বছর ত্রিশের এক মহিলা ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। সঙ্গে পাঁচ বছর আর আটবছরের দুই ছেলে। পাঁচ বছরের ছেলেটা একটানা বলে যাচ্ছে, মা বাইরে বেরিয়ে কিন্তু চিপস কিনে দেবে।
ছোটবেলায় এক দাদার মুখে নানা রকম গণসংগীত শুনতাম। সেই দাদাকে নিয়েও অনেক গল্প আছে। মুশকিল হচ্ছে একটা ঘটনা লিখতে বসলেই, হাজার হাজার ঘটনা এসে ভিড় করে। দাদা একটা গান খুব গাইত- ‘এমন একটা পৃথিবী চাই, মায়ের আঁচলের মত…’। মহিলার আট বছরের ছেলেটি মনে হচ্ছে সেই গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত। মায়ের আঁচল ছাড়ছেই না। সে ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে- এখানে এসব বলতে নেই ভাই। সাবধান- ডাক্তারবাবু আছে। তোকে ইনজেকশন দিয়ে দেবে।
ভদ্রমহিলা কিছুই বলছেন না। বস্তুত তিনি বলার মতো অবস্থায় নেই। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। গোটা পেট জুড়ে ব্যথা। হাত ছোঁয়ালেই কাতরে উঠছেন।
মহিলার হাতে একটা স্যালাইন দেওয়ার ছুঁচ ঢোকানো। বললাম, কোথায় ভর্তি হয়েছিলেন?
তিনদিন আগে বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। একদিন থেকেই ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।
বাড়ি এসেছেন তো এখনও হাতের চ্যানেলটা খোলেন নি কেন? ছুটির কাগজ কই?
মহিলার হাতে একটা কাপড়ের দোকানের নাম লেখা জরাজীর্ণ চটের ব্যাগ। সেখান থেকে সবুজ একটা কার্ড বার করে আমায় দিলেন।
সেটা দেখে বললাম, ছুটির কাগজ কোথায়- এতো রেফার কার্ড। বারাসাত হাসপাতাল থেকে আপনাকে আর জি কর হাসপাতালে যেতে বলেছে। সেখানে না গিয়ে আপনি চেম্বারে এসেছেন কেন?
ভদ্রমহিলা হতাশ মুখ করে বললেন, আর জি করে গিয়ে ভর্তি হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার বাড়ির পরিস্থিতি ভর্তি হওয়ার মতো না।
রেফার কার্ড উলটে পালটে দেখলাম। সেখানে লেখা একিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিস উইথ মাইল্ড অ্যাসাইটিস। অর্থাৎ অগ্নাশয় বা প্যাংক্রিয়াসের অবস্থা সুবিধার নয় এবং পেটেও জল জমতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই ওখানে পেটের ছবি করেছিলো। কিন্তু ছবিটা আর দেয়নি। কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার কাগজই দেয়নি।
বললাম, রোগ তো সুবিধার নয়। এই রোগে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আপনাকে ভর্তি থাকতেই হবে।
মহিলা বললেন, সুবিধার হোক বা না হোক, এটা আপনাকেই চিকিৎসা করতে হবে। কোথাও যাব না আমি। আপনি পারলে বাঁচান, আর না পারলে মেরে ফেলুন। আর পারছি না।
এতো মহা সমস্যা। বললাম, বাড়ির লোক কই? ডাকুন।
মহিলা বললেন, আপাতত বাড়ির লোকজন কেউ নেই। এক মাতাল বর ছিল। সে গতকাল বিপদ বুঝে পালিয়েছে।
পালিয়েছে মানে?
নেশা করে সারাদিন পরে থাকে। আমার রোজগারের পয়সায় খায়, নেশাও করে। নিজের একপয়সা আয়ের মুরোদ নেই। কাল সকালে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলেছিলাম, হাসপাতাল থেকে একটা পেটের ফটো করতে বলেছে। তুমি বিটা কেয়ারে টাকা জমা দিয়ে নাম লিখে আস। আমি পরে গিয়ে করে আসব। সে সেই টাকায় আকণ্ঠ মদ গিলে বাড়ি ফিরেছে। আমি গালি গালাজ শুরু করতেই পালিয়েছে। আর ফেরেনি। সম্ভবত ফিরবেও না। কারণ সে বুঝে গেছে আমার সাথে থাকলে তাকে এখন অনেক দায়িত্ব সামলাতে হবে। সে দায়িত্ব নেওয়ার লোকই নয়। আপনি যা পারেন, ওষুধ দেন। তারপর দেখছি। আমাকে একা লড়তে হবে। ছটা বাড়িতে কাজ করতাম, কাল একবার যাব। তাঁদের আগে বুঝিয়ে বলতে হবে। অনেকদিন কামাই হয়ে গেছে।
মহিলা আমার মন টন একেবারে খারাপ করে চলে গেলেন। সমাজটার কী অবস্থা। কেয়ামতের দিন মনে হচ্ছে একেবারে আসন্ন। আর পারা যাচ্ছে না। কতক্ষণে এই খুপরির যন্ত্রণা শেষ হবে কে জানে। শুধু রোগ হলে তবু চিকিৎসা করা যায়। রোগের সাথে এতরকম আর্থ- সামাজিক সমস্যা, এসবের সমাধান আমার সাধ্যের বাইরে।
পরের রোগী ঢুকতেই মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। মুখটা পুরোটাই পোড়া। বীভৎস দেখাচ্ছে। তবে এই মহিলার সাথে তাঁর স্বামী এসেছেন। স্বামীর কোলে একটা একেবারে ছোট্ট বাচ্চা।
মহিলার কাশি হয়েছে। শুলেই কাশি বেড়ে যাচ্ছে। সারা রাত্রি ঘুমাতে পারছেন না।
স্বামী বললেন, ওর কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। সারা রাত্রি বসে থাকে। আপনি যে করে হোক কমিয়ে দিন।
এখন সবারই এমন কাশি হচ্ছে। খুব সহজে কমছেও না।
মেয়েটি বলল, সেটাই তো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। হয়েছে তো সামান্য কাশি। আজ নয় কাল সেরে যাবে। কিন্তু তার জন্য তুমি কেন সারা রাত জেগে আমার পাশে বসে থাকবে।
স্বামী বললেন, বেশ করব বসে থাকব। তোমার পাশে বসে থাকতে ভালো লাগে।
মেয়েটির দুচোখে জল টলটল করে। সে বলে, আমার কী আছে বলো। অ্যাসিড ছুড়ে মুখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তাদের কারো শাস্তি হয়নি। তারা দিব্যি আছে, তুমি খামোখা কেন আমার জন্য জীবনটা ব্যর্থ করলে?
আমি দুজনের দিকে তাকালাম। এখনই দুজনকেই থামিয়ে দেওয়া যায়। দুজনেই এমন পর্যায়ে পৌঁছে কথা বলছে যার সাথে রোগের চিকিৎসার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু আমি থামাতে পারছি না। ইচ্ছাও করছে না। মনে হচ্ছে তাদের এই কথোপকথন চলুক অনন্ত কাল।
ছেলেটি বলে- ব্যর্থতা কাকে বলে? তোমাকে নিজের করে পাওয়াকে? তোমাকে আমি ছোটো থেকে চিনি দোলন। তুমিও আমায় চেনো। তারপরও এমন কথা তোমার মাথায় আসে কী করে?
মেয়েটি বলে, আমার ভয় হয়। তোমাকে ঠকাচ্ছি মনে হয়। তুমি একজন সুন্দর নিখুঁত মেয়েকে পেতে। সেও তো তোমাকে দিব্যি ভালো বাসতো।
ছেলেটি হেসে বলে- তুমি যে সুন্দরী নও, সেটা কে বলল। আচ্ছা ডাক্তারবাবু, দোলনকে আপনার অসুন্দর বলে মনে হচ্ছে।
মেয়েটির দিকে তাকালাম। তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছে। লজ্জা- গর্ব- ভালোবাসা সব একসাথে মেশানো। ক্ষত বিক্ষত পোড়া মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। ছেলেটি বলল- বলুন না ডাক্তারবাবু- দোলনকে কী দেখতে খারাপ?
সত্যিটা বলতে সাহস পেলাম না। যদি বলতাম এর মতো সুন্দর মেয়ে পৃথিবীতে খুব কমই আছে, তাহলে শিওর ছেলেটি জেলাস ফিল করবে। তাই একটু সাবধানী হয়ে বললাম, ইয়ে… আপনার স্ত্রী সুন্দর, খুবই সুন্দর। তবে একেবারে ডানাকাটা পরী নয়। ওর থেকেও সুন্দরী মেয়ে আছে। আমি দেখেছি।
বেচারা স্বামী মনঃক্ষুণ্ণ হলো। আর আমি ঘেঁটে ঘ হয়ে গেলাম। খারাপ মানুষ, ভালো মানুষ, সুন্দর অসুন্দর, ভালোবাসা- ঘৃণা সব মিলিয়ে মাথায় চক্কর লেগে গেল।
★ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। 🙏