আর জি কর হাসপাতালে অভয়া তিলোত্তমার নির্মম ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর কেটে গেছে তিন মাস। রাজ্য পুলিশের হাত থেকে আদালতের নির্দেশে তদন্তের ভার এখন সিবিআই-এর হাতে। গত তিন মাস ধরে সারা রাজ্যের ও দেশের মানুষ দল ও মত নির্বিশেষে বারবার ধিক্কার জানিয়েছেন এই ঘটনাকে। অপরাধীদের এবং তাকে/ তাদেরকে আড়াল করতে চাইছে যারা তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অভূতপূর্ব আবেগে নেমে এসেছে রাস্তায়। নানা প্রলোভন, মিথ্যা প্রচার, কটূক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, আক্রমণ, গ্রেফতার—কোনও কিছুতেই জনতার এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ধিক্কারকে বশে আনতে পারেনি শাসক কিংবা প্রশাসন। এই সময়কালে সাধারণ মানুষের মনে যে সব প্রশ্ন দানা বেঁধেছে, যেসব প্রশ্নের কোন সঙ্গত উত্তর এখনও নেই, যেসব প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে শাসকপক্ষ, দায় এড়াতে চাইছে বারবার—সেইসব প্রশ্নই এখানে আমরা তুলে ধরতে চাই। জানাতে চাই, কেবল হত্যাকারী কিংবা ধর্ষককে চিহ্নিত করলেই কাজ ফুরোবে না। বৃহত্তর দায় নিতেই হবে কাউকে না কাউকে।
আর জি কর হাসপাতাল, সন্দীপ ঘোষ এবং ক্ষমতার দৌড়
একের পর এক অভিযোগ-তথ্য-প্রমাণে বোঝা যাচ্ছে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। আর জি কর হাসপাতাল পরিচালনা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রের নানা বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সেই সব দুর্নীতির অভিযোগপত্রগুলি উদ্ধার হয়েছে তাঁরই বাড়ি থেকে। অর্থের বিনিময়ে ছাত্রদের পরীক্ষার ফল পাল্টে দেওয়া, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্তরের পরীক্ষা কিংবা কেরিয়ারের নানা বিষয়ে লাগাতার হুমকি দিয়ে নিজেদের অনুগত বানানোর চক্রে প্রত্যক্ষ মদতদাতা তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে এতদিন কোনও পদক্ষেপ হয়নি কেন? এক জেলা হাসপাতালে নিম্নপদে শাস্তিমূলক বদলি করার সাত দিনের মধ্যেই সর্বোচ্চ প্রশাসকের নির্দেশে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় কোলকাতায়। এত অভিযোগ, এত অপরাধের পরেও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে নিজের পদে রেখে দেওয়ার জন্য সওয়াল করেন প্রকাশ্যে। এমনকি অভয়া হত্যার পর তিনি পদত্যাগ করলেও কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অন্য এক হাসপাতালের অধ্যক্ষকে অপসারণ করে তাঁকে আবার অধ্যক্ষ করে দেওয়া হয়। এর দায় কার? স্বাস্থ্য দফতরের? স্বাস্থ্য সচিবের? মন্ত্রীর?
তাঁর এক ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সরাসরি জানান মুখ্যমন্ত্রী “দিদি”-ই তাদের নিয়োগকর্তা। এসব কথার ভিডিও ফুটেজও আছে। অধ্যক্ষের দেহরক্ষী দিদির কাছ থেকে আসে কেন? সন্দীপ ঘোষের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ব্যক্তিগত ভাবে পাঠান নাকি মুখ্যমন্ত্রী? কেন?
সঞ্জয় রায় এবং তার পিছনের ছায়া
সরকারি একটি হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় একজন ডাক্তার খুন হয়ে গেলেন, ধর্ষিত হলেন–সরকারেই পুলিশ দফতরের এক কর্মীর দ্বারা। অস্থায়ী কর্মী হলেও তিনি পুলিশ কমিশনারের নামে নথিভুক্ত বাইক ব্যবহার করেন, খুন-ধর্ষণের পরে রাত্রিবাস করেন পুলিশেরই ব্যারাকে। কোনও এক রহস্যময় কারণে হাসপাতালের যে কোনও ফ্লোরে যখন খুশি যেতে পারেন তিনি। যে দফতরের কর্মী খুন হলেন আর যে দফতরের কর্মী খুন করলেন বলে অভিযোগ–দুটিই এক সরকারের অধীনে, একই মন্ত্রীর দায়িত্বে। এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য দফতরের কোনও গাফিলতি, অব্যবস্থা, দায়িত্বহীনতা আছে নাকি নেই? তাদের দফতরের কর্মীর হাল হকিকত, আচরণ ও কার্যকলাপ দফতরের কাজের সঙ্গে সংগতি সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা নজর রাখার দায়িত্ব কার? রোগীর পরিবারের? ট্রাফিক পুলিশের? অভিনেতার? শিক্ষকের? কার? ডিউটিরত ডাক্তারের এই পরিণতি কি কেবলই একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার? যে পুলিশ দফতরের উপর মানুষ তার নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে ভরসা করে বসে থাকে, সেই দফতরের অস্থায়ী কর্মীই যদি অবলীলায় খুন করে যায় ঘরের ভেতর ঢুকে, তাহলে দুটি প্রশ্ন ওঠে।
এক। ঘর সামলানোর, ঘরের ভিতরের মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার ছিল?
দুই। নিজের কর্মীকে নিয়ন্ত্রণের দায় ও দায়িত্ব কার? পুলিশ ব্যারাক থেকে এসে অভয়াকে ধর্ষণ ও হত্যা করে যে সিভিক-পুলিশ পুলিশেরই ব্যারাকে গিয়ে আশ্রয় নেয়—সেইটেই তার নিরাপদ স্থান মনে হল?
আদালত ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন সিভিক পুলিশের নিয়োগ-পদ্ধতি নিয়ে। আমরাও তো জানতে চাই, কীভাবে এই নিয়োগ হয়, কারা সরাসরি পুলিশের দফতরে লোক নিয়োগ করে আমাদের নিরাপত্তার এমন সর্বনাশ করছে? কারা তারা?
ধৃত সঞ্জয় রায় পুলিশ দফতরের অধীনস্থ একজন কর্মী (অস্থায়ী)। কর্মরত চিকিৎসক হত্যা ও ধর্ষণে তিনিই প্রধান অভিযুক্ত। নানা তথ্য এবং পরোক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে এই কাণ্ডে তাঁর সক্রিয়তা চিহ্নিত হয়েছে। তিনি এখন আবার বলছেন, সরকার এবং তাঁর ডিপার্টমেন্ট তাঁকে ফাঁসিয়েছে। তাঁকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন ডিপার্টমেণ্টেরই কেউ বা কারা। সেই তাঁদের নাম কী? পুলিশই কি তাঁকে চুপ থাকতে বলেছিল ধরার সময়? পুলিশই কি রটিয়েছিল সব অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে সঞ্জয়? সঞ্জয়ের পিছনে কত বড়ো মাথা আছে তাহলে? এই কারণেই কি তাঁকে ধরার পরেই “এনকাউন্টারের” কথা বলা হয়েছিল? তাঁর কোনও বয়ান সিবিআই কি নেয়ই নি?
এসবের কোনও জবাব পাওয়া যাবে না? কেউ বলবে না, এইটে আমাদের ব্যর্থতা? নাকি বলা হবে, আঠাশ কিংবা বেয়াল্লিশ কিংবা সাতান্ন বছর আগে এইরকম হয়েছিল? তাই এখনও মাপ করে দিতে হবে শত শত খুন? নির্লজ্জভাবে বলা হবে, অন্য রাজ্যেও তো এমন হচ্ছে আকছার? তাই এই ঘটনায় জল ঘোলা করার মানে নেই? ঠিক কতটা অবোধ সারল্য কিংবা নিদারুণ শয়তানি থাকলে এইটে না বোঝার ভান করা যায় যে, অন্য যে-কোনও ধর্ষণ বা খুনের সঙ্গে এ ঘটনার তুলনা চলে না? স্বাধীনতার আগে বা পরে কোনও কালে কি নিজেরই হাসপাতালে ডিউটিরত ডাক্তার পুলিশ দফতরের এক কর্মীর (অস্থায়ী) দ্বারা ধর্ষিত এবং নিহত হয়েছেন? এমন ভাবে কি আগে কখনও হাসপাতালের প্রধান থেকে শুরু করে অপ্রধান ব্যক্তিরা, এমনকি পুলিশের একাংশও হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ বিষয়ে উদাসীন থেকেছেন? প্রমাণ সরিয়ে ফেলার অপরাধেও কি এভাবে আগে পুলিশ দফতর অভিযুক্ত হয়েছে কখনও?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পোস্টমর্টেম এবং পুলিশের তদন্ত
ঘটনার পরে হাসপাতালের তরফে কোনও এফ আই আর হয়নি। কেন? দায় কার? অধ্যক্ষের? সন্ধ্যার পর পোস্টমর্টেমের নিয়ম নেই। কোনও অনুমতি না নিয়েই সেদিন পোস্টমর্টেম করা হল কেন? কার সিদ্ধান্তে? যে হাসপাতালে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেখানেই কেন পোস্টমর্টেম? সমস্ত আইন, রীতি লঙ্ঘন করে অন্য হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরকে পোস্টমর্টেমের কাজে নিয়োগ করা হল কীভাবে? অন্য কলেজের অধ্যক্ষের নির্দেশ মেনে তিনিই বা কীভাবে এলেন? “জুনিয়র ডাক্তাররা তো ছিল সামনে, তারা তো পোস্টমর্টেমের পরে সই করেছে”–এসব ছেঁদো কথায় চলবে না। জুনিয়র ডাক্তাররা দেখেছেন তাঁদের ন্যায্য দাবি মতো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিনা, সব পদ্ধতি মেনে অটোপ্সি হচ্ছে কিনা, রিপোর্টে তাঁদের সই নেই, শুধু প্রক্রিয়াটি তাঁদের দাবি মেনে জুডিশিয়াল ম্যাজস্ট্রেটের সামনে হয়েছে বলে তাঁরা সন্তোষ জানিয়েছেন। পোস্টমর্টেমের সময় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকার বিষয়ে অভয়ার বন্ধুদের “দাবি” জানাতে হয়েছিল, তাহলে কি ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতেই পোস্টমর্টেমের বন্দোবস্ত হচ্ছিল? অত দ্রুততায় মৃতদেহ দাহ করার জন্য চাপ দিল কারা? কার কথায় তক্ষুনি ময়নাতদন্তের জন্য চাপ দেওয়া হল? একজন ডাক্তারবাবু ময়না তদন্তে আপত্তি করায় যে রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন, এখুনি না হলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, তিনি কে? কে তাঁকে পাঠিয়েছিল? বাবা-মা এবং পরিবারের লোকেদের আপত্তি কেন গ্রাহ্য হল না? মৃত্যুর পরেপরেই স্বয়ং পুলিশের বড়কর্তা অভয়ার বাবা-মায়ের হাতে টাকার বাণ্ডিল ধরিয়ে দিতে চাইলেন? কত নির্মম এবং অমানবিক হলে এমন কাজ করা যায়?
ক্রাইম সিনের লাগোয়া ঘরের দেয়াল ভাঙচুর হল রাতারাতি। হত্যার পরদিনই ভাঙার কাজ শুরু হয় কীভাবে? কর্তৃপক্ষের সাফাই, জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছিল। জুনিয়র ডাক্তারদের কথা শুনে কর্তৃপক্ষ তখনই শুরু করে দিল দেয়াল ভাঙার কাজ? এমনকি রাতের বেলায়? তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের স্বাক্ষরিত অর্ডারে বলা লেখা আছে, স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব ও তদানীন্তন মেডিক্যাল শিক্ষা অধিকর্তার উপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে এই অভূতপূর্ব আকুল তৎপরতার সময় কারো মনেই পড়ল না ওটা ক্রাইম সিন সংলগ্ন স্থান? নাকি খুব বেশি করে মনে পড়েছিল বলেই এই ক্ষিপ্রতা এসেছিল কাজে? তাছাড়া হাসপাতালের এই সরল শিশুসুলভ কাজে পুলিশও কোনও বাধা দিল না? কেন তারা ক্রাইম সিনের চারপাশের এলাকা যথাবিধি ঘিরে রাখল না? এ কি ছেলেখেলা? নাকি ইচ্ছাকৃত গাফিলতি? এফ আই আর করতে যাদের অত গাফিলতি, বাড়ির লোককে খবর দিতে অত টালবাহানা, তাদের ডাকে কীভাবে অত সকালেই উত্তরবঙ্গের কিংবা বর্ধমানের শাসক-অনুরাগী ডাক্তারবাবুরা এবং শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের কেষ্টবিষ্টুরা এসে হাজির হলেন? কোন নিশিডাকে?
সিবিআই তদন্ত ও তার ফাঁক ফোকর
কেন সিবিআই এর চার্জশিটে এসব কথার ছিটেফোঁটাও নেই? দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেমের জন্য পরিবারের অনুরোধ বিষয়ে একটি বাক্যও লেখা গেল না? সিবিআইকেও রক্তগঙ্গার কথা কেউ বলেছেন নাকি?
পোস্টমর্টেম নিয়ম মোতাবেক হয়েছে, এফ আই আর নিয়ম মেনে হয়েছে, শেষকৃত্য নিয়ম মেনে হয়েছে, পুলিশের তদন্ত নিয়ম মেনে হয়েছে। হত্যাটিও কি নিয়ম মেনেই হয়েছিল? সিবিআই কি জানাবেন? দায়িত্ব নেবার পর দুমাস কেটে গেছে। খুব উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি কেন এখনও নেই? বাধা দিচ্ছে কেউ? বোঝাপড়া চলছে কোনোখানে?
সিবিআই তাঁদের চার্জশিটে লিখেছেন (পৃ ১৭) নিহত ডাক্তারের মোবাইল এবং ল্যাপটপ তাঁরা সিজ্ করেছেন। অথচ চার্জশিটের শেষে অ্যানেক্সচার সি-তে যে তালিকা দিয়েছেন সংগৃহীত আর্টিকেলের, তাতে এদুটির উল্লেখমাত্র নেই। কেন? ও দুটি কি হাওয়ায় ভ্যানিশ? মোবাইলে ও ল্যাপটপে অভয়ার হাতের ছাপ ছিল? অন্য কারো হাতের ছাপ কি ছিল? খবরে প্রকাশ, কোথাওই কারো হাতের ছাপ ছিল না। চার্জশিটে এত তথ্য প্রমাণের ভিড়ে অভয়ার মোবাইল এবং তাতে হাতের ছাপ কি হারিয়ে গেল? সুবিধাজনক ভাবে? আদালতের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও জানতে চান সিবিআই চার্জশিটের এমন অনেক অস্বচ্ছতা এবং রহস্যময় নীরবতার মানে। তা না হলে জনতা দেশের “সর্বশ্রেষ্ঠ” তদন্ত সংস্থার উপর ভরসা রাখবে কী করে? জনতার কাছে আপনারাও অস্বচ্ছতার অভিযোগে অভিযুক্ত।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, হেলথ-মাফিয়া, দুর্নীতির সিণ্ডিকেট
কেন এমন হল হাসপাতালের, হাসপাতালগুলির অবস্থা? একের পর এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে এখন নানা অভিযোগ আসছে, এই মর্মান্তিক ঘটনার পরে বাধ্য হয়ে মুখ খুলছেন মেডিক্যাল শিক্ষকেরা–জানাচ্ছেন কীভাবে ভয় দেখিয়ে তাঁদের বাধ্য করা হয়েছে নম্বর বাড়িয়ে দিতে, পাশ করাতে, অনার্স পাইয়ে দিতে। কীভাবে চলেছে হুমকি-রাজ? এসবের জবাব দেবে কে? স্বাস্থ্য সচিব, উপাচার্য, আধিকারিকেরা বলবেন না? চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরীক্ষা-দুর্নীতির পরিণাম মারাত্মক। মেডিক্যাল শিক্ষা দুর্নীতিতে তৎকালীন উপাচার্য ডাক্তার সুহৃতা পাল-এর কী ভূমিকা ছিল তা নিয়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। একটিরও সদুত্তর মেলেনি। বরং রমরমিয়ে চলেছে শিক্ষা দুর্নীতি। উল্টে অভিযোগকারীদেরই ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে, হুমকি দেওয়া হয়েছে।
যিনি এ রাজ্যের হেলথ রিক্রুটমেণ্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান, তিনিই রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, তিনিই আবার আর জি করে রোগী কল্যাণ সমিতির সদ্য-প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বর্তমান বিধায়কও। রাজ্যের স্বাস্থ্য জগতের মহামহিম তিনি। অভিযোগ, তিনি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চাকরি দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী। ২০২২ সালের মহাবিতর্কিত মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্বাচনে গা-জোয়ারি করে, নানা কারচুপির মাধ্যমে যাঁদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল তাঁদের অনেককেই আজ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমস্ত দুর্নীতির পুরোভাগে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
শাসক দলের নেতা বর্ধমানের এক ডাক্তারবাবুর নামে অভিযোগ ছিল, তিনি হাসপাতালের মৃতদেহ বেসরকারি ক্ষেত্রে বিক্রি করে দেন। তার তদন্ত হয়েছে, রিপোর্টও এসেছে। কিন্তু তারপর অখণ্ড নীরবতা। আর জি কর হাসপাতালের বায়ো মেডিক্যাল ওয়েস্ট কীভাবে পুনরায় ব্যবহৃত হচ্ছে বাজারে? সাধারণ মানুষ অজ্ঞাতসারেই যদি ব্যবহার করতে বাধ্য হন আগে ব্যবহার-করা ইনজেকশন সিরিঞ্জ কিংবা অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী, তাহলে হেপাটাইটিস বি/সি, এইডস কিংবা সিফিলিস সংক্রমণের শিকার হতে পারেন যে কোনও সময়। মুনাফাখোর কুচক্রী একদল মানুষ অসহায় দরিদ্র মানুষের চরম ক্ষতির সম্ভাবনা জেনেও চালাবে এই চরম বেআইনি ব্যবসা? অভিযোগ আছে, তদন্ত নেই। তদন্ত হলেও পদক্ষেপ নেই। হাসপাতালের জমি, বাড়ি, যন্ত্রপাতি কেনা ও ব্যবহার নিয়ে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ প্রয়োজনীয় তথ্যসহ জমা দেওয়ার পরেও কিছুই প্রায় হয়নি, হয় না। কাদের স্বার্থে, কাদের আড়াল করতে বারবার তদন্ত থামিয়ে দেয় স্বাস্থ্য দফতর? সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে ভিতর থেকে এইভাবে নড়বড়ে এবং বিপদজনক করে তোলার মধ্যে কোন বৃহত্তর স্বার্থ কাজ করছে? মানুষের এই সর্বনাশের দায় কার?
অন্যায় ভাবে, প্রভাব খাটিয়ে যেসব ডাক্তার তৈরি হচ্ছেন তাঁরা কাদের চিকিৎসা করবেন? সাধারণ মানুষেরই তো? পশুপাখিদের তো নয়? সরকারি হাসপাতালে শাসক দলের নেতার পোষ্য সারমেয়টির ডায়ালিসিস ছাড়াও তো অন্য কাজ থাকে। সেসব কাজে এই ঘুর-পথে পাশ করা ডাক্তাররাই আসবেন? অন্য ডাক্তাররা এর প্রতিবাদ করলে, ন্যায়ের কথা বললে, তাঁদের আবার হুমকি দেওয়া হবে? এসব বিষয় দেখার কাজ জনতা কাকে দিয়েছিল? তিনি/ তাঁরা সেসব দায়িত্ব পালন করেননি কেন? জবাব দেবে কে? জনতার কাছে তাঁরা কি অভিযুক্ত হবেন না?
গণতন্ত্র বনাম শাসকের স্বেচ্ছাচার
সমস্ত হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজে গণতান্ত্রিক কাঠামো বলে কিছু নেই। ছাত্রদের নির্বাচন, বহু জায়গায় পরিচালন সমিতির নির্বাচন বন্ধ হয়ে গেছে এক দশকেরও বেশি আগে। কেন কেবলমাত্র এক ব্যক্তির খেয়ালখুশি মোতাবেক কমিটি গড়া হবে? দুর্নীতিচক্রের অবাধ বিচরণের স্বার্থেই কি গণতন্ত্র বাতিল হয়ে গেছে? হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানো, অন্যায়ভাবে পাশ ফেল করানো, নানা ধরনের আর্থিক তছরুপের সুবিধা করে দিতেই কি এই গণতন্ত্র-ভ্যানিশ প্রকল্প? রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়গুলির করুণ দশা। হাজার হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে, শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতি আজ প্রমাণিত। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীসহ আধিকারিকেরা জেলে। স্বাস্থ্য দফতরেও তাহলে একই হাল? তাই কি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত কমিটি গঠনে শাসকের এত অনীহা? অভয়ার মৃত্যুতেও কি এই অশ্লীল স্বেচ্ছাচার ঘুচবে না?
শেষ কথা
হ্যাঁ, অভয়ার মর্মান্তিক হত্যার যথার্থ বিচার চাই। শুধু বিচার চাই না। ন্যায় বিচার চাই। তার সঙ্গে এও যে চোখে পড়েছে, কোন নরক কুণ্ডে অভয়ার মতো মানুষদের কাজ করতে হয়েছে বছরের পর বছর। হুমকি, যৌন হয়রানি, আর্থিক দুর্নীতি, জাল ওষুধের চক্র সহ আরও নানা বেআইনি কারবারের মধ্যেই চিকিৎসক এবং ডাক্তারি পড়ুয়াদের কাজ করতে হয়। এতদিন অন্যান্য শিক্ষাক্ষেত্রের নানা দুর্নীতি এবং অব্যবস্থার কথা জানা যেত, আলোচিত হত। মাঝে মাঝে “ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা” অধ্যাপকদের পিটিয়ে পরে দুঃখপ্রকাশ করে নিত, কিংবা দাপুটে বিধায়ক শিক্ষিকাদের দিকে জলের জগ ছুঁড়ে মেরে “তাজা ছেলে” তকমা পেতেন। কিন্তু ডাক্তারি শিক্ষাঙ্গনেও যে এমন ভয়াবহ সব আতঙ্ক জমা আছে তা সাধারণ মানূষের কাছে এত স্পষ্ট ছিল না। কেন সাধারণ মানুষ হাসপাতালে বেড পাবার জন্য হাহাকার করে বেড়াবেন? কেন জাল ওষুধের অভিযোগ উঠবে বারবার? কেন দরিদ্র মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে ব্যবসায় মুনাফার লোভে? মানুষের মৃতদেহ নিয়েও যে এমন কদর্য ব্যবসা তথা দুর্নীতি চালানো যায়, এটাও কি মুখ বুজে সহ্য করতে হবে আমাদের?রাজ্যের সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাঠানো কি রাজ্যের দায়িত্ব নয়? ঘরের কাছে সরকারি কেন্দ্রে ন্যূনতম চিকিৎসা কি মিলবে না? কেন শাসক দলের নেতা কিংবা তাঁদের মদতপুষ্ট দালাল এবং ফড়েদের কাছে মাথা নত করেই চলতে হবে সাধারণ মানুষকে? ডাক্তারবাবুদের একাংশ মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করেছেন, ডেপুটেশন দিয়েছেন ঠিকই–কিন্তু বৃহত্তর জনসমাজে সেসব খুব আলোচিত হয়নি। অনেকেই ভেবেছেন, এসেব ওঁদের নিজেদের ব্যাপার, পেশার সমস্যা। কিংবা বলা হয়েছে, ওঁরা আসলে “রাজনীতি করছেন”। আজ অভয়ার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড সব আবরণ টেনে খুলে দিয়েছে। এই হত্যার সঙ্গে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্নীতির কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ আছে কি না তা হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে, কিন্তু তা থাকুক বা না থাকুক, অভয়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের যে ভয়ানক বিপজ্জনক চিত্র বেরিয়ে পড়েছে তারও জবাব দিতেই হবে আজ।
শেষ কথার পরের কথা
অভয়া হত্যার পরেপরেই আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ প্রকাশ্যে বলেছিলেন, অভয়াকে বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন তিনি, কিন্তু পারেননি। কাদের হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন? এ কথার রহস্য কবে উদ্ঘাটন হবে? দায়সারা ভাবে ধীর গতিতে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। প্রমাণ লোপাটের কথা আদালতে জানিয়েও তারা আজ অব্দি কে বা কারা কোন কোন প্রমাণ লোপাট করেছে তার সদুত্তর দেয়নি। তারাও কি কাউকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে? মহামান্য আদালতের নজরদারিতে তদন্ত হবার কথা। জনতার নজরদারিও কিন্তু চলবে তার পাশাপাশি। গত দুই মাসে এ রাজ্যে কুড়িটিরও বেশি খুন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মেয়েদের নিরাপত্তা, সাধারণ বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও আমরা রক্ষা করতে পারব না? সারা দেশেই মেয়েদের এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষের উপর অত্যাচার বেড়েই চলেছে। তা আজ ভয়াবহ আকার নিয়েছে আমাদের রাজ্যেও। এতে দায় কিছু আমাদেরও আছে বৈকি। চোখের সামনে আমাদের ঘরের মেয়ের নির্মম খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় ধিক্কার কিছুটা আমাদেরও প্রাপ্য। কেন বারবার চোখ ফিরিয়ে থেকেছি? কেন সরকারকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিদ্ধ করিনি? কেন লোভ আর ভয়ের সংস্কৃতিকে ফুলে-ফলে বেড়ে উঠতে দিয়েছি? আমাদের নীরবতায় একে একে প্রাণ চলে গেছে। এবার আগুন লেগেছে ঘরেই। এবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। জবাব চাওয়ার সময়। ভয় ও দুর্নীতিচক্রের হোতা, স্বাস্থ্য এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের সর্বোচ্চ কর্তা এবং মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাই দেওয়া হচ্ছে জনতার চার্জশিট। প্রতিটি প্রশ্নের সদুত্তর যদি না পাই, প্রশাসন ও সরকার এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের দায় যদি স্বীকার না করেন তাহলে অভয়াদের কাছে আমরা অপরাধী থেকে যাব।
অভয়া মঞ্চের পক্ষে ৯ নভেম্বর, ২০২৪ প্রকাশিত।।