উপক্রমণিকা
ক’দিন আগেই করোনা নিয়ে লিখেছি। এবার লিখছি পুরোনো এক রোগ নিয়ে। ডেঙ্গু। ল্যাটিন আমেরিকা আর এশিয়া ডেঙ্গুতে শয্যশায়ী।
যখনই কোনও মহামারী নিয়ে লিখতে যাবো, তখনই ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (“হু”) নিয়ে লিখতে হবে। এখানে একটা কথা বলা দরকার “হু”র কিন্তু কোন অসুখে নতুন কী ওষুধ কাজ করবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব নয়। মহামারীর তথ্যানুসন্ধান এবং প্রতিকারের নীতি ঠিক করা দায়িত্ব। শোনা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সানোফি (যারা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের বৃহত্তম প্রস্তুতকারক) কোম্পানির এক তৃতীয়াংশের মালিক। “হু” কিন্তু এই ওষুধটিকে করোনায় ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল (আইভারমেক্টিন, র্যামডিসিভির, সবাই লাইনে আছে, যেগুলো অপ্রমাণিত পরিত্যক্ত ওষুধ)। কোনও বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা পত্র ছাড়াই এরা যথেচ্ছ বিক্রি হয়েছে। আমি আদ্রকের সওদাগর এসব ভেবে লাভ নেই। এই সব ওষুধ বৃহত্তম ডাক্তাররা লিখবেন। তবে বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় কোনও লেখা পাইনি।
বছরে প্রায় একশো থেকে চারশো মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। একশো থেকে চারশো মিলিয়নের এতো বেশী লম্বা একটা পরিধি আমি ধরি নি। ডব্লুএচওর তথ্য।
বাহক
ভাইরাসটা হলো ফ্লাভিভিরিডি গ্রুপের একজন সদস্য (জ্ঞান ফলানো, অপ্রয়োজনীয় তথ্য)। একটা আবরণী যুক্ত ভাইরাস। এই আবরণীই যতো কুকান্ড ঘটায়।
যে মশা এই রোগ বহন করে, তারা মহিলা। নাম ঈডিস ইজিপ্টি। ইজিপ্ট জানেন? ক্লিওপেট্রা, পিরামিড, মরুভূমি….কাকাবাবু, শঙ্কুর অভিযান। কিন্তু প্রাচীন কালে মরুভূমির আগে ওখানে গভীর বন ছিলো। মহা ভূমিকম্প হয়ে সব গাছপালা মাটির তলায় চলে যায়। সেটা থেকেই পেট্রোল-তরল সোনা ওর মরুভূমির সোনালী বালি। ভূমিকম্পের সময়ে মশারা উড়ছিলো।তাই তারা মাটির তলায় যেতে চায় নি,সুতরাং তারা বেঁচে যায়। এরপর ইজিপ্ট মরুভূমি হয়ে দিনের বেলা আগুনের মতো গরম, রাত তীব্র শীতল। বেচারা মশারা তাই ভোরবেলা আর সন্ধেবেলা কামড়াতে বেরোয়। প্রতিকূল আবহাওয়ায় বেশী দূর না যেতে যেতে এদের ওড়ার ক্ষমতাও কমে যায়।
এদের মধ্যে কিছু পরিযায়ী মশা ভারতে এসেছে। ঘন ঘন এত সব পরিবর্তনের ফলে ওরা খুব ভীতু হয়ে যায়। এক মুহূর্ত বসবে তারপরই ভয় পেয়ে পালাবে। ফলতঃ একটা বাহক মশকী একসঙ্গে বহু মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। এরা জিকা বা চিকুনগুনিয়াও ছড়াতে পারে।
সকাল সন্ধ্যা ছাড়া যে অন্য সময় টুক করে বেরিয়ে কুট করে হুল ফোটাবে না–তার কোনও গ্রান্টি নেই।
রোগ
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ডেঙ্গুকে চারভাগে ভাগ করা যায়। সে সব বৈজ্ঞানিকদের জন্য তোলা থাক।
মূলতঃ দুটি ভাগ, সাধারণ জ্বরের মতো আসবে, নিজে নিজেই বিদায় নেবে।এটা অনেক সময়ই ধরা পড়ে না।
দ্বিতীয়টা গন্ডগোলের। এটাতে আমাদের শরীরের শিরা ধমনীর পারমিয়েবিলিটি (ব্যাপ্তিযোগ্যতা) বেড়ে যায়, ফলে ঘন রক্ত থেকে জলীয় অংশ অসমোসিস (অভিস্রবণ) পদ্ধতিতে শরীরের অন্যান্য অংশে বেরিয়ে আসে। সেটা জমা হয় পেটে, হার্টে, ফুসফুসে। সেও আরেক বিপদ। এর ফলে রক্তের ঘনত্ব বাড়ে কিন্তু মোট পরিমাণ কমে যায়। ফলে প্রেসার এ্যাতো কমে যায় যে মাপা যায় না। পাল্স (নাড়ি) দ্রুততর এবং ক্ষীণ হয়ে যায়। এই ভয়ানক কম রক্তচাপে কিডনি, হার্ট ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গ কর্মক্ষমতা হারায়, যাকে বলে মাল্টি অর্গান ফেলিওর। এটা হলো ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম।
এটাই শেষ নয় ভাইরাস একদিকে অস্থিমজ্জাকে অকেজো করে দ্যায়।অন্যদিকে ভাইরাসের আবরণী প্রোটিন প্লেটলেটের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে প্লেটলেট ধ্বংস করে। তাতে মাড়ি, চামড়ার তলায় বা যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
সাধারণতঃ শক এবং হেমারেজ একই সঙ্গে ঘটে।
বুঝবো কি করে?
সহজ। কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট করানো হবে, প্রয়োজনে প্রতিদিন। যদি পিসিভি (packed cell volume%) বেড়ে যায়, তাহলে রক্তরস leak করছে। সুতরাং প্রচুর জল খেয়ে রক্তের মোট পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে। তাতে না ঠিক হলে শিরা দিয়ে দ্রুত প্রচুর তরল রক্তে ঢুকিয়ে দিতে হবে। যতক্ষণ না পিসিভি ঠিক হচ্ছে।
প্লেটলেট কমলে? দেখতেই পাবেন প্লেটলেট সংখ্যা কমছে। অনেক সময় সেই সঙ্গে সব রকমের রক্তকণিকাই কমে যায়। শ্বেতকণিকা কমে গেলে অন্যান্য জীবাণু থেকে শরীর নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। তখন আইসোলেশানে থাকা। প্লেটলেট বা ফ্রেশ হোল ব্লাড দেওয়া।
আমাদের দেশে পীলে (tropical splenomegaly) বড়ো থাকার জন্য অনেকেই পঞ্চাশ হাজার প্লেটলেট নিয়ে ফুরফুরিয়ে আছেন (ব্যাখ্যা চাইবেন না। স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিন)। কাজেই প্লেটলেট যথেষ্ট কমলে আপনার ডাক্তার ঠিক সময়ে প্লেটলেট দেবেন। প্লেটলেট দেওয়ায়, এমনকি বার বার দেওয়াতেও কোনও অসুবিধে নেই।
(গোপনে চুপিচুপি বলি, এই হাতুড়ে কুড়ি হাজার প্লেটলেটেও
প্লেটলেট না দিয়ে রোগীর চিকিচ্ছে করেছিলো, মাইরি বলছি সেরে উঠে পেশেন্ট আমাকে বাড়ি থেকে ঠান্ডা ডবল ডিমের ওম্লেট এনে খাইয়েছে)
ভরসা রাখুন চিকিৎসকে।