ছোটো বেলায় রূপকথার গল্প বলতেন মা।
“তারপর অনেক রাক্ষস খোক্কস রাজপুত্রকে ঘিরে ধরল। রাজপুত্র তো ভয়ে অস্থির। কি করবে, এতো ভয়ংকর শত্রুদের সাথে লড়বে কি করে? হাতে যদিও তলোয়ার একটা আছে, কিন্তু তাতে তেমন ধার নেই। হঠাৎ মনে পড়ল, বুকের কাছে চেপে ধরা যে সোনার কৌটোটা, তার মধ্যে রয়েছে রাক্ষসদের প্রাণ ভোমরা। কৌটো খুলে যেই না রাজপুত্র ভোমরা বার করেছে, রাক্ষসদের সে কি তড়পানি। ‘তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলব। গরম তেলে ভাজব। শিগগিরি ভোমরাটাকে ছেড়ে দে।’ ভোমরার একটা ডানা ছিড়তেই তড়পানি বদলে গেল অনুনয়ে। ‘তোমাকে সাত রাজার ধন এক মানিক দেব। তোমাকে রাজকন্যা এনে বিয়ে দেব। ওটাকে ছেড়ে দাও।’ তারপর পটাং করে ভোমরার মাথা ছিড়তেই শান্তি।”
মা চিরকালের জন্য চলে যাওয়ার সাথে সাথে রূপকথারাও বিদায় নিয়েছে। প্রতিনিয়ত বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছি। এই করোনা মহামারীর সময়ে আরও বেশি করে। বুঝতে পারছি রূপকথার মতো অতো সহজে সবকিছুর সমাধান হয় না।
নেতা মন্ত্রীরা বারবার আমাদের সৈনিকদের সাথে তুলনা করছেন। যদিও সৈনিক হওয়ার দক্ষতা ও ইচ্ছা আমার ধারণা অনেক চিকিৎসকেরই নেই। মানুষ মারা তো দূরের কথা, একটা ক্ষুদ্র প্রাণীকে মারতে গেলেও অনেক চিকিৎসকের হাত কাঁপে।
তাছাড়া এ আবার কীরকম সৈনিক? ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার। এমনকি রোগীর মৃত্যু হলে তার ডেথ সার্টিফিকেট টুকুও লেখার অধিকার নেই।
ঢাল তলোয়ার ছাড়াই লড়তে গিয়ে মৃত্যু হলে আমরা নাকি শহীদের মর্যাদা পাব? তাহলে শুনবেন এক শহীদের গল্প? ডাঃ সাইমন, চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালের নিউরোসার্জেন। তিনি কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন এবং গত রবিবার সন্ধ্যেয় মারা যান। এইসব শহীদদের গান স্যালুটের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয় না। পলিথিনে মুড়ে কবর দেওয়া হয়। এমনকি তাঁর কিশোর পুত্র শেষ বারের জন্যও বাবার মুখ দেখতে পায়নি।
ডাঃ সাইমনের শেষযাত্রায় ছিলেন ডাঃ প্রদীপ, তারই এক সহকর্মী। আর ছিলেন এ্যাম্বুলেন্স চালক ও একজন পুলিশ। যে মানুষদের বাঁচাতে গিয়ে তিনি জীবন দিয়েছেন, সেই মানুষেরাই এ্যাম্বুলেন্স ঘিরে ধরেন। তাঁদের দাবী ডাক্তারবাবুকে ওখানে কবর দেওয়া যাবে না। এ্যাম্বুলেন্স চালককে বেধড়ক মারধোর করা হয়। পুলিশকর্মী ও ডাঃ প্রদীপ কোনোভাবে নিজেদের রক্ষা করেন। উত্তেজিত জনতা চলে যাওয়ার পরে ডাঃ প্রদীপ দেখেন ডাক্তারবাবুর মৃতদেহ রাস্তায় গড়াচ্ছে। তিনি ওই পুলিশকর্মীর সাহায্যে মৃতদেহকে গাড়িতে তোলেন। এ্যাম্বুলেন্স চালকের দেহ তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাঁর তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু না হলে জীবন বিপন্ন হতে পারে।
ডাঃ প্রদীপ নিজেই ড্রাইভারের আসনে বসেন। তিনি তখনও উপস্থিত বুদ্ধি হারান নি। নিজেই এম্বুলেন্স চালিয়ে চালককে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তারপর ডাক্তারবাবুর মৃতদেহ নিয়ে কবরস্থানে যান। কবর খোঁড়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কোদাল দিয়ে তিনি নিজেই কবর খুঁড়তে শুরু করেন। ঐ পুলিশ কর্মীটি সারাক্ষণ তাঁর সাথে ছিলেন। তাঁর সহায়তায় ডাঃ প্রদীপ গর্ত করে নিজের সহযোদ্ধার দেহ পুঁতে ফেলেন।
এটা শুধু দক্ষিণ ভারতের গল্প নয়। এটা ভারতের সব কটা রাজ্যের গল্প। কোথাও লকডাউনের সময়ে মাঝ রাতে শুনশান রাস্তায় সিস্টার দিদিকে বের করে দেওয়া হয়। কোথাও সাতদিন কোভিড হাসপাতালে ডিউটি করে আসা ক্লান্ত চিকিৎসককে পাড়ায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। আবার কোথাও করোনা আক্রান্ত চিকিৎসককে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচার সভা বসে।
আর সেসময় অসংখ্য তরুণ চিকিৎসককে উপযুক্ত প্রটেকশান ছাড়াই কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের শোনানো হয় এক অলৌকিক পনের মিনিটের থিয়োরি। পর পর সহকর্মীরা কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পরও বাকিরা কাজ করে যান।
এইসব মৃত্যুভয়হীন প্রত্যেক চিকিৎসকই একেক জন অগ্নীশ্বর। আর অগ্নীশ্বরদের একটাই দূর্বলতা, অসুস্থ রোগী দেখলে তাঁরা অতীতের কথা মনে রাখেন না।
তবে আমরা যারা অগ্নীশ্বর নই তাদের সব কিছু মনে থাকবে। সব কিছু। থালা বাজানো থেকে ডাঃ প্রদীপের চোখের জলে ভেজা নোটটুকুও।
সব কিছু মনে রাখব…
প্রতিটি স্বাস্থ্য কর্মীর প্রতি ফোঁটা চোখের জল…
যদি বেঁচে থাকি, ভুলব না…