থ্রেট সিন্ডিকেটের পাঁচালি যখন শুরু করেছিলাম তখন মাথায় একটা বিশেষ বিষয় ছিলো। এই থ্রেট সিন্ডিকেট কিভাবে একজন ডাক্তারের মানসিক ভূমিতে প্রভাব বিস্তার করে তার খতিয়ান লেখা। গতকাল আমাদের সন্তানসম দীপ্রকে আমরা হারিয়েছি। আপাতভাবে আত্মহত্যা। পুলিশি তদন্তে হয়তো তাই বেরুবে। হয়তো ওর পারিবারিক সমস্যা ছিলো। পুরোনো ক্ষত ছিলো। হয়তো অনেক কিছুই ছিলো। এই অনেক কিছুর সঙ্গে থ্রেট সিন্ডিকেটের উপস্থিতিও ছিলো। যতদূর খবরে প্রকাশ ও এমবিবিএস পড়েছিলো বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজ থেকে। এমডি করেছিলো আর জি কর মেডিকেল কলেজ থেকে। এমন একটি সময়ে যখন সন্দীপ বাহিনী ওখানে রাজত্ব করছে। আর জি করে থ্রেট সিন্ডিকেটের অত্যাচার যেমন সকল জুনিয়র ডাক্তারের ওপর হয়েছিলো, দীপ্রর ওপরেও হয়েছিলো। আর এটা কে না জানে যে মানসিক ক্ষত মনের গভীরে বহুকাল থেকে যায়। এখন ঝাড়গ্রামে থাকলেও আর জি করের অত্যাচার বহন করেই ও ঝাড়গ্রাম গিয়েছিলো। আমার ব্যাখ্যায় ওর আত্মহত্যার জমি তৈরি করেছে আর জি কর, বর্তমানের কোনো ঘটনা শুধুমাত্র ট্রিগারের কাজ করেছে। তিলোত্তমা যদি থ্রেট সিন্ডিকেটের শিকার হয়, তাহলে দীপ্র প্রথম প্রতিবাদী শহীদ। নিজের জীবন শেষ করে দিয়ে থ্রেট সিন্ডিকেটকে শেষ করার চরম বার্তা ও দিয়ে গেছে। আমরা যারা আন্দোলনে রয়েছি তারা এটা বুঝতে না পারলে সেটা হবে ওর আত্ম বলিদানের প্রতি চরম অবমাননা।
ঘটনার গতিপ্রকৃতি যেদিকে যাচ্ছে, এক দুদিনের মধ্যে সবাই একমত হয়ে যাবো যে, ও ডিপ্রেশন এর পেসেন্ট ছিলো, তাই আত্মহত্যা।
আত্মহত্যার মেডিকেল মডেলের ব্যাখ্যা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। সে ব্যাখ্যা শোনানোর বিস্তর লোকজন আছে। ওটা তারাই করুক। আমি একেবারে অন্য পথে হাঁটবো। কিছু স্টুডেন্ট আর জুনিয়র ডাক্তারকে আত্মহত্যার দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনার অভিজ্ঞতা আর নিজের চূড়ান্ত ডিপ্রেশন নিয়ে বেঁচে যাবার অভিজ্ঞতার নিরিখেই আজকের প্রতিবেদন পেশ করবো। এই সুন্দর পৃথিবী আর নিজের চূড়ান্ত সাফল্য থাকা সত্যেও গতকাল সকালে দীপ্রর কেনো মনে হলো যে এই জীবনে বেঁচে থাকা অর্থহীন, আত্মহত্যাই একমাত্র উপযুক্ত কাজ, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। এর উত্তর কেউ দেবেনা সেটা জানি। যেটা সবাই করবে সেটা হলো কিছু শব্দ আর বাক্য উপহার দেবে। যেগুলো নিজেদের আত্মপ্রবঞ্চনা করা ছাড়া অন্য কিছু কাজে লাগবে না।
এই আত্মপ্রবঞ্চনার খেলায় থাকতে চাইনা বলেই আজকে লিখতে হচ্ছে।
আত্মপ্রবঞ্চনার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো কনসেপ্ট তৈরি করা। এখন সামনেই শীতকাল। শীতকাল একটি কনসেপ্ট।আমরা সবাই প্রত্যয়ী যে আমরা ঋতু পরিবর্তন বিষয়টা জানি। যদি ডিসেম্বর মাসে আপনাকে জিজ্ঞেস করি, এখন এতো ঠান্ডা কেনো? আপনি এটাই উত্তর দেবেন, আরে এটা শীতকাল তো তাই। এর পরেই যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, শীতকাল কাকে বলে ? আপনি উত্তর দেবেন, বছরের যে সময়টায় খুব ঠাণ্ডা পড়ে সেটাকেই শীতকাল বলে।
এবার একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবুন। আপনার এই দুই উত্তরের মধ্যে দিয়ে কি শীতকালে কেনো ঠান্ডা পড়ে তার আদৌ কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো?
এর পরিষ্কার উত্তর “না”।
এই আলাপচারিতায় আমরা আদৌ উত্তর পেলাম না, শুধু উত্তর না পাওয়ার উৎকণ্ঠা আমরা এড়িয়ে গেলাম কনসেপ্ট এর খেলায়। কনসেপ্ট দিয়ে নিজের আত্মপ্রবঞ্চনা করে মনের উৎকণ্ঠা চেপে রাখলাম।
শীতকাল যেরকম একটি কনসেপ্ট, ডিপ্রেশন ঠিক এরকমই একটি কনসেপ্ট। ডিপ্রেশন নামক কনসেপ্ট একটি মানসিক অবস্থাকে সূচিত করে। যার বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা একটি উপাদান মাত্র। শীতকাল কনসেপ্ট এর সঙ্গে ঠান্ডা পড়ার যা সম্পর্ক, ডিপ্রেশন এর সঙ্গে আত্মহত্যার সেই সম্পর্ক।
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করি দীপ্র ডিপ্রেশন এ ছিলো কীকরে বুঝলেন? আপনি একটি লম্বা ফিরিস্তি দেবেন। তার মধ্যে অতি অবশ্যই বলবেন আত্মহত্যার কথা। এর পরেই যদি জিজ্ঞেস করি দীপ্র কেনো আত্মহত্যা করলো? আপনি উত্তর দেবেন ও ডিপ্রেশনে ভুগছিলো। আসলে আপনার কাছে উত্তর নেই। সঠিক উত্তর নেই। এই উত্তর না পাবার উৎকণ্ঠাকে চাপা দেবার জন্য একটি কম্বল তৈরি করেছেন। সেই কম্বলের নাম ডিপ্রেশন নামক কনসেপ্ট।
আমার ছাত্র জীবনে যতো আত্মহত্যা দেখেছি সবগুলোকেই আমরা ডিপ্রেশন নামক কম্বল চাপা দিয়েছি। আর এই কম্বল চাপা দেবার আত্মপ্রবঞ্চনা আমাদের অন্ধ করে রেখেছে প্রতিটা আত্মহত্যার সঠিক কারণ অনুসন্ধানে।
আমরা অন্তত কয়েকশ ডাক্তার এখনো সঠিক জানতে পারিনি হেমন্ত মন্ডল, পার্থ গাঙ্গুলি, বিজয় ভট্টাচার্য, শুভ্র পাল আর ইন্দ্রানী কেনো আত্মহত্যা করেছিলো।
মৃত্যুর আগে দুটি মেসেজ দীপ্র পাঠিয়েছে। একটি স্ত্রীকে অন্যটি সতীর্থ এবং বন্ধু বান্ধবদের গ্রুপে। দুটিতেই কমন ফ্যাক্টর আর জি করের পরিবেশ। এটিকে অস্বীকার করার জায়গা নেই। যেকোনো ক্রাইম দুটি প্রান্তিক অবস্থানের মধ্যে বিরাজ করে। একটি প্রান্ত যদি ওমিশন হয় তাহলে ওপর প্রান্ত কমিশন। একটু বিস্তারিত বিষয়টা বুঝে নেয়া যাক। ধরুন আপনার কাছে ৫০০ টাকা আছে। আমি গায়ের জোরে টাকাটা কেড়ে নিলাম। এটা হলো কমিশন। আবার ধরুন আপনার কলেজের থেকে ৫০০ টাকা পাওয়ার কথা। সেটা পেতে গেলে কলেজ কর্তৃপক্ষকে কিছু কাজ করতে হবে। যেটা তার করার কথা। কিন্তু তারা সেটা করলো না। আপনি আপনার প্রাপ্য পেলেন না।এটাই হলো ওমিশন। থ্রেট সিন্ডিকেটের কাজকর্ম যদি একটি হিমশৈল হয় তাহলে তার শীর্ষ হলো কমিশন ভাগ আর ডুবে থাকা বিরাট অংশ হলো ওমিসন ভাগ। কমিশন ভাগের ফল যদি তিলোত্তমার খুন ধর্ষণ হয় তাহলে ওমিসন ভাগের ফল হলো দীপ্রর আত্মহত্যা। বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েও আমি এই দাবি করতে রাজি আছি।
মানুষের অস্তিত্ব তার এনাটমি ফিজিওলজি বায়োকেমিস্ট্রি দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের অস্তিত্ব তার সমগ্র বস্তুসত্তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। মানুষের মাপ তার দেহ নয়, তার স্বপ্নের সঙ্গে সমান।
থ্রেট সিন্ডিকেট আদতে এই স্বপ্ন দেখার ওপর কারফিউ জারি করে। তুমি সন্দীপ ঘোষের কলেজে এসেছো। এখানে তোমার দেহটিকে বাঁচিয়ে রাখাই সৌভাগ্য মনে করো। বাকি স্বপ্ন জলাঞ্জলি দাও। নাহলে তোমার দেহ সুরক্ষিত থাকবে না। প্রাণ তো দেহই ধারণ করে। ফলে প্রাণ যাবে।
মানুষ শুধু তার বর্তমান নয়, তার সঙ্গে অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন জুড়েই মানুষের পুরো অস্তিত্ব। প্রতিটি মানুষ দার্শনিক। নিজের জীবনের একটি দর্শন থাকে। একটি বিশ্ববিক্ষা থাকে। নিজে কেমন হতে চায় আর চারপাশ মানুষজন এসব কেমন হওয়া উচিত তার একটি পরিষ্কার ধারণা প্রত্যেকের আছে। এই ধারণা আর বাস্তবের মধ্যে অমিল সামান্য হলে মানুষ ভারসাম্য রেখে চলতে পারে। ফারাক আসমান জমিন হলে মানুষ বিদ্রোহ করে, অথবা আত্মহত্যা করে। এই ফারাকই অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে।
আরেকটা উদাহরণ দিতে পারি। একটি স্টুডেন্ট যখন মেডিকেল কলেজে ঢোকে তখন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে তার নিজের মান মর্যাদা কি হবে, অন্যেরা তার সঙ্গে কি ব্যবহার করবে তার একটা ধারণা থাকে। সেই মেয়েটিকেই যখন অভিক বাহিনীকে মদ পরিবেশন করতে হয়, আইটেম গানের সঙ্গে নাচতে হয় লুম্পেনগুলোর মনোরঞ্জনের জন্য, তখন অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়। যার শেষ পরিণতি আত্মহত্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
অন্যদিকে শিক্ষককুলের কিরকম মর্যাদাবান হওয়া উচিত তারও একটা ধারণা এই নিষ্পাপ তরুণ তরুণীদের থাকে। বাস্তবে যখন দেখা যায় তারাও অভিক সন্দীপ বাহিনীর পদলেহন করছে তখন একটা তীব্র ঘৃণা হাজির হয়। হয় বিদ্রোহ করে এগুলো পাল্টাতে চায়, না পারলে নিজেকে শেষ করে দেয়। সহাবস্থান করতে পারে না। পারা সম্ভব নয়। যতদিন না থ্রেট সিন্ডিকেট নির্মূল হচ্ছে, ক্যাম্পাসে মানুষের মর্যাদা স্বাধীনতা ফিরে আসছে, ততদিন দীপ্ররা হারিয়ে যাবে। হারাতেই থাকবে।
মানুষের এই স্বাভাবিক মানব ধর্মকে সাইকিয়াট্রি চিরকাল রোগ বলে দাগিয়ে এসেছে। মানসিক রোগ বলে দিলে যত দোষ মানুষটির হয়ে যায়। রোগগ্রস্ত সমাজ, থ্রেট কালচার ক্লিনচিট পেয়ে যায়। এবারে চলুন সাইকিয়াট্রির ইতিহাসে একটু চোখ বোলাই। কমিউনিস্ট রাশিয়া ভাবতো তাদের সমাজ আর রাষ্ট্র ব্যবস্থা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। কোনো সুস্থ মানুষ এর বিরোধিতা করতে পারে না। যারা বিরোধিতা করবে তারা আদতে মানসিক রোগী। সাইকিয়াট্রিও যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলো। যারা রাষ্ট্র বিরোধিতা করতো তাদের সেটা রোগ বলে দাগিয়ে দিয়েছিলো। নাম দিয়েছিল “স্লো সিজোফ্রেনিয়া।”
সমস্ত বিপ্লবীকে এই ডায়াগনসিস করে বাকি জীবনের জন্য পাগলা গারদে পাঠিয়ে দিতো।
নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ঘেরা থাকতো বিদ্যুৎবাহি কাঁটাতার দিয়ে। যাতে বন্দীরা পালাতে না পারে। অমানুষিক অত্যাচারে কিছু বন্দী হঠাৎ ওই বিদ্যুৎবাহী কাঁটাতারে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতো। সাইকিয়াট্রি এটাকেও একটা রোগ বলে দিতো। এটাকেও একটি মানসিক অসুখ বলে দাগিয়ে দিয়েছিলো। নাম দিয়েছিলো বার্বড ওয়ার সিন্ড্রোম( Barbed wire syndrome)।
কালো চামড়ার যে ক্রীতদাস পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতো তাদেরও মানসিক রোগী বলা হতো। এই পরাধীনতা অস্বীকার করে মুক্ত জীবনে চলে যাওয়ার যে ইচ্ছা তার নাম ছিলো ড্রেপ্টোম্যানিয়া(Dreptomania)।
কয়েক দশক আগে আমেরিকান সাইকিয়াট্রি অ্যাসোসিয়েশন সমকামিতাকে রোগ বলে দাগিয়ে DSM এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে নয়, মানুষের গণআন্দোলনের চাপে পড়ে সেটিকে সংশোধন করে।
এবারে বুঝুন সাইকিয়াট্রির হাতে পড়ে নেহাত মানবিক গুণও ইতিহাসে কেমন রোগ বলে পরিগণিত হয়েছিল। এই সবগুলোকে রোগ বলে দাগিয়ে দেবার একটা গভীর রাজনীতি আছে। অমানবিক সমাজ ব্যবস্থাকে ক্লিনচিট দিয়ে সেই সময়কার বিভিন্ন ফর্মের থ্রেট সিন্ডিকেট কে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা।
আর জি করে থ্রেট কালচারের শিকার হয়ে দীপ্র মানসিকভাবে ভেঙেচুরে থাকলো। যাদের ওপর ভরসা করার কথা ভেবেছিল সেই শিক্ষক সমাজ সন্দীপ ঘোষের পদলেহন করলো। এই পচা পরিবেশে যদি দীপ্র না বাঁচতে চেয়ে আত্মহত্যা করে তাহলে দয়া করে কেউ তার সাইকিয়াট্রিক ডায়াগনসিস করতে বসবেন না। থ্রেট সিন্ডিকেট যদি বজায় থাকে তাহলে আরো তিলোত্তমা হবে। তার চেয়ে অনেক বেশি দীপ্ররা আত্মহত্যা করবে। ওদের ব্রেনে সেরোটোনিন ডোপামিন পরিমাপ করার আগে খুঁজতে বসুন কারা মানুষের স্বাধীনতা মর্যাদা আর জাস্টিস চুরি করে।
Abnormal response in an abnormal situation is a normal phenomenon.
পচাগলা দুর্নীতিতে ভরা সমাজ আর প্রশাসন যেখানে আছে, পদলেহন যেখানে উন্নতির সোপান, সেখানে তিলোত্তমার খুন আর দীপ্রদের আত্মহত্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
ডাঃ বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়