারিখে আমরা একই অবস্থায় বা আরও খারাপ অবস্থায় থাকবো। তখন কি হবে? আরও কুড়ি দিন লক ডাউন বাড়বে? সেই কুড়ি দিন পরে কি হবে? একটা মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে আমরা একটা মন্বন্তর সৃষ্টি করছি নাতো?
আসলে মহামারীতে সব শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু মন্বন্তরের আঁচ উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের উপর তেমন পড়ে না।
দুবেলাই নিম্নবিত্ত মানুষের অসহায়তা দেখছি। কিন্তু সেসব লেখার মতো কলমের জোর আমার নেই। আজ দরকার ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা শরৎচন্দ্রের মতো মরমী কলমের। একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে আমি মধ্যবিত্তদের অসহায়তার কথা বলতে পারি।
গতকাল এক স্কুলের বন্ধু ফোন করেছিল। ওর মায়ের চার্নক হাসপাতালে ডায়ালিসিস চলছিল। একজন ডায়ালিসিস রোগীর কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পরে ও তাঁর মৃত্যুর পরে রাতারাতি চার্নক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ হাসপাতালের নাম শুনলে অন্য কোনও হাসপাতাল ডায়ালিসিস করতে রাজি হচ্ছে না। কাকিমার সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস লাগে। ঐ বন্ধু পাগলের মতো এখানে ওখানে ছোটাছুটি করছে।
মাঝে মাঝেই বিভিন্ন হাসপাতাল বন্ধের খবর আসছে। আজ মেডিকেলের প্রসূতি বিভাগ বন্ধ হচ্ছে, তো কাল এন আর এসের মেডিসিন বিভাগ। দলে দলে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারাণ্টাইনে যাচ্ছেন। মহামারী প্রতিরোধে পরিকল্পনার অভাব মাঝে মাঝেই অত্যন্ত হতাশাজনক ভাবে বেআবরু হয়ে যাচ্ছে।
এসময় যাঁরা অন্যান্য মারাত্মক অসুখে ভুগছেন, তাঁরাও সমস্যায় পড়েছেন। ক্যানসার রোগীদের কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি বন্ধ। নানারকম সার্জারির ডেট পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে বহুদিন অপেক্ষা করে যাঁরা বিভিন্ন সার্জারির ডেট পেয়েছিলেন, তাঁরা অকুল পাথারে। লকডাউন ওঠার পর আবার কবে ডেট পাবেন, ভগবানও বলতে পারবেন না। যাঁরা সরকারি হাসপাতাল থেকে সুগার, প্রেশারের ওষুধ নিয়মিত খেতেন, অনেকেই যানবাহনের অভাবে হাসপাতালে যেতে পারছেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ওষুধ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এই সময়ে জাত-পাত, রাজনীতির রঙ ভুলে আমাদের সকলের দৃঢ় কণ্ঠে বলার সময় এসেছে, স্ক্রিনিং আর টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট…। একমাত্র টেস্ট ও পজিটিভ রোগীর আইসোলেশনই পারে লকডাউনের সময় সীমা কমাতে।
ভালো লাগলো।