বাড়িতে রোগী দেখছিলাম। হঠাৎ একজন মাঝ বয়সী মহিলা দরজা ফাঁক করে মুখ বাড়ালেন। বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমার মেয়েটাকে যদি আগে দেখে দেন। অবস্থা খুবই খারাপ।’
আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সঞ্জয়দা ভেঙে যাওয়া ওজন মাপার যন্ত্রটা ঠিক করার চেষ্টা করছিল। খ্যাঁক খ্যাঁক করে তেড়ে গেল, ‘একি, আপনি এভাবে লাইন ভেঙে দরজায় উঁকি দিচ্ছেন কেন? আপনার মাস্ক কোথায়? মাস্ক পরে আসেননি কেন? বাইরে চলুন।’
মহিলা কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘যদি একটু আগে দেখে দেন? কেমন নেতায়ে পড়েছে?’
সঞ্জয়দা বলল, ‘এখানে যে কজন আছে সকলেরই এমারজেন্সি। লক ডাউনের সময় এমারজেন্সি ছাড়া কেউ দেখাতে আসে না। আপনি আগে বাইরে চলুন।’
খানিকক্ষণ বাদে সঞ্জয়দাই এসে বলল, ‘দাদা, ওনার কেসটাই আগে দেখে দিন। আমার খুব একটা ভাল লাগছে না।’
মহিলা একটি বছর পনেরোর মেয়েকে ধরে ঘরে ঢুকলেন। বাচ্চা মেয়েটি প্রতিটি পা ফেলার সময় যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে ফেলছে। বললাম, ‘কি হয়েছে?’
‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, কটাদিন ধরে জ্বরে ভুগছিল। ভেবেছিলাম সেরে যাবে। কিন্তু অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।’
‘কতদিন জ্বর?’
‘তা মাস খানেক হবে।’
‘আশ্চর্য, মাসখানেক ধরে জ্বর। আর আপনি বাড়িতে চুপ চাপ বসে রয়েছেন?’
‘কি করব ডাক্তারবাবু? এর বাবা দিল্লীতে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। মার্চ মাস থেকে টাকা পাঠাতে পারেনি। বাড়িতে অসুস্থ শাশুড়ি আছেন। তাঁরও এখন তখন অবস্থা। তাছাড়া এর একটা ছোটো ভাইও আছে। মধ্যমগ্রাম হাসপাতালে গেছিলাম। বলল বেলেঘাটায় গিয়ে করোনার জন্য পরীক্ষা করাতে।’
বাচ্চা মেয়েটিকে ভালো করে দেখলাম। চোখের পাতা টেনে দেখলাম কাগজের মতো সাদা। শরীরে রক্ত নেই। মেয়েটির সারা শরীরে ব্যথা। বুকের মধ্যিখানে আলতো করে চাপ দিলাম। তাতেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।
মেয়েটির গলায় ও বগলে অনেকগুলি লিম্ফগ্লান্ড ফুলেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এগুলো কদিন ধরে দেখছেন?’
মহিলা উত্তর দিলেন, ‘তাও সপ্তাহ দুয়েক হবে। মাঝে মধ্যে ওর মাড়ি দিয়েও রক্তও পড়ছে।’
বললাম, ‘রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। আর্জেন্ট।’
‘ডাক্তারবাবু, খুব খরচ হবে কি?’
এবার মাথা গরম হল। বললাম, ‘দেখুন, আপনার মেয়ে যখন তখন কিছু দায়িত্ব তো আপনাকে নিতেই হবে। ওর যা অবস্থা, পরীক্ষা অনেক করা উচিৎ। আপাতত এটুকুই করুন। দেড়শ টাকার মধ্যে হয়ে যাবে।’
পরেরদিন ওই ভদ্রমহিলা রিপোর্ট নিয়ে এলেন। হিমোগ্লোবিন ৪.৫ গ্রাম/ডেসিলি। টোটাল কাউন্ট অনেক বেশি। ব্লাস্ট সেলে ভর্তি। রক্তে প্লেটিলেটও খুব কম। রিপোর্ট দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হচ্ছিল।
মহিলা আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন। রিপোর্ট থেকে চোখ সরাতেই বললেন, ‘কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?’
বললাম, ‘রিপোর্ট ভালো নয়। আমার করার কিছু নেই? ইমিডিয়েট বড় জায়গায় দেখাতে হবে।’
‘আমি একা মেয়ে মানুষ। কোথায় নিয়ে যাব? আপনি একবার চেষ্টা করে দেখেন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আমার চেষ্টার বাইরে চলে গেছে। ওর সম্ভবত লিউকেমিয়া হয়েছে। লিউকেমিয়া বোঝেন? ব্লাড ক্যানসার।’
বলামাত্রই মহিলাটি ঝপ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সঞ্জয়দা এবং একজন মহিলা রোগিণীর সাহায্যে ওনাকে শোয়ালাম। পা উপরে করে কিছুক্ষণ ধরে থাকতেই জ্ঞান ফিরে এল। ভালো করে কাউন্সিলিং করলাম। বললাম, ‘এই ধরণের লিউকেমিয়ার চিকিৎসা আছে। এনআরএস হাসপাতালের হেমাটোলজি ডিপার্টমেন্ট খুব ভালো। ওখানে নিয়ে গেলে আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।’
কিছুটা হয়ত বাড়তি আশ্বাসই দিলাম। মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সবই আমার কপাল ডাক্তারবাবু। ওদের বাবা দিল্লীতে আটকে আছে। জানিনা ওখানে কি খাচ্ছে, কোথায় থাকছে। ও মেয়েটাকে খুব ভালবাসত। হাতে টাকা পয়সা নেই। আমি যে কি করব?’
এই লকডাউনের সময় এরকম বিলাপ এত শুনছি, যে আলাদা ভাবে আর মনে রেখাপাত করে না। আমার সুক্ষ অনুভূতি অনেকদিন ধরেই ভোঁতা হতে শুরু করেছে। সংবেদনশীল কারো পক্ষে এসময় নিয়মিত রোগী দেখা অসম্ভব। সারাদিন মানুষের অসহায়তা নিজের চোখে দেখার পর কোনো রাত্রেই সে ঘুমাতে পারবে না। চারিদিকে বর্ম পরে থাকা স্বত্বেও আমার ভেতরটা একটু কেঁপে গেল। কি করব? আমিও যে দুটো ছোটো মেয়ের বাবা।
পরের দিন মহিলা আবার এসে হাজির। একটা ব্যবস্থা হয়েছে। ওনার স্বামীর এক বন্ধুর অটো আছে। তিনি ওনাকে মেয়ে সহ এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। আমাকে প্রেসক্রিপশন প্যাডে লিখে দিতে হবে, মেয়েটিকে এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরী দরকার। রাস্তায় পুলিশে আটকালে কাজে লাগবে।
মহিলা বললেন, ‘আরেকটা উপকার করবেন ডাক্তারবাবু? ওর বাবা মেয়ের শরীর খারাপ শুনে পাগলামো করছে। বলছে যে করেই হোক বাড়ি আসবে। দরকার হলে দিল্লী থেকে হেঁটে ফিরবে। আমার কোনও কথা শুনতে চাইছে না। আপনি ওর সাথে একবার কথা বলবেন? আপনি ভয়ের কিছু নেই বললে ও বিশ্বাস করবে।’
মহিলা স্বামীকে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দিলেন। ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ‘আমার মেয়ের কি হয়েছে ডাক্তারবাবু? ওকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে কেন?’
অকম্পিত স্বরে বললাম, ‘চিন্তা করার কিছু নেই। সাধারণ নিউমোনিয়া হয়েছে। কয়েকদিনেই সুস্থ হয়ে যাবে।’
মহিলা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এত শান্ত ভাবে ভয়ঙ্কর মিথ্যে বলতে সম্ভবত তিনি আগে শোনেননি। ফোনটা ফেরত দিলাম।
চিকিৎসকরা প্রচুর মিথ্যে বলতে পারেন। সম্ভবত নেতা, মন্ত্রীদের চেয়েও বেশি। আমি জানি না, ঐ মেয়েটির বাবা বাড়ি ফিরে নিজের মেয়েকে আর দেখতে পাবেন কিনা? না পেলে আমাকেই সবচেয়ে বেশি অভিশাপ দেবেন। তবু আমরা হামেশাই মিথ্যে কথা বলি। লিভার ক্যান্সারের রোগিকে বলি, ‘কিচ্ছু হয়নি আপনার। লিভারে সামান্য সমস্যা।’ ডায়ালেটেড কার্ডিও মায়োপ্যাথির রোগীকে বলি, ‘কোনও চিন্তা করবেন না। শুধু একটু সাবধানে থাকবেন। ওষুধ পত্র ঠিক ঠাক চালাবেন। সুস্থ হয়ে যাবেন।’ এবং শেষ পর্যন্ত মিথ্যাটা মিথ্যাই থেকে যায়। বারবার বিপদে পরি। কিন্তু এছাড়া কিই বা করার আছে আমাদের।
ভালোর জন্য মিথ্যা খারাপ সত্যির চেয়ে কিছু সময় প্রয়োজন ।
আপনার লেখা পড়ে শুধু দু্খ পাই।