অমিতের এমন অবস্থা হবে, সে কখনো ভাবেনি! যে অমিত অফিসে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, প্রায় ১৫ মিনিট হনহন করে হেঁটে লোকাল ট্রেন ধরত, সে এখন বাড়ির সামনের দোকানে যেতে ভয় পায়। অফিসে যে ছেলেটা সারাক্ষণ কর্মব্যস্ত থাকত, সব কাজে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করত, সে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল! লাঞ্চ টাইমে কী অসম্ভব গল্প করত ছেলেটা, সে এখন বেশি কথা বলতে চায় না, আড়ালে থাকে। অমিত নিজেও বোঝে সে আর আগের মতো নেই, অজান্তেই অনেকটা গুটিয়ে গেছে। এখন অফিসের কাজেও দু-একটা গণ্ডগোল হচ্ছে! যেহেতু নতুন ছেলে হিসেবে ওর ট্র্যাক রেকর্ড বেশ ভালো, তাই বস কিছু বলেননি! ও একটা সময় নিয়মিত জিম যেত, শরীরের গঠনটাও বেশ ভালো ছিল। কিন্তু এখন যেন অনেকটা ভেঙে গেছে, ওজন কমেছে বেশ খানিকটা। শেষ দু-সপ্তাহ হল জিম যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বেরোতে চায় না কোথাও! ওর উপস্থিত বুদ্ধি দেখলে একসময় চমকে উঠতে হত! রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো স্মার্টনেস! কিন্তু আজকাল কেমন চুপসে রয়েছে, একটা নিস্তেজ ভাব। বাড়িতেও খুব বেশি কথা বলছে না! সারাদিন চুপচাপ শুয়ে থাকছে নিজের ঘরে! অথচ কী আশ্চর্য! অমিত এক মাস আগেও এরকম ছিল না! সেদিন তো ওর ঘরে ঢুকে রীতিমতো চমকে উঠেছিল ওর মা। দেখল—ও শুয়ে শুয়ে কাঁদছে! এরপর ওর বাবা-মা বেশ ভয় পেয়ে যায়, বন্ধুদেরকেও জিজ্ঞেস করে।অন্য কোনো বড়ো কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না! সেরকম কিছু জানা যায় না। তারপর ওঁরা পাড়ায় একজন বয়স্ক ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যান! শেষমেশ অফিসের লোকজন একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পরামর্শ দেয়!
অমিতকে যখন প্রথমবার ওর বাব-মা নিয়ে আমার ক্লিনিকে নিয়ে আসে ওকে দেখেই বিধ্বস্ত লাগছিল। ওর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করার পরই আমার নিজের মনটাও খারাপ হয়ে যায়! ইন্টারভিউ চলতে থাকে।
—ইদানীং আমার কিছুই ভালো লাগে না, কেন ভালো লাগে না, আমি জানি না। আমি চেষ্টা করি জোর করে ভালো লাগানোর করার, কিন্তু হয় না! খুব ফাঁকা হয়ে যায় মনের ভেতরটা।
—হুম,বুঝতে পারছি। কবে থেকে শুরু হল এসব? আমি প্রশ্ন করি।
—একমাসের একটু বেশি, ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে।
—আচ্ছা। প্রথম কী সমস্যা শুরু হয়??
—আমার প্রথমে একদম সকালের দিকে ঘুম ভেঙে যেত। তারপরে আর কিছুতেই ঘুম আসত না, ধীরে ধীরে শরীরের এনার্জি, চনমনে ভাব কমে আসতে থাকে। খিদে পেত না। এখন আর কিছুই ভালো লাগে না!
কথাবার্তা এগোলে বুঝতে পারি ও অবসাদ রোগে ভুগছে, যাকে আমরা ডিপ্রেশন বলে থাকি।
—যেন মনে হয়, মনটা অদ্ভুত এক ছন্নছাড়া। খালি শূন্যস্থানে ভরে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব অন্যায় করে ফেলেছি, খুব খারাপ লাগে তখন।
অমিত ওর সমস্যার কথা আরও বলতে থাকে, আমি মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। সবশেষে ও বলল—
সবচেয়ে বেশি কষ্ট কখন হয় জানেন, সকালের দিকে, ঘুম ভেঙে যাবার পর, যেন মনে হয় মনের মাঝে একটা ব্ল্যাকহোল জমে আছে, যে আমার সব এনার্জি শুষে নিচ্ছে।
উপমাটা ভালো হলেও আমার বেশ মন খারাপ হয়ে গেল, ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে পরিস্থিতি একটু গম্ভীর ও থমথমে হয়ে গেছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম ওর ডিপ্রেশানের সমস্যা অনেকটা গভীর।
আমি ওকে এবং ওর বাবা-মা-কে ডেকে রোগের ব্যাপারে বললাম। ওর বাবা-মা খানিকটা শান্ত হল! কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসাও ছিল।
—ওর ডিপ্রেশন কেন হল? ও তো খুব শক্ত মনের মানুষ, প্রাণবন্ত ছেলে ছিল, হাসিখুশি। ওষুধ খাওয়া কি খুব জরুরি? সিরিয়াস কিছু নয় তো?
আমি বললাম—ডিপ্রেশন এসব দেখে হয় না। এখানে সবল দুর্বল বা সবলের কোনো ব্যপার নেই।
ওর বাবা মাকে আশ্বস্ত করলাম, বোঝালাম নিয়মিত ওষুধ এবং থেরাপিতে থাকলে ও আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে। ডিপ্রেশন নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক জানা, না-জানা রয়েছে, ঠিক যেমনটা রয়েছে অমিতের বাবা-মায়ের। আমাদের ছোটোবেলা থেকেই এই ভুলভ্রান্তি এবং বিশ্বাস তৈরি হয়। সেই ভুল ভ্রান্তিগুলো আজ শুধরে নেওয়া আশু প্রয়োজন, প্রয়োজন খোলাখুলি কিছু আলোচনা। আসুন একদম গোড়া থেকে শুর যাক।
ডিপ্রেশান কী?
খুব সহজভাবে বলতে গেলে ডিপ্রেশান মস্তিষ্কজনিত একটি মানসিক রোগ। এখন প্রশ্ন হল মনের ঠিক কোন অসুখ হলে আমরা তাকে ডিপ্রেশান বলব?সেটা বোঝার আগে স্বাভাবিক সুস্থ মনের কী কী কাজ সেগুলো একটু জেনে নেওয়া ভালো! আমাদের মন বা এখনকার নিউরো-সায়েন্সের যুগে যদি তাকে ব্রেন (Brain) বা মস্তিষ্ক বলে মেনে নেই, তাহলে তার কিছু ব্যাবহারিক কাজ থাকে! তাঁর মধ্যে প্রধান তিনটি হল—
(১) কগনিশান (Cognition)—অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকের সুস্থ চিন্তাভাবনা করা এবং মনে রাখার ক্ষমতা,
(২) ব্যবহার (Behaviour)—আমাদের বাহ্যিক আচার-আচারণ,
(৩) আবেগ (Emotion)—আমাদের অনুভূতি অর্থাৎ কোনো কিছু খারাপ বা ভালো লাগার ক্ষমতা।
এখন এই ইমোশানের দুটো ভাগ একটা হল মুড (Mood) আর একটা হল অ্যাফেক্ট (Affect)। মুড হল অনেকদিন ধরে স্থিতিশীল ইমোশানের অন্তর্মুখী রূপ যার উপর নির্ভর করে, সেই ব্যক্তি চারপাশকে কীভাবে অনুভব করবে, দেখবে, বুঝবে তা ঠিক হয়! আর অ্যাফেক্ট হল ইমোশানের বাইরের দিক যা খুব অল্পসময় ধরে থাকে। ঠিক ভূগোল বইতে পড়া জলবায়ু ও আবহাওয়ার পার্থক্যের মতো! মুড হল জলবায়ুর মতো দীর্ঘকালীন, আর অ্যাফেক্ট হল আবহাওয়ার মতো স্বল্পায়ু! এখন ডিপ্রেশান বা অবসাদ রোগ হলে মনের যে স্বাভাবিক তিনটি কাজ নিয়ে আগে বললাম, তাঁর মধ্যে প্রধানত ইমোশানের গণ্ডগোল হয় আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মুড-এর সমস্যা দেখা যায়!
আমাদের মুড ভালো অর্থাৎ স্বাভাবিক থাকলে আমাদের ভালো জিনিস ভালো আর খারাপ জিনিস খারাপ লাগে। সেটা অবশ্যই প্রত্যেকের নিজস্ব নিজস্ব পছন্দ স্বাপেক্ষে! এবার মুড যদি খারাপ হয় কিংবা ডিপ্রেসড মুড হলে, আগে যা ভালো লাগত, তা এখন আর ভালো লাগে না। ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (Depressive Disorder) বা অবসাদ রোগ হলে সঙ্গে আর একটি জিনিস এসে যোগ হয়, তাহল আমাদের কোনো কিছু ভালো লাগার যে স্বাভাবিক অনুভূতি তা নষ্ট হয়ে যায়! আমাদের কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না, এটিই হল ডিপ্রেশনের প্রধান জায়গা।
ডিপ্রেশানের লক্ষণ
ডিপ্রেশন আমাদের অনেকরকম ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা, অনিচ্ছায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা, মনের স্বাভাবিক আনন্দ-ফুর্তি, চনমনে ভাব কমে আসা। এগুলো বাদ দিয়েও আরও বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়—মাঝে মাঝেই কান্না পাওয়া, মনের ভিতরে ফাঁকা লাগা, দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে সবকিছুতে হতাশ এক মনোভাব নিয়ে বেঁচে থাকা। বাচ্চা অথবা কিশোর বয়েসে ডিপ্রেশন হলে তাদের অনেক সময় খিটখিটে মন-মেজাজ থাকতে পারে।
স্বাভাবিক নিয়মে খিদে পাওয়া বা খাওয়ার যে নিজস্ব রুচি তা পরিবর্তিত হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খিদে কমে আসে, ওজন কমে যেতে পারে। তবে অনেকসময় আবার খিদে এবং ওজন, দুটোই বাড়তে পারে।
ঘুমের পরিবর্তন হওয়া ডিপ্রেশানের একটি অন্যতম লক্ষণ, ঘুম না আসা, ঘুম বার বার ভেঙে যাওয়া কিংবা সকালে সময়ের আগে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আর ঘুম না আসা।
কথাবার্তা বলা কিংবা কাজকর্মের ক্ষেত্রে একটা তীব্র অলসতা ভাব চলে আসে, চিন্তাভাবনার গতি শ্লথ হয়ে আসে, কথা বলার মধ্যে এক অদ্ভুত জড়তা কাজ করে, সময় বেশি লাগে। শরীরে এনার্জি অনেক কমে আসে বা সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
অবসাদগ্রস্ত মনে নিজেকে অপদার্থ, অকর্মণ্য মনে হওয়া অথবা নিজেকে নিয়ে খুব হীনমন্যতায় বা সাংঘাতিক অনুশোচনায় ভোগা, নিজেকেই সবকিছুর জন্যে দোষী বা অপরাধী বলে মেনে নেওয়া।
খুব সহজেই অমনোযোগী হয়ে পড়া, সিধান্তহীনতায় আটকে থাকা, অনেকক্ষণ ধরে কোনো একটি কাজ করতে না পারা।
মৃত্যুর ভাবনা বারবার মনের মধ্যে আসা, দিনের বেশিরভাগ সময় মৃত্যু সংক্রান্ত চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা, সেই সংক্রান্ত পরিকল্পনা করা অথবা আত্মহত্যার চেষ্টা করা।
অবসাদ রোগের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নিয়ে মনোবিদ, ড. অ্যারন বেক (Aaron Beck ) তিনটি উল্লেখযোগ্য কথা বলেন—১) নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক ভাবা—‘আমি একজন খুব বাজে মানুষ’, ২) পৃথিবী বা আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা—‘আমার আশেপাশের কোনো মানুষজনই আমাকে ভালোবাসে না’ ৩) ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাশায় ভোগা—‘কোনো কিছুরই পরিবর্তন হবে না, সবকিছু আরও খারাপ হবে, আমি আশাবাদী নই’।
ডিপ্রেশন যদি তীব্র আকার ধারণ করে তাহলে সাইকোসিস (Psychosis) অর্থাৎ বাস্তবতা সম্পর্কে ভ্রান্ত অভিজ্ঞতা তৈরি হয়—যেমন ভুল বিশ্বাস ডিলিউশান (Delusion), ভুল অনুভূতি হ্যালুশিনেশান (Hallucination) অসংলগ্ন কথাবার্তা, অদ্ভুত এবং অযৌক্তিক ব্যবহার দেখা যেতে পারে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ সময়েই আরও অন্যান্য অসুখ থাকতে পারে যেমন নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্তি, অকারণ দুশ্চিন্তা ইত্যাদি।
এই উপসর্গগুলো যখন দু-সপ্তাহের বেশি থাকে এবং তার জন্যে যখন একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত হয় তখন তার অবসাদ রোগ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়!
ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন কী?
‘ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন’ এই শব্দ বন্ধটি লোকমুখে এখন বেশ শোনা যায়। তবে এই ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের মানে কী? সহজভাবে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বলতে বোঝায় হল একজন ব্যক্তি ডিপ্রেশন বা অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন। মানসিক রোগ নির্ধারণের যে প্রধান দুটো গাইডলাইন ICD-11 (International Classification of Diseases) এবং DSM-5TR (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders—Text Revision) সেই অনুযায়ী ডিপ্রেসিভে ডিসঅর্ডার বিভিন্ন রকমের হতে পারে যেমন DMDD (Disruptive Mood Dysregulation Disorder)—কারও কম বয়সে খুব খিটখিটে মেজাজ, থাকা মাত্রাতিরিক্ত রেগে যাওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক অর্থাৎ রজচক্র চলাকালীন বা কিংবা শুরু হওয়ার আগে, মন খারাপ থাকা, যাকে বলে PMDD (Pre-menstrual Dysphoric Disorder)। ডিপ্রেশন আসে এপিসোডের মতো অর্থাৎ একবার এসে বেশ কিছুদিন থাকে, তারপর চলে যায়। তারপর আবার আসে হুড়মুড় করে, ডিপ্রেশন বারবার ফিরে এলে তাকে বলে RDD (Recurrent Depressive Disorder)। আর এক ধরনের ডিপ্রেশিভ ডিসঅর্ডার হয় যেখানে ডিপ্রেসিভ অর্থাৎ অবসাদগ্রস্ত মন একটানা প্রায় ২ বছর থাকতে পারে, তাকে বলে ডিসথাইমিয়া (Dysthymia)। তবে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার অর্থাৎ অবসাদ রোগের মধ্যে প্রধান হল মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (Major Depressive Disorder MDD)—একেই আমরা সাধারণভাবে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশান বলে থাকি।
ডিপ্রেশনের প্রকারভেদ
ডিপ্রেশন বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনে আসতে পারে, তার প্রকাশের রূপও আলাদা। একেক জনের ক্ষেত্রে এক ধরনের লক্ষণ বেশি মাত্রায় দেখা যায় অথবা অন্য কোনোরকমভাবে ডিপ্রেশন লুকিয়ে থাকতে পারে। যেমন—
(১) দুশ্চিন্তাজনিত—কারও ক্ষেত্রে অত্যাধিক দুশ্চিন্তা হতে পারে, অবসাদের প্রধান লক্ষণগুলো ছাড়াও সারাক্ষণ অস্থির লাগা, ছটফটে হয়ে ওঠা, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে এই রকম মনে হওয়া, খুব ভয়বাহ কিছু একটা ঘটবে সেই নিয়ে আশঙ্কায় থাকা।
(২) অত্যাধিক বিষাদজনিত—কারও ক্ষেত্রে প্রচণ্ড রকমভাবে আনন্দ কমে যাওয়া, মন ফাঁকা হয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক আনন্দ ফুর্তি কমে আসা, ঘুমের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটা, নিজের যৌন ইচ্ছা বা খিদে কমে আসা, অপরাধবোধে ভোগা।
(৩) অন্যরকম অবসাদ—যাকে বলে ডিপ্রেশনের অ্যাটিপিকাল (Atypical) রূপ, খুব চট করে মুড ভালো হয়ে যাওয়া, প্রচুর ওজন বেড়ে যাওয়া, বেশি করে ঘুমানো, পা কাঠের মতো ভারী হয়ে আসা, খুব সহজেই নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে রাগ-মান অভিমান দেখিয়ে খারাপ থাকা।
(৪) গর্ভাবস্থার সঙ্গে অবসাদ—কিছু কিছু মহিলার গর্ভাবস্থায় অথবা বাচ্চা জন্মানোর পর অবসাদে ভুগতে শুরু করেন, অনেক এই অবস্থায় সময় সাইকোসিস দেখা যায়।
(৫) ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে—কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ঋতু পরিবর্তন এর সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ এক ধরনের ঋতু এলে অবসাদ রোগ এসে হাজির হয়, সাধারণত শীতের শুরুর দিকে এই ডিপ্রেশন শুর হয় আবার বসন্তকাল আসতে আসতে তা কমতে শুরু করে।
(৬) বাইপোলার ডিসঅর্ডার—সাধারণত ডিপ্রেশন বলতে আমরা উইনিপোলার (Unipolar) ডিপ্রেশন বুঝি, যেখানে ম্যানিক (Manic) এপিসোড হয় না। কিন্তু কখনো তা মিশে থাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সঙ্গে, যেখানে কোনো-না-কোনো সময় ম্যানিক এপিসোড হয়।
ডিপ্রেশন কতটা মারাত্মক?
ডিপ্রেশন আজ সামাজিকভাবে পরিচিত একটি রোগ। এটি হয়তো খুব সাধারণ কিন্তু তা হতে পারে ভয়ংকর, জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো। অন্যান্য সমস্ত মানসিক রোগের বিচার করলে ডিপ্রেশনের প্রাদুর্ভাব বেশির দিকেই থাকবে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষ বিভিন্নভাবেই লজ্জা পান, নানা ধরনের সামাজিক স্টিগমার বা বৈষম্যের স্বীকার হয়ে থাকেন। আমাদের দেশে এই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হবার পরিসংখ্যান বেশ ভয়াবহ। যেকোনো সময়ে দেশের ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ২-৩ জনের ডিপ্রেশন থাকে। অর্থাৎ ভারতে প্রায় ৩.৬ কোটি লোক এই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। এবং প্রতি ১০০ জনের মধ্যে জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন ৫-৬ জন লোক। মানে প্রায় ২০ জনের মধ্যে ১ জিন ডিপ্রেশনে ভুগছেন। সমস্ত পৃথিবীতেও এর সংখ্যাটা কম নয়। প্রায় ৩০ কোটির কাছাকাছি লোক ডিপ্রেশন-এর বোঝায় নিজে এবং নিজের পরিবারকে জড়িয়ে ফেলেছেন। এর ট্রিটমেন্ট গ্যাপ অর্থাৎ চিকিৎসা থেকে দূরে থাকার পরিমাণ প্রায় ৮০-৮৫ % এর কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রায় ১০০ জন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ জনই চিকিৎসার বাইরে থাকেন। ডিপ্রেশনে প্রায় ১০-১৫% সুইসাইডে আক্রান্ত হন। ইউনিপোলার ডিপ্রেশন সাধারণত প্রথমবার জীবনে আসে ২০ বছরের পর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৩ মাসের মধ্যে তা কমতে শুরু করে, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই তা টানা একবছর বা ৬ মাস থাকতে পারে। মেয়েদের মধ্যে অবসাদ রোগ অনেকটা বেশি, প্রায় দ্বিগুণ। একইরকমভাবে বেশি সামজিকভাবে প্রান্তিক বর্গের মানুষদের মধ্যেও।
ডিপ্রেশনের কারণ
ডিপ্রেশনের কারণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। একেক জনের ক্ষেত্রে তা একেক রকম ভাবে আসতে পারে। যাদের একটা ‘বায়োলোজিকাল’ ভালনারেবিলটি (Vulnerability) অর্থাৎ জৈবিক অসহনশীলতা রয়েছে। যেমন ছোটোবেলায় ঘটা কোনো বাজে অপ্রীতিকর ঘটনা, ছোটো থেকে বড়ো হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমস্ত মিলিয়েই এই আভ্যন্তরীণ অক্ষমতা তৈরি হয়। ১৮ বছরের আগে যা কিনা মস্তিষ্ক পরিণতির সময়কাল বলে ধরে নেওয়া হয় সেখানে যদি একের পর এক নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে থাকে যা একটা বাচ্চার কাছে চরম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে হাজির হয়! তাহলে এই সুক্ষভাবে মস্তিষ্কের অপরিণত বিকাশের ভয় থেকে যায়! মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গার পারস্পরিক যোগাযোগেও ঘাটতি থাকে! এ ছাড়া বংশ পরম্পরায় ক্ষতিকারক জিনের প্রভাব কতটা সেটাও বিবেচ্য বিষয়! এখন বয়সকালে যখন স্বাভাবিক নিয়মেই কোনো রকম ‘স্ট্রেস’ (‘Stress’) যেমন ধরুন—আর্থিক ক্ষতি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, চাকারি চলে যাওয়া, প্রিয় মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি, আমাদের সবার শরীরেই নিউরোট্রান্সমিটারের (Neurotransmitter) ওঠা-নামা হয়, আমাদের সাম্যবস্থায় নিয়ে আসে! যাদের ক্ষেত্রে এই জৈবিক অক্ষমতা রয়েছে তাদের এই নিউরোট্রান্সমিটার-এর ওঠা-নামা স্বাভাবিকভাবের তুলনায় অনেক বেশি হয়! তখন তা আমাদের স্বাভাবিক ইমোশনাকে ( যেমন মন খারাপ) ছাপিয়ে বহু দূর নিয়ে যায়! আমাদের মুডের এর উপর প্রভাব ফেলে! ডিপ্রেশন আসতে শুরু করে!
ডিপ্রেশান এবং কিছু মিথ
মিথ ১ দুর্বল মানুষদের মধ্যেই ডিপ্রেশান হয়
ফ্যাক্ট—ডিপ্রেশন দৈহিক দুর্বলাতা দেখে আসে না, এর সঙ্গে দুর্বল হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
মিথ ২ ডিপ্রেশন আসলে কোনো বাস্তব রোগই নয়।
ফ্যাক্ট—ডিপ্রেশন আসলেই একটি জটিল মানসিক রোগ, মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার এদিক-ওদিক ওঠা-নামা হয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে, আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গার কার্যক্ষমতা বদলে যায়।
মিথ ৩ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে সুইসাইড নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তার সুইসাইড করার সম্ভবনা বাড়বে!
ফ্যাক্ট—বিভিন্ন স্টাডি প্রমাণ করেছে কাউকে সুইসাইড বা আত্মহত্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তার সুইসাইড করার প্রবণতা বেড়ে যায় না! উলটে তাকে সাহায্য করা হয়!
মিথ ৪
ডিপ্রেশন এমনি এমনি কেটে যায়, কিছু করার দরকার নেই।
ফ্যাক্ট—একদমই নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় না থাকলে ডিপ্রেশনের ফল হতে পারে ভয়ংকর, সুইসাইড করে প্রাণ হারাতে পারেন, তীব্র নেশায় আসক্ত হয়ে যেতে পারেন।
মিথ ৫ ডিপ্রেশন একটি শহুরে রোগ, আধুনিক হাল জামানার নব্য ফ্যাশান।
ফ্যাক্ট—গ্রামে পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্যের পরিকাঠামোর অভাব, রোগ নির্ধারণের অসুবিধা ও সচেতনার কারণে ডিপ্রেশন কম ধরা পড়ে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে গ্রামে আর শহরে অবসাদ রোগের খুব ফারাক নেই।
মিথ ৬ মন হাসি খুশি থাকলে, ঘুরে বেরালে, মনের অসুখ কিংবা অবসাদ হয় না।
ফ্যাক্ট—ডিপ্রেশন সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে, কেউ আনন্দে থাকলে বা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকলে তার ডিপ্রেশন হবে না এমন নয়।
মিথ ৭ ডিপ্রেশনে ব্যবহৃত ওষুধ, খাওয়া উচিত নয় খুবই সাংঘাতিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যুক্ত এবং ক্ষতিকর।
ফ্যাক্ট—সাম্প্রতিককালের বেশিরভাগ ওষুধই স্বল্প পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিশিষ্ট, প্রয়োজন পেশাদার মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া।
কেউ ডিপ্রেশানে ভুগলে আমরা কী বলব আর কী বলব না এই ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার!
আমরা কী কী বলব না?
— পাত্তা দিস না এসবে।
—কালই চলে যাবে!
—আরে তোর আবার কীসের মন খারাপ রে?
—চল তোকে নিয়ে সিনেমা দেখে আসি! মন ভালো হয়ে যাবে’।
—আর একটা নতুন প্রেম কর।
—এই সব ওষুধ খেয়ে কিছু হবে না। বন্ধ করে দে।
আমরা কী কী বলে চেষ্টা করতে পারি?
—আমি কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
—আমার সঙ্গে শেয়ার করার জন্যে, থ্যাঙ্কস!
—শুনে খুবই খারাপ লাগলো। তোর নিশ্চয়ই খুব বাজে সময় গেছে তখন।
—কিন্তু অনেকেই ঠিক হয়ে ওঠেন। তুইও পারবি। ভরসা রাখ।
—আমি কি তোকে কারও কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে নিয়ে যেতে পারি।
—তোর সঙ্গে আছি। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন করিস।
ডিপ্রেশানের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন উপায়ে অবসাদ রোগের চিকিৎসা চলছে। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, ডিপ্রেশনের চিকিৎসাও যুক্তিসঙ্গতভাবে এগিয়েছে, অতীতের চেয়ে আজ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিটি মাধ্যম অনেকাংশেই ফলপ্রসূ ও কার্যকরী! প্রথমে আসি বিভিন্ন থেরাপি (Psychotherapy) বা কাউন্সেলিং বিষয়ক চিকিৎসা পদ্ধতিতে।
কারও অবসাদ রোগ যদি অল্প তীব্রতার হয় বা ডিপ্রেশন যদি অল্প জোরালো হয়, তাহলে সাইকোথেরাপি হিসেবে শুধুমাত্র CBT (Cognitive Behavioural Therapy) যথেষ্ট কার্যকরী!
একটু বাড়াবাড়ি ধরনের হলে, থেরাপির সঙ্গে ফারমাকোথেরাপি (Pharmacotherapy) অর্থাৎ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা, শুরু করা। আজকাল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর বিভিন্ন রকমের ওষুধ ডিপ্রেশনের জন্যে রয়েছে, যাদের কার্যকারিতা যেমন অনেক বেশি, তেমনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম।
আজকাল বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মাধ্যমে নিউরোমডুলেশান (Neuromodulation) অর্থাৎ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গা উত্তেজিত করে (Stimulus) স্নায়ুর (Nerve) কাজ পরিবর্তন করা হয়। তারমধ্যে ভেগাস নার্ভ স্টিমুলেশান (Vagus Nerve stimulation-VNS), রিপিটিটিভ ট্রান্সম্যাগনেটিভ স্টিমুলেশন (repetitive Transmagnetic Stimulation-rTMS), ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশান (Deep Brain Stimulation-DBS)। কলকাতা সহ ভারতের অনেক জায়গাতেই এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রচলন বাড়ছে! এ ছাড়া অনেক সময় উজ্জ্বল সাদা আলোর (Light Therapy) প্রয়োগ করেও ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করা হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ডিপ্রেশন-এর চিকিৎসা যদি রোগ শুরুর একদম প্রথম দিকে আরম্ভ করা হয়, তাহলে ডিপ্রেশনকে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। যদি এই ডিপ্রেশনের চিকিৎসা না হয় সেই ব্যক্তি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন, সাইকোসিস দেখা যেতে পারে, সুইসাইডে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন। তাই এর চিকিৎসা জরুরি। এর সঙ্গে প্রয়োজন সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক, বন্ধুদের যথাযথ ভরসা। প্রয়োজন সমাজের একদম বুনিয়াদি স্তরে ডিপ্রেশন নিয়ে সচেতনতা। তাই আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার একদম নীচের স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (Primary Health Care-PHC) ডিপ্রেশন যাতে সহজে ধরা পড়ে তার সেই ব্যপারে চেষ্টা জোরদার করা উচিত।
‘কেবল মুঠোয় বন্দী কফির একলা কাপ/ ডিপ্রেশানের বাংলা নাকি মন খারাপ’- শ্রীজাতের লেখা এই দুই লাইন আমাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ডিপ্রেশন আর মন খারাপ এক নয়, মন খারাপ আর ডিপ্রেশন একেবারে আলাদা দুটো জিনিস। মন খারাপ একটি মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি, যা দিনযাপনের স্বাভাবিক অঙ্গ, যেমন আমাদের ভালো লাগা, খুশি হওয়া, আনন্দে থাকা একটি অনুভূতি ঠিক একই রকমভাবে দুঃখ পাওয়া মন খারাপ হওয়াও এক অনুভুতি। কিন্তু অবসাদ বা ডিপ্রেশন একটি জটিল মস্তিষ্কজনিত মানসিক রোগ যার একটি লক্ষণ অনেক বেশিদিন ধরে, অনেক বেশি মাত্রায়, দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা, আনন্দ পাওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা চলে যাওয়া। তাই কেউ ডিপ্রেশনে ভুগলে তাকে পাতি মন খারাপ ভেবে ওষুধ খেতে বারণ করবেন না, তাকে নিয়মিত চিকিৎসায় থাকার জন্যে উৎসাহ দেবেন, চিকিৎসায় না থাকলে ডিপ্রেশনে ভয়ংকর আকার নিতে পারে, হতে পারে প্রাণঘাতী ভয়াবহ।
মনে রাখতে হবে ডিপ্রেশন আজ মহামারির মতো ঘরে ঘরে, কোনো একজন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর পক্ষে একে আটকানো সম্ভব নয়, এই লড়াই আমাদের প্রত্যেকের। ডিপ্রেশানকে নিয়ে আজ সবার বিনা সংকোচে কথা বলতে হবে, আমাদের প্রত্যেককে একে অন্যের কথা শুনতে হবে সযত্নে। ডিপ্রেশনকে আগলে রাখতে হবে সাহস করে, একে জুড়ে নিতে হবে আমাদের চিকিৎসার তালিকায়। কেউ ডিপ্রেশনের অন্ধকারে তলিয়ে যাবার আগে তার হাতটা শক্ত করে ধরুন, প্রিয় মানুষের অবসাদে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিন, বিষণ্ণ কঠিন মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ান। ডিপ্রেশনের বিরুদ্ধে এই চ্যালেঞ্জটা আজ আমাদের সব্বাইকে নিতে হবে।