Ecstasy শব্দটার সঙ্গে জীবনে একবারই সৎ এবং আন্তরিক পরিচয় ঘটেছিল। কবে? ১৯৯৮ সালের জুন মাসে। আমি পাবলিক সার্ভিস কমিশন আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ সার্ভিস ক্যাডারের নিয়োগ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে বর্তমান চাকরিটি পেয়েছিলাম।
নার্সিংহোম আর বেসরকারি হাসপাতালে খেপ খেটে খেটে অনিয়মিত রোজগারের দিন শেষ হয়েছিল। শেষ হয়েছিল পাড়ার চিলতে ওষুধের দোকানের পিছনে প্লাইউডের পার্টিশন ঘেরা খুপরিতে ঘামতে ঘামতে ‘পেশেন্ট’এর জন্য হাপিত্যেশ করা নিষ্ফল প্রতীক্ষার প্রহর।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার একটি গ্রুপে আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে লিখে এসেছি, আমার একলা জীবনের সত্যিকারের আপনজন এই চাকরিটা — ভীষণ ভালবেসে সেটা করি আমি। জিনে দাসত্বের স্বাক্ষর রয়েছে বলে self employed রা হ্যাটা করতেই পারেন, বিনিময়ে আমি তাঁদের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা ফিরিয়ে দেব। নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার ধক যাঁদের থাকে, তাঁরা আমার প্রণম্য, কিন্তু এই স্বোপার্জিত চাকরিটা আমার অহঙ্কার।
বহু বহু বিপদের দিন এই চাকরির সস্নেহ সহায়তায় পার হয়ে এসেছি আমি — শেষতম আত্মজনটি যখন ছেড়ে গেল হাত, তখনও সতর্ক প্রহরায় আমার দুঃখকষ্টকে বেঁধে রেখেছিল এই সরকারি গোলামির কাজটাই।
একটা কষ্টার্জিত, দুর্নীতির গন্ধবর্জিত পথে পাওয়া চাকরির মূল্য আমি বুঝি। তাই সেই চাকরির ভরসায় গৃহঋণ নিয়ে নিজের ‘এতটুকু বাসা’ জোগাড় করা ছেলেটি বা মা/বাবার ব্যয়সাধ্য চিকিৎসার ভার অক্লেশে মাথায় তুলে নেওয়া মেয়েটির চাকরি হারানোর বেদনা আমার মনের কোন বেদনার তন্ত্রীতে মর্মান্তিক আঘাত হানে, সে বোধহয় কেবল আমিই জানি।
প্রখর দাবদাহে যে ঘর্মাক্ত, উদভ্রান্ত মানুষটি আকুল হয়ে নিজের যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির প্রমাণস্বরূপ নথি পেশ করতে তিনশ কিলোমিটার দূর থেকে কলকাতায় ছুটে এসেছেন, তাঁর উৎকন্ঠা আমাকে একমুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে দেয় না।
হতাশার শেষ বিন্দুতে পৌঁছনো, বিনা উৎকোচে চাকরি পাওয়া যে মহিলা হাহাকার করে ওঠেন —‘এর চেয়ে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলতে পারতো তো!’, তাঁর অসহায় আর্তি আমাকে অস্থির করে তোলে।
আদালতের বিচার্য বিষয়ের উপর টীকাটিপ্পনী দেওয়া আমার এক্তিয়ারের বাইরে, তবু, ৬০০০ সন্দেহভাজনকে চিহ্নিতকরণের প্রশাসনিক অপারগতার জন্য প্রায় ২৬০০০ জনকে নিজেদের ক্রুশ নিজেদের বইতে বাধ্য করার নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতার সামনে কেন্নোর মতো গুটিয়ে যাই — ভয়ে।
যদি কোনোদিন আমারও অমন হয়? আমিও তো মাথা উঁচু করে সর্বত্র হাঁকার দিয়ে বেড়াই, আমি রাজ্য সরকারি চাকরি করি। আমার ভাগ্যেও কোনোদিন অমন হুকুম আসবে না, তার নিশ্চয়তা আছে কি?
না, নেই। খুব বড়াই করতাম নিজের শ্রমের সুরক্ষা নিয়ে — এই ক’দিনে বুঝেছি আমার সে দাবি কতটা অন্তঃসারশূন্য। ঐ বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকদের মতো, আরো অজস্র বিভাগের অসংখ্য রাজ্যসরকারি কর্মচারীর মতো আমিও মাথা কালো কাপড়ে ঢেকে, গলায় ফাঁসির দড়ি পরে মৃত্যুমঞ্চে দাঁড়িয়ে রয়েছি, কখন কোন অদৃশ্য রাষ্ট্রীয় নির্দেশে ঝট করে সরে যাবে পায়ের তলার পাটাতন, নিয়তি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে অসীম শূন্যতার কোলে — ঠিক আগের মুহূর্তেও আমি বুঝতে পারব না।
প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছি। আমার জীবনের অর্ধশতাব্দী পার করে দেবার পরে পঁচাত্তর বছরের বুড়ো গণতন্ত্র আমায় কেবলই ভয় দেখাচ্ছে — কখনো বাসস্থান হারানোর ভয়, কখনো জীবিকা হারানোর ভয়, কখনো সম্মান হারানোর ভয়, আবার কখনো বা গোটা ভাতের থালাটাই গায়েব হয়ে যাবার ভয়! আর নিতে পারছি না, সত্যিই।
জানি, কোনো বিপত্তারণ হরি বাঁচাতে আসবেন না, অরণ্যে বৃথা রোদন করে লাভও নেই কিছু — তবু, আমার মতো সকল ভাগ্যপীড়িত, ভয়তাড়িত, নিরপরাধ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের হাতটা ছুঁয়ে থাকলাম। রাজনীতি/দুর্নীতির কুনাট্যরঙ্গের মৃত সৈনিক সাজা ‘এক্সট্রা’ আমরা — আমাদের সঙ্গে দেশও নেই, দশও নেই, আছে শুধু সোজাপথে অর্জন করা ব্যাঙের আধুলির তুল্য, টুনির ঘরের ধন একটা চাকরি, শুধুই একটা চাকরি।
‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরুলো, পান ফুরুলো
খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর করো
রসুন বুনেছি।’